স্বামী স্ত্রীর স্থাপত্য ভুবন

আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়ে স্থাপত্যশিল্পে যারা সৃষ্টিশীল কাজ করে চলেছেন তাদের মধ্যে রফিক আজম ও জান্নাত জুঁই অন্যতম। তারা স্বামী-স্ত্রী। রফিক আজম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে এবং জান্নাত আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির স্থাপত্য বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। তাদের রয়েছে ‘সাতত্য’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। এই ফার্মের প্রধান আর্কিটেক্ট হিসেবে আছেন স্বনামধন্য স্থপতি রফিক আজম। আর জান্নাত জুঁই হেড অব ডিজাইন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন তৈরি করে দেশে-বিদেশে অনেকের নজর কেড়েছে। সম্প্রতি জান্নাত যোনাল নাসা কতৃক আয়োজিত ইন্ডিয়ার চন্ডিগড়ে প্যানেলিস্ট এবং ডিজাইন কম্পিটিশনে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। এবার আনন্দ আলোর ব্রাইডল সংখ্যায় শাহ্ সিমেন্ট সুইট হোমে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
ইট, কাঠ, বালু ও কংক্রিটের মাঝেই রফিক আজম ও জান্নাত জুঁই দম্পতি খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির সান্নিধ্য। আর তাই তাদের প্রতিটি স্থাপনায় থাকে সবুজের ছোঁয়া। ঘর-বাড়ি সহ প্রতিটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে আলো, বাতাস, সবুজ সহ প্রকৃতিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন তারা। স্বামী-স্ত্রী দুজনই সুনিপুন ভাবে তৈরি করে চলেছেন একের পর এক বিশ্বমানের স্থাপত্য। দুই ভাই বোনের মধ্যে ছোট জান্নাত। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নেত্রকোনায়। জন্ম নরসিংদী জেলায়। বাবা সরকারি চাকরি করতেন বিধায় তার বেড়ে ওঠা দেশের বিভিন্ন জায়গায়। জান্নাতের বাবার নাম মো: জাহিদ হোসেন। তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা নাদিরা জাহান একজন লেখিকা ও গবেষক। তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেন। নাদিরা জাহান সাহিত্যাঙ্গনে সুরমা জাহিদ নামে পরিচিত। গত বছর বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের সাথে জড়িত ছিলেন জান্নাত জুঁই। নাচ-গান করতেন। খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। ছবি আঁকা আঁকি, বই পড়া ছিল তার পছন্দের বিষয়।
স্কুল জীবন থেকে ক্রিয়েটিভ কিছু করার প্রতি জান্নাতের ভালোবাসা জন্মায়। সেই ভালোবাসা থেকে আজ তিনি হয়েছেন সফল একজন স্থপতি। নিজের ইচ্ছা থেকেই আর্কিটেক্ট হওয়া তার। জয়দেবপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ২০০৫ সালে। ২০০৭ সালে হলিক্রস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির স্থাপত্য বিভাগে। ২০১৩ সালে তিনি ব্যাচেলল অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পরপরই তিনি যোগ দেন স্বনামধন্য স্থপতি রফিক আজমের ‘সাতত্য’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে জান্নাত এই প্রতিষ্ঠানের হেড অব ডিজাইন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ‘সাতত্য’ এ কাজ করার সময় জান্নাতের পরিচয় হয় স্থপতি রফিক আজমের সঙ্গে। তারপর গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। ২০১৫ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতি এক কন্যা সন্তানের জনক-জননী। আড়াই বছরের মেয়ের নাম জুওয়েরিয়া আজম। স্থপতি রফিক আজমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার লালবাগে। রফিকের বাবার নাম মোহাম্মদ আজম। মা আঙুরি বেগম। ১৯৮৯ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন।
রফিক আজম দেশের খ্যাতিমান স্থপতিদের মধ্যে একজন। মেধার গুণে পেয়েছেন বিশ্বজুড়ে পরিচিতি। মালয়েশিয়া, পাকিস্তান থেকে অস্ট্রেলিয়ার যেখানেই তিনি কাজ করেছেন তা হয়ে উঠেছে দর্শনীয় বিষয়। খ্যাতিমান স্থপতি রফিক আজমের নামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্কলারশীপ দেয়া হয়। যার নাম রফিক আজম ট্র্যাভেলস স্কলারশীপ। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার স্থপতি ইনস্টিটিউড, মনাস ইউনিভার্সিটি, কলকাতার যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ও শ্রীলঙ্কায় এই বৃত্তি প্রদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়াও দেশে তার নামে বৃত্তি প্রদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ব্রাক ইউনিভার্সিটি ও আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটিতে।
বর্তমানে রফিক আজম ‘সাতত্য’ প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্থপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে স্ত্রী জান্নাত জুঁই হেড অব ডিজাইন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছেÑ আজিমপুরের দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে মেয়র হানিফ জামে মসজিদ, পুরনো ঢাকায় ৩১টি পার্ক এবং প্লে গ্রাউন্ডের কাজ, বারিধারার কসমোপলিটন ক্লাব, মিরপুর-১৪ এর সিআরপি ফিজিও থেরাপি সেন্টার, ধানমন্ডি দৃক গ্যালারি, সাভারের সাংবাদিক আশরাফ কায়সারের ভ্যাকেশন হাউজ, ধানমন্ডি ৯/এ এর মেঘনা আবাসিক ভবন, গুলশানের এসএ আবাসিক ভবন, বনানীর ইপিলিয়ন গ্রæপের চেয়ারম্যান মি: মামুনের আবাসিক ভবন, আসিফ জহিরের আবাসিক ভবন, গুলশানের ফারুক হাসানের আবাসিক ভবনের ইন্টেরিয়র, বসুন্ধরার স্বাধীন গ্রæপের মালিকের বাসভবনের ইন্টেরিয়র, গুলশানের মিঃ আজহার এর আবসিক ভবনের ইন্টেরিয়র, নাফিসা কামালের বাসভবনের ইন্টেরিয়র, বনানীর উর্মি গ্রæপের মালিকের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ইন্টেরিয়র, লালবাগের স্থপতি রফিক আজমের আবাসিক ভবনের ইন্টেরিয়র, বারিধারার সাউথ ব্রিজের ইন্টেরিয়র সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন তারা। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছে।
নবদম্পতির বাসা কেমন হওয়া উচিৎ? এ প্রশ্নের জবাবে জান্নাত জুঁই বলেন, নবদম্পতি বলতে আমরা বুঝি নতুন বিয়ে হয়েছে এমন দম্পতি। নবদম্পতির বাড়ির ডিজাইনটা যদি এমন করা যায়, যেখানে প্রকৃতির সাথে বাড়ির সম্পর্কটা অনেক বেশি তৈরি করা যায় তাহলে সম্ভাবনা রয়েছে এই নতুনত্বটা তাদের জীবনে বহুদিন পর্যন্ত প্রবাহিত হতে থাকবে, সেখানেই আসলে সার্থকতা।
এখন যদি আমরা চিন্তা করি ঢাকা শহরের মত ব্যস্ত, কোলাহলময় ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে নবদম্পতির আমেজটা কিভাবে পাব, হতে পারে নবদম্পতি দুজনে মিলে কোন ফ্ল্যাট বাসায় উঠেছে, সেখানে কি করে বাসার আবহাওয়াকে রোম্যান্টিক করে তোলা যায়? এখানে আসলে স্থপতিদের গুরুত্ব সমাজকে বুঝতে হবে।
একজন স্থপতিরই কাজ যে কোনো পরিবেশের মধ্যে ক্লায়েন্টের আশানুরূপ চাহিদা পূরণ করা। যেমন যেকোনো জায়গাতেই সৃষ্টিকর্তা রোদ দিয়েছেন, বাতাস দিয়েছেন, গাছগাছালি, পাখি দিয়েছেন, আকাশ সেখান থেকে দেখা যায় নিশ্চিত। এই যে এলিমেন্টগুলো যেগুলো আমরা অনেক কষ্ট করে দূরে গিয়ে দেখি সেগুলো আমরা যেখানেই থাকি কেন সেখানেই দেওয়া আছে।
সুতরাং আমাদের জানতে হবে এর ব্যবহার রীতির ব্যাপারে। কি করে সর্বোচ্চ ব্যবহার আমরা পাই।

সেটাই স্থপতির উদ্দেশ্যে যে নবদম্পতি বলতে যে সৌন্দর্যটা বোঝায় সেটাকে যত লম্বা করা যায় জীবনে, তো বাসাটাও সেরকমই হওয়া উচিৎ।
পুরো পরিবেশটা তৈরি করে ফেলার পর ছোট ছোট জায়গাগুলোতে নজর দিতে হবে। যেমন বেডরুম নব দম্পতির সবচেয়ে প্রাইভেট জায়গা, সেখানে তাদের মধ্যে সম্পর্ক, কথাবার্তা সর্বোপরি পরিবেশটিকে আরো উজ্জীবিত করার জন্য রুমের রঙ, ফ্লোরের কালার, লাইটিংটা খুব রোম্যান্টিক হতে পারে, ঘরের কোণায় একটা ছোট লাইট জ্বলে থাকতে পারে, ঘরে একটি আলো আধারির মিশ্রিত খেলা তৈরি করতে পারে। আজকালকার প্রযুক্তি নির্ভর মিউজিক সিস্টেম, অটোমেশন ইত্যাদি থাকতে পারে। রুমের ফার্নিচার খুব যতœ নিয়ে করতে হবে। এইসব কিছু বেডরুমের আবহাওয়ায় একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। তিনি আরও বলেন, নবদম্পতিকে যদি ছোট্ট একটি পরিবার মনে করি, যাদের একদিন একটি/দুইটি সন্তান হবে, সে বাসাটা ছোট্ট, রান্নাঘরটার সাইজ কি হবে, ডাইনিং এর সাথে তার দূরত্ব, বারান্দা, বারান্দায় একটি বসার জায়গা, একটি গাছ, সেখানে বাতাস আসে, ফুলের গন্ধ আসে। বাচ্চার ঘরের ডিজাইন এমন হল যেন ভেতরের দরজা দিয়ে মা/বাবা বাচ্চার রুমে চলে যেতে পারে। আরেকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল বাসার কেবিনেটের ব্যবহার। প্রচুর পরিমাণ কেবিনেট থাকতে হবে। জামার জন্য, জুতার জন্য, ব্যাগের জন্য স্যুটকেস রাখার জন্য, বইয়ের জন্য, ক্রোকারিজের জন্য, কসমেটিক্সের জন্য, লেপ কম্বলের জন্য মোটকথা সবকিছুর জন্য ডিজাইন করা কেবিনেট থাকলে বাসা গোছানোটা অনেক সহজ আর আরামদায়ক হয়।
ঘর যখন এত গোছানো আর আরামদায়ক হয়, তখনই আমাদের মনে হবে আমরা কি কোন রিসোর্টে আছি কি না। এভাবে ডিটেইলিং করে একটি পরিবেশকে ভিন্নমাত্রার রোমান্টিক কম্ফর্টেবল লিভিং করা যায়।
প্রকৃতি আর ভেতরকার পরিবেশ নিয়ে এই যে নবদম্পতির বাসার ডিজাইন, তখন এটাকে মনে হবে উৎসব।
বাসার এই আবহাওয়া, এই আমেজ নবদম্পতির দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়ে। তারা গর্বিত হয় তাদের নিজেদের বাসা নিয়ে। নতুন বাসার সৌন্দর্য, রোমান্টিক আবহাওয়া ওদের জীবনে ছাপ পড়ে। নতুনত্ব দীর্ঘয়িত হয়। নতুন জীবনের শুরুর এই আবহাওয়ার রেশ ছড়িয়ে থাকে পরবর্তী সময়ের জন্য।

  • শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি