যা ছিল অন্ধকারে

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নিয়োজিত পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা রেখে ঢেকে যা বলেছে তা থেকেও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে কি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা কোনোভাবেই আড়াল করা যায়নি। পাকিস্তান সরকার কিন্তু হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। জুলফিকার আলী ভুট্টো তা দ্রæতই বাক্সবন্দী করে ফেলেন। সে রিপোর্ট কোথায়, কেউ জানেনা। ক্ষমতার হাতবদল হওয়ার পরও তা সূর্যালোক দেখেনি। কিন্তু ২৭ বছর পর কীভাবে যেন তা অন্ধকার ঘর থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যায় এবং ভারতীয় একটি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে। তবে তা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট নয়, আংশিক। এই আংশিক রিপোর্টে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সমরনায়কদের ভয়ঙ্কর সব তথ্য বেরিয়ে আসে…

বিশ শতকের ইতিহাস কলঙ্কিত করেছিল যেসব নৃশংসতা তার অন্যতম হচ্ছে উনিশশ একাত্তর সালে বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যা। নয় মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা হত্যা করেছে ত্রিশ এদেশের লাখ মানুষ। ধর্ষণ করেছে দুই লাখের বেশি বাঙালি নারীকে। ধ্বংস ও লুণ্ঠন করেছে বাংলাদেশের সম্পদ, স্থাপনা ও ঘর-বাড়ি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এত ব্যাপক গণহত্যা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের পর ১৯৭৩ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো একটি কমিশন গঠন করেন। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের টার্মস অব রেফারেন্স ঠিক করে দেয়া হয়Ñ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের কারণ নির্ণয় করাই হবে এই কমিশনের কাজ। কমিশন ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল, ব্রিগেডিয়ারসহ প্রায় সব কমান্ডারকে ডেকে পাঠান এবং তাঁদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন। বিচারপতি হামুদুর রহমান একটি দীর্ঘ রিপোর্ট প্রণয়ন করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে পেশ করেন। বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর স্বরূপ উদঘাটন করতে এ কমিশন গঠন করা হয়নি। বরং গণহত্যা, ধর্ষণ এবং লুণ্ঠনকে আড়াল করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য দায়বদ্ধ করার লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল এ কমিশন। কমিশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নিয়োজিত পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা রেখে ঢেকে যা বলেছে তা থেকেও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে কি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা কোনোভাবেই আড়াল করা যায়নি। পাকিস্তান সরকার কিন্তু হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। জুলফিকার আলী ভুট্টো তা দ্রæতই বাক্সবন্দী করে ফেলেন। সে রিপোর্ট কোথায়, কেউ জানেনা। ক্ষমতার হাতবদল হওয়ার পরও তা সূর্যালোক দেখেনি। কিন্তু ২৭ বছর পর কীভাবে যেন তা অন্ধকার ঘর থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যায় এবং ভারতীয় একটি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে। তবে তা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট নয়, আংশিক। এই আংশিক রিপোর্টে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সমরনায়কদের ভয়ঙ্কর সব তথ্য বেরিয়ে আসে। তাঁদের দুর্নীতি, নৃশংসতা, কাপুরুষতার একেকটা চিত্র লোমহর্ষক।

এই রিপোর্ট বাংলাদেশে আসে ২০০২ সালে একুশে টিভির সাইমন ড্রিংয়ের মাধ্যমে। রিপোর্টটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। তখনই এটির একটি নাট্যরূপ দেয়া নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। যেখানে বিশিষ্ট অভিনেতা মামুনুর রশীদ একনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। সেই বিবেচনা থেকেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের বর্তমান মহাপরিচালক এস এম হারুন-অর-রশীদকে অনুবাদ ও নাট্যরূপের দায়িত্ব দেয়া হয়। অতি দ্রæতই তিনি তা করে ফেলেন। এর মধ্যে একুশে টিভির টানাপোড়েন শুরু হয় এবং একধরনের মতানৈক্যের কারণে এই বিষয়টি পিছিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু এস এম হারুন-অর-রশীদ বিষয়টিকে আগলে রাখেন অত্যন্ত মমতায় এবং কমিশনের রিপোর্টকে নতুন করে নাট্যরূপ দিয়ে প্রচারের আয়োজন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন মেধাবী প্রযোজক আওয়াল চৌধুরীকে এর নির্দেশনার দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রচুর তথ্য-উপাত্ত, দুর্ঘটনার বিবরণ, কমিশনের প্রশ্নোত্তরসহ জটিল বিষয়কে নিয়ে এর কর্মতৎপরতা- সব মিলিয়ে একটি ইতিহাসভিত্তিক কাজ করেছে বিটিভি। এস এম হারুন-অর-রশীদের তত্ত¡াবধানে, আওয়াল চৌধুরীর নির্দেশনায় একদল প্রযোজনাকর্মী, চিত্রগ্রাহক সম্পাদনাকর্মী আলোকবিন্যাসকর্মীকে নিয়ে সম্পন্ন হয়েছে ‘যা ছিল অন্ধকারে’র কাজ। এটি একটি নিছক নাট্যরূপ নয়, এটি যেমন ঐতিহাসিক দলিল, তেমনি এর প্রযোজনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিকায়ন এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের কারণগুলোকে চিহ্নিত করবে। এর পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ‘যা ছিল অন্ধকারে’ একটি অনবদ্য দলিল। সম্প্রতি এই প্রামাণ্যচিত্রের একটি প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয় বিটিভির একটি স্টুডিওতে। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ। আরো উপস্থিত ছিলেন বিটিভির মহাপরিচালক এস এম হারুন-উর-রশীদ, নির্দেশক আবদুল আউয়াল চৌধুরী, বিশিষ্ট অভিনেতা মামুনুর রশীদ, আজিজুল হাকিম, জিয়াউল হাসান কিসলু, শিল্প নির্দেশক মীর আহসান, উপস্থাপক ডা. নুজহাত চৌধুরীসহ ‘যা ছিল অন্ধকারে’র শিল্পী-কলাকুশলীগণ।

বিশেষ এই ধারাবাহিক প্রামাণ্যচিত্রে অভিনয় করেছেন গুণী অভিনেতা মামুনুর রশীদ, শহিদুল আলম সাচ্চু, আজিজুল হাকিম, জিয়াউল হাসান কিসলু, মোহাম্মদ বারী, শাহ আলম দুলাল, আহমেদ রুবেল, নাদের চৌধুরী, শতাব্দী ওয়াদুদ, আজাদ আবুল কালাম, আরমান পারভেজ মুরাদ, শামস সুমন, মাজনুন মিজান, আদনান ফারুক হিল্লোল, মাহমুদুল হাসান মিঠু, মারুফ কবির, ঝুনা চৌধুরী, তোফা হোসেন, অনন্ত হীরা, রামিজ রাজু, আব্দুল্লাহ রানা, চন্দন রেজা, তারিকুজ্জামান তপন, রওনক বিশাখা শ্যামলী, আশরাফ কবীর সহ অর্ধশত নাট্যশিল্পী।

  • প্রতিবেদন