ফ্যাশন একাল-সেকাল

রেজানুর রহমান: একটু খেয়াল করলেই দেখবেন বাড়ির ঘর-দোরের সাজ সজ্জাও সব সময় একই রকম থাকে না। ফেব্রæয়ারি মাসে হয়তো কারও বাসায় বেড়াতে গেছেন। আবার একই বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরেও হয়তো সেই বাসায় বেড়াতে গেলেন। একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন নিশ্চয়ই। আর কিছু না হোক ড্রয়িংরুমে কোনো না কোনো পরিবর্তন দেখবেনই। হয় সোফা বদল হয়েছে না হয় জানালার পর্দা বদল হয়েছে। অথবা দেওয়ালের পেইন্টিং বদলে গেছে। আবার এমনও হতে পারে দেওয়ালের রং-এর পরিবর্তন হয়েছে। এটা হলো সময়ের দাবি। সময় যা চায় মানুষ তাই করে। আদিকালে মানুষ উলঙ্গ ছিল। পরে গাছের পাতা, ছাল বাকল দিয়ে নিজেদের লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করেছে। পরবর্তীতে এলো কাপড়। যত পারো শরীর ঢাকো। কালের বিবর্তনে শরীর ঢাকার সেই প্রবণতা বদলে গেছে। এখন পশ্চিমা দেশগুলোতে শরীরে কাপড় আছে ঠিকই। কিন্তু সেই কাপড় শরীর ঢাকার জন্য নয়। যত পারো শরীর খোলার জন্য। এটাকে কেউ কেউ বলছেন ফ্যাশন।
এই ফ্যাশন কিন্তু যুগে যুগে বদলায়। কল্পনা করুন তো বেশি দূর যেতে হবে না, আশি এবং নব্বই-এর দশকে আমাদের দেশে পোশাকের ক্ষেত্রে যে ধরনের ফ্যাশন ছিল সেই ফ্যাশন কি আজকের যুগে চলবে? আমাদের দেশে পবিত্র ঈদ উপলক্ষেই মূলত পোশাকের ফ্যাশন নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। একটা সময় ছিল ফ্যাশন হাউজগুলোর ওপরই আমাদেরকে নির্ভর করতে হতো। কি এলো ফ্যাশন জগতে? পাঞ্জাবি, আর শাড়িতে ফ্যাশনের নতুন কি মাত্রা যুক্ত হলো? এই নিয়ে শুরু হয়ে যেতো জল্পনা কল্পনা। মেয়েরা সালোয়ার কামিজের ডিজাইন নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে যেতো। ফ্যাশন হাউসগুলো চটকদার বিজ্ঞাপন দিতো পত্রিকায়। গোটা রমজান মাস জুড়ে পোশাকের কেনা কাটা জমজমাট হয়ে উঠতো। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনেই ফ্যাশনের ক্ষেত্রে নতুন ধ্যান-ধারণার জন্ম হচ্ছে প্রায় প্রতি মাসেই। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব বেশ স্পষ্ট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলেই পোশাকের ক্ষেত্রে নানা ডিজাইন চোখে পড়বে। ফলে ঈদের আগেই অর্থাৎ পবিত্র রমজান মাস আসতে না আসতেই ফ্যাশন ভাবনার ¯্রােত বয়ে যেতে থাকে প্রায় প্রতিটি অগ্রসরমান পরিবারে। ফলে ইদানিং ক্রেতার চাহিদার কথা ভেবেও অনেক ফ্যাশন হাউস তাদের পোশাকের ডিজাইন করে। আগের দিনগুলোতে ফ্যাশন হাউসগুলোর পোশাকের নিত্য-নতুন ডিজাইন দেখে ক্রেতারা পোশাক কেনার ব্যাপারে আগ্রহী হতো। আর বর্তমান জমানায় ক্রেতার চাহিদার কথা মাথায় নিয়েই ফ্যাশন হাউসগুলো তাদের নতুন নতুন পোশাকের ডিজাইন করছে।
তবে হ্যাঁ, নতুন পোশাক নিয়ে মাতামাতি করার সময়ও পাল্টেছে। আগের জমানায় ঈদে নতুন পোশাক কেনার ধুম লেগে যেতো। এখনকার জমানায় দুই ঈদ তো বটেই বাংলা নববর্ষে নতুন পোশাক কেনা-বেচার নতুন ফ্যাশন চালু হয়েছে। বাংলা নববর্ষে পায়জামা, পাঞ্জাবি, শাড়ি আর সালোয়ার কামিজ কেনার ধুম পড়ে যায়। ইদানিং ঈদের চেয়েও বাংলা নববর্ষ পোশাক কেনা-বেচার বিশেষ উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। ঈদে যেমন নতুন জামা, পাঞ্জাবি, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ চাই তেমনি পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা বছরের প্রথমদিনেও পাঞ্জাবি, শাড়ি আর সালোয়ার-কামিজের চাহিদা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ফ্যাশনের ক্ষেত্রে আঙ্গিকগত নানা পরিবর্তন।
ষাটের দশকের একটি পরিবারের ছবি আর বর্তমান সময়ে একই ধরনের আরেকটি পরিবারের ছবি কিন্তু এক রকম হবে না। অনেকেই হয়তো বলবেন এটা তো জানা কথা। দুটি পরিবার। কাজেই ছবি তো আলাদা হবেই। আমরা ছবির কথা বলছি না। বলছি পোশাকের কথা। ষাটের দশকের পোশাক আর বর্তমান সময়ের পোশাক একই রকম নয়। ষাটের দশকে পোশাকে রঙ-এর বাহার ছিল ঠিকই কিন্তু পোশাকে শরীর ঢাকার প্রবণতা ছিল প্রকট। আর বর্তমান সময়ে শরীর যেন মুখ্য নয়, শরীর খোলা রেখে কীভাবে পোশাক তৈরি করা যায় এটাই যেন কারও কারও বিরামহীন প্রচেষ্টা। বিশেষ করে মেয়েদের কামিজের ক্ষেত্রে ইদানিং একটা নতুন ফ্যাশন চালু হয়েছে। দুই হাতের উপরের অংশের কামিজ কাটা থাকে। মেয়েরা এই ফ্যাশন লুফে নিচ্ছে। এবারের ঈদে হয়তো এই ধরনের কামিজ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কাপড় তো শরীর ঢাকার জন্য। সেক্ষেত্রে শরীর খোলা পোশাকের ডিজাইন কেন করছি আমরা। আর সেটা কেনই বা লুফে নিচ্ছি!
শুধু কি কাপড়ের ক্ষেত্রে ফ্যাশন পাল্টেছে? না, চুলের কাটিং-এর ক্ষেত্রেও ফ্যাশন বদলে গেছে। কি ছেলে, কি মেয়ে সবার চুলের কাটিং এ পরিবর্তন এসেছে। আজকাল টিনএজ ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকালে বিষয়টা বেশ নজরে আসে। বিশেষ করে ছেলেদের ক্ষেত্রে চুলের নতুন স্টাইল একটু যেন অন্যরকম। অবাক করা ব্যাপার হলো-পোশাক বলি আর মাথার চুলের নতুন স্টাইলই বলি না কেন, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির আদলে ফোকাস হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে পোশাকে ফ্যাশন বদলাচ্ছে। ছেলেদের মাথার চুলের কাটিং হচ্ছে অন্যরকম। শুধু কি পোশাক ও মাথার চুলের ফ্যাশন বদলে যাচ্ছে? মানুষের আচার-আচরণের ক্ষেত্রেও একটা পরিবর্তন লক্ষণীয়।
ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলাদেশের মানুষ অতিথি পরায়ণ। প্রতিবেশীর প্রতি অতিমাত্রায় সহনশীল। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেই ঐতিহ্য যেন হারাতে বসেছি আমরা। পোশাক ও চুলের কাটিং বদলের মতো সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা বদলের ফ্যাশন চালু হয়েছে যেন। অতিথি পরায়ণ সংস্কৃতি যেন এখন আর তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। প্রতিবেশীর প্রতি অতিমাত্রায় সহনশীল থাকার সংস্কৃতিও যেন দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কি? পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিদেশি টেলিভিশনের প্রভাব এক্ষেত্রে বহুলাংশে দায়ী। আমরা মানি আর নাই মানি, বিদেশি অর্থাৎ পাশের দেশের কলকাতার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের প্রভাব আমাদের দেশে বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। কলকাতার সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির বেশ মিল আছে। কিন্তু কলকাতার প্রচার মাধ্যম বাণিজ্যের নামে বাঙালি সংস্কৃতিকে অনেকটা খোলামেলা পণ্যের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তাদের টিভি সিরিয়াল, সিনেমার শরীর এতটাই খোলামেলা তা দেখে আমরা অনেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছি। পোশাকে, চলনে, বলনে আমরা অনেকে তাদেরকে অনুসরণ, অনুকরণ করতে গিয়ে নিজের ঐতিহ্য হারাতে বসেছি। সে কারণে বিগত বছরগুলোতে একটি টিভি সিরিয়ালে দেখা বিশেষ চরিত্রের পোশাক কেনার জন্য আমাদের দেশে হৈ চৈ শুরু হবে কেন?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দোর্দÐ প্রতাপের এইযুগে নিজেদেরকে ঘরের কোণে বন্দী রাখার কোনো যুক্তি নাই। তাই বলে নিজেদের ঐতিহ্যকে বিকিয়ে দিয়ে অন্যের আচার আচরণকে অন্ধের মতো অনুসরণ করবো এটা সঠিক ভাবনা নয়। যুগের প্রয়োজন বলে একটা কথা আছে। সে জন্য ফ্যাশনে যতটুকু বদল প্রয়োজন তাই যেন আমরা করি। সবার জন্য রইলো ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।

  • প্রতিবেদন