অঞ্জুময় এক বিকেলের গল্প

সৈয়দ ইকবাল
এ যেনো স্বর্ণযুগ সিনেমার এক চিলতে আলো ধরা দিলো সিনেমাপ্র্রেমীদের কাছে। এফডিসিতে হঠাৎ এক বিকেল মনে করিয়ে দিলো এ দেশে সিনেমার ক্ষেত্রে এক সময়ের সেই স্বর্ণালী দিন গুলোর কথা। আসলেই সেটা একটা সময় ছিল বটে। ১৯৮৯ সাল। যে বছর মুক্তি পেয়েছিল ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ নামের সিনেমাটি। কে জানতো এই একটি সিনেমাই বাংলা সিনেমার জন্য একটি ইতিহাস তৈরি করে রাখবে এবং সেই ইতিহাসের ধারে কাছে কেউ কখনো ভিড়তে পারবে না। হ্যাঁ, সেটাই হয়ে আছে এখন অবধি।
আর তাই তো ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ সিনেমা মানে বাংলা সিনেমার এক অন্য আবেগ, অন্য ক্ষণ এবং অন্য এক ঐতিহ্যও বটে। সে কারণে এই সিনেমার যেকোনো বিষয়ই সিনেমাপ্র্রেমী তথা চলচ্চিত্র ঘরানার মানুষের জন্য অনেক আনন্দের বিষয় হয়ে যায়। তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছি সম্প্রতি। এফডিসি হয়ে উঠেছিল আনন্দ উৎসব মুখর। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ ছবিতে জুটিবেঁধে অভিনয় করেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ। এরপর হঠাৎ অঞ্জু ঘোষ পাশের দেশ ভারতে চলে যান। গত ৬ সেপ্টেম্বর দেশের মাটিতে ২২ বছর পর পা রাখেন জনপ্র্রিয় এই চিত্রনায়িকা। ৯ সেপ্টেম্বর প্র্রিয় এফডিসিতে আসেন তিনি। তবে একা নয়। সঙ্গে ছিলো তার প্র্রিয় রাজকুমার ইলিয়াস কাঞ্চনও। এদিন শিল্পী সমিতি এই দুই তারকাকে নিয়ে আয়োজন করে এক প্র্রীতি সম্মিলন অনুষ্ঠানের। আর তাই তো এফডিসিতে অঞ্জু ঘোষকে ঘিরে তৈরি হয় ভালোবাসার অনন্য এক আবেগ। ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ সিনেমার নায়ক দেশে থাকলেও সিনেমা থেকে দূরে আছেন। অন্যদিকে নায়িকা অঞ্জু ঘোষ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কয়েক বছরের মাথায় পাড়ি জমান কলকাতায়। এত হিট ছবির পরেও কোন অভিমানে ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে গেলেন? গেলেন তো গেলেন, আর ফিরলেনই না! মোটাদাগে এই প্র্রশ্নটাই সাংবাদিকরা করেছিল অঞ্জু ঘোষ বরাবর।
টানা ২২ বছর পর অঞ্জু ঘোষ দেশে এলেন। পা রাখলেন প্র্রিয় কর্মস্থল এফডিসিতে। শিল্পী সমিতির অফিসে বসে বললেন নিজের আবেগ-অনুভূতির কথা। যদিও ঘুরে ফিরে উপস্থিত সাংবাদিকদের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা ছিল, কোন ক্ষোভে, কোন অভিমানে তিনি দেশ ছেড়েছেন? অঞ্জু ঘোষ বেশ স্পষ্ট ভাষায় জানালেন, দেশ ছাড়ার বিষয়ে তার কোনও অভিমান কিংবা ক্ষোভ ছিল না। তার ভাষায়, ‘আমার কোনও দিন কারও প্র্রতি ক্ষোভ ছিলো না। ফলে বিশেষ কোনও কারণ কিংবা ব্যক্তির কারণে আমি পালিয়ে যাইনি। মজার বিষয় হলো, আমি ওখানে (কলকাতায়) দুই দিনের জন্য গিয়েছিলাম। এরপর ফেঁসে গেছি। আর ফেরা হলো না। এর পেছনে আর কোনও কিন্তু নেই।’
একটু থেমে তিনি আবারও বললেন, ‘এটা আমার দেশ। এখান থেকেই নিঃশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছি। সেই নিঃশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছি এখনও । যেখানেই থাকি বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে আছে।’
তারকা জীবন প্র্রসঙ্গে বলেন, ‘তারকা বলতে কিছু নেই। আমার কাছে মনে হয়, পৃথিবীতে যত রকমের শ্রমিক আছে সবচেয়ে বড় শ্রমিক আমরা, যারা শিল্পী। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। এটাও মনে রাখা দরকার, হাজার কোটি টাকা মানুষ আমাদের ওপর লগ্নি করে। আমি প্র্রায় সাড়ে তিনশ ছবি করেছি। একবার ভাবুন, প্র্রযোজকরা আমার ওপর ভরসা করে কত বড় লগ্নি করেছেন? সেই ভরসার মূল্যটা তো ফেরত দিতে হবে। তাই নিজেকে তারকা ভাবিনি, শ্রমিক ভেবেছি সবসময়। আগেও শ্রমিক ছিলাম, এখনও আছি। এখনও পরিশ্রম করে যাচ্ছি।’
কথা কথায় অঞ্জু ঘোষ দুঃখ প্র্রকাশ করেন দুই বাংলার সিনেমার চলমান বেহাল দশার কথা উল্লেখ করে। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় এসে আমি যে ভাই-ভাবির বাসায় উঠেছি সেখানকার একটা কথা বলি। গতকাল সন্ধ্যার কথা। ড্রইংরুমে বসে ভাবি একটা সিরিয়াল দেখছিলেন। আমিও বসে আছি। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করলাম, ভাবি অনেক মনোযোগ দিয়ে সিরিয়ালটা দেখছিলেন। আমি সিরিয়াল না দেখে ভাবিকেই দেখলাম মুগ্ধ হয়ে। একই দৃশ্য দেখি কলকাতাতেও, ঘরে ঘরে। এসব দেখে বুকের ভিতরটা চিন চিন করে। ভাবতে কষ্ট হয়, এই মানুষগুলো এক সময় এভাবেই সিনেমা দেখতো। অথচ এখন আর সেভাবে দেখে না। দুই বাংলাতেই সিনেমার অবস্থা খুব খারাপ। মানুষ এখন সিরিয়াল দেখে, সিনেমা না। এসব নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার।’
অঞ্জু ঘোষ প্রায় একঘণ্টা ছিলেন শিল্পী সমিতির ছোট্ট অফিসটিতে। অনেক মানুষের ভিড়, কানফাঁটা শব্দ, অব্যবস্থাপনার মধ্যে। কথাও কম বললেন। তবে শেষটা করেছেন বেশ আবেগ ঝরিয়ে। জানালেন, এই সফরে তার মায়েরও আসার কথা ছিল ঢাকায়। কিন্তু ক’দিন আগে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। অথচ ঢাকায় আসা নিয়ে মা-মেয়ের পরিকল্পনা ছিল অনেক। এরপর বলেন, ‘মায়ের কথা বেশি বললে আমার কান্না আসবে। আমি চাই না এই আনন্দ দিনে কাঁদতে। আজ সবচেয়ে ভালো লাগছে আমার মাতৃভূমিতে পা দিতে পেরেছি। এরচেয়ে বড় সুখ বড় আনন্দ আর কিছুতে নেই। অনেক সমস্যা হয়েছে আসতে। সব ভুলে গেছি। আপনারা আমার জন্য আশীর্বাদ করবেন।’
ঐদিন বেলা সাড়ে তিনটায় শিল্পী সমিতির অফিসে ফুলের মালা দিয়ে অঞ্জু ঘোষকে বরণ করে নেন তারই সহশিল্পী ইলিয়াস কাঞ্চন। এ সময় সঙ্গে ছিলেন সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর, সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমিতির আজীবন সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়া হয় অঞ্জু ঘোষকে।
উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে অঞ্জু ঘোষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোলানাথ অপেরার হয়ে যাত্রায় নৃত্য পরিবেশন করতেন ও গান গাইতেন। ১৯৮২ সালে এফ কবীর চৌধুরী পরিচালিত ‘সওদাগর’ সিনেমার মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। এই ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সফল ছিল। রাতারাতি তারকা বনে যান তিনি। অঞ্জু বাণিজ্যিক ছবির তারকা হিসেবে যতটা সফল ছিলেন, সামাজিক ছবিতে ততটাই ব্যর্থ হন। ১৯৮৭ সালে অঞ্জু সর্বাধিক ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেন। মন্দা বাজারেও যেগুলো ছিল সফল ছবি। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ অবিশ্বাস্য রকমের ব্যবসা করে। সৃষ্টি করে নতুন রেকর্ড। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে- সওদাগর, নরম গরম, আবে হায়াত, রাজ সিংহাসন, পদ্মাবতী, রাই বিনোদিনী, সোনাই বন্ধু, বড় ভালো লোক ছিল, আয়না বিবির পালা, আশা নিরাশা, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, মালাবদল, আশীর্বাদ প্রভৃতি।

  • টিভি গাইড