হতে চাই তার মতো তাদের মতো…

রেজানুর রহমান

বাকের ভাইয়ে ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। বাস্তবে নয়, নাটকে। তাই নিয়ে সে কি তোলপাড়। শুধু ঢাকায় নয় সারাদেশে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ঢাকায় মিছিলে শ্লোগান উঠেছিলÑ বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে…। দেশ বরেণ্য অভিনেতা, নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর বাকের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নাটকটি বিটিভিতে বহুবছর আগে প্রচারিত হয়। কিন্তু আজও তার রেশ লেগে আছে আমাদের টিভি নাটকে। এখনও সভা-সমাবেশে আড্ডায় আসাদুজ্জামান নূরকে সবাই বাকের ভাই বলেই সম্মোধন করেন।

বাকের ভাই এই চরিত্রটি কিন্তু ‘মাস্তান’ টাইপের ছিল। বিশেষ স্টাইলে তিনি কথা বলতেন। তবুও তার প্রতি দেশের মানুষের এত ভালোবাসা কেন সৃষ্টি হয়েছিল? একটাই কারণ-চরিত্রটির সংবেদনশীল একটা মন ছিল। মাস্তান হলেও সাধারণ মানুষের পক্ষে কাজ করতো বাকের ভাই। চরিত্রের ভেতরে এতটাই ঢুকে গিয়েছিলেন যে টিভি দর্শক চরিত্রটিকে একান্ত আপন ভেবেছিল। আর তাই বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে শুনে গর্জে উঠেছিল।

তার মানে বাকের ভাই চরিত্রটি প্রমাণ করে টেলিভিশন নাটকের একটি চরিত্রও বদলে দিতে পারে অনেক কিছু। মানুষকেও বদলে দিতে পারে। বলা বাহুল্য টিভি নাটকের বাকের ভাইকে দেখে সে সময়ে বাস্তবের অনেক মাস্তান ভালো হবার পথ খুঁজেছিলেন। অনেকেই বাকের ভাই হতে চেয়েছিলেন।

বিটিভির একটি জনপ্রিয় টিভি নাটক ছিল ‘পারলে না রুমকি’! অভিনয় করেছিলেন নন্দিত অভিনেতা আফজাল হোসেন ও গুণী অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। প্রেমের নাটক। দুই তরুণ-তরুণীর প্রেমকে উপজীব্য করে নাটকটি লেখা হয়েছিল। আফজাল হোসেন ও সুবর্ণা মুস্তাফার অভিনয় গুণে নাটকটি এতটাই মানসম্পন্ন হয়েছিল যে এখনও আড্ডা, আলোচনায় অনেকেই ‘পারলে না রুমকী’র উদাহরণ টানেন। আহা! এমন নাটক আর তো দেখি না।

বর্তমান সময়ের আলোচিত নাটক বড় ছেলের কথাও উল্লেখ করার মতো। মিজানুর রহমান আরিয়ানের অনবদ্য সৃষ্টি বড় ছেলেতে অপূর্ব মধ্যবিত্ত পরিবারের দায়িত্ববান ছেলের চরিত্রে অভিনয় করে একটা বোধের জন্ম দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ধর্নাঢ্য পরিবারে জন্ম নেয়া আদুরে মেয়ের চরিত্রে মেহজাবীনের অভিনয় দেখেও মনে হয়েছে বাস্তবতা কতটা নিষ্ঠুর। দেশে প্রতিদিন অসংখ্য টিভি নাটক বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচার হয়। অথচ গল্পের গাথুনির কারনে দর্শককে টানতে পারে না। সেক্ষেত্রে বড় ছেলে ব্যতিক্রম। মধ্যবিত্ত পরিবারের ত্যাগী ছেলের ভ‚মিকায় একাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন অপূর্ব। দর্শক বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের ত্যাগী ছেলে-মেয়েরা অপূর্বকে এখন প্রেরণা মনে করেন। বিশেষ করে বড় ছেলে নাটকে অপূর্ব’র ত্যাগ স্বীকারের ঘটনায় বাস্তবের অনেক বড় ছেলেরা মিল খুঁজে পায়। ফলে অপূর্ব অনেকের কাছে বাস্তবেরই ‘বড় ছেলে’ হয়ে উঠেছেন। অভিনয়ের বাইরে অপূর্ব যখন কোথাও সময় কাটাতে যান তখন অনেকেই তাকে ঘিরে ধরে। বাবা-মায়েরা এগিয়ে এসে কুশল জিজ্ঞেস করেÑ বাবা তুমি ভালো আছো তো! অপূর্ব বললেন, আমি বুঝতে পারি তারা বড় ছেলে নাটকটি দেখেছে এবং আমাকে ‘বড় ছেলে’ ভেবেই কথা বলছে। যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে আমি তখন খুব এনজয় করি। নাটকের একটি চরিত্রে অভিনয় করে মানুষের এত ভালোবাসা পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।

ছোটবেলায় একটা যাত্রাপালা দেখেছিলাম। যাত্রাপালার নামÑ নবাব সিরাজদ্দৌলা। মীরজাফরের ভ‚মিকায় যিনি অভিনয় করছিলেন তার ব্যাপারে দর্শক হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অভিনেতাকেই অনেকে আসল মীরজাফর ভেবে যাত্রাপালা চলাকালেই জুতা স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারতে থাকে। ওই অভিনেতা এক একটি জুতা ও স্যান্ডেল হাতে তুলে নিয়ে দর্শককে বিনীত ভাবে সম্মান দেখাচ্ছিলেন। সেদিন মনে হয়েছিল একজন অভিনেতা ইচ্ছে করলে কি না পারেন।

আসলে অভিনেতা, অভিনেত্রীরাতো দর্শকের আইডলে পরিণত হন। বিটিভির ‘সকাল-সন্ধ্যা’ ধারাবাহিক নাটকের প্রেমিক জুটি শিমু ও শাহেদের কথা বোধকরি এখনও অনেকে ভোলেননি। বিটিভির এই ধারাবাহিক নাটকের কল্যাণে শিমু ও শাহেদের ভ‚মিকায় অভিনয় কারী আফরোজা বানু ও পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে দেশের অনেক তরুণ শাহেদ হবার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। অনেক তরুণী শিমু হবার স্বপ্ন দেখে। বিবাহযোগ্যা মেয়ের বাবা-মায়েরা শাহেদর মতো ভদ্র-ন¤্র ছেলের খোঁজ করতে শুরু করেন। আর ছেলের বাবা-মায়েরা খুঁজতে শুরু করেন শিমুর মতো একটা ল²ী মেয়ে। সেই সময় বিয়ের ঘটককে বলাই থাকতোÑ শিমুর মতো একটি মেয়ে চাই।

শুধু কি টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রের চরিত্ররাই আমাদের চারপাশের পরিবেশকে প্রভাবিত করে? ঠিক তা নয়। উপন্যাসের চরিত্ররাও আমাদের চারপাশের পরিবেশকে প্রভাবিত করে। নন্দিত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। হিমু সহজ-সরল পরোপকারী একটি চরিত্র। হলুদ পাঞ্জাবি পরে। খালি পায়ে হাঁটে। কারও অনিষ্ঠ করে না। শুধু দেশের নয়, বিদেশের অনেক জায়গায় বাস্তবেও হিমু আছে। উপন্যাসের একটি চরিত্র কীভাবে বাস্তবে প্রভাব ফেলে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠেছে হুমায়ূন আহমেদের হিমু। তাঁর উপন্যাসের মিসির আলী চরিত্রটিও অনেকের আইডল।

শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসের দেবদাস। এরপরই বাঙালি পাঠক সমাজে হুমায়ূন আহমেদের হিমু ও মিসির আলীই বোধকরি বহুল আলোচিত চরিত্র। শরৎচন্দ্রের দেবদাস নিয়ে অনেক নাটক হয়েছে। একাধিক ভাষায় সিনেমা নির্মিত হয়েছে। কেউ প্রেমে ‘ছ্যাঁকা’ খেলেই আমরা তাকে ‘দেবদাস’ বলে ডাকতে শুরু করি।

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘নূরজাহান’ চরিত্রটিও বাস্তবে বেশ আলোড়ন তুলেছে। উপন্যাসটি বাংলাদেশ ও ভারতে ব্যাপক পাঠক নন্দিত হয়েছে। বাংলাদেশে চ্যানেল আই-এ নূরজাহানের ওপর নির্মিত দীর্ঘ টিভি ধারাবাহিক নির্মিত হয়। ‘নূরজাহান’ নির্যাতিতা নারীর প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে উঠেছে। একটি উপন্যাসের চরিত্র বাস্তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে সাহস যুগিয়েছে।

প্রয়াত ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের ‘ঢেউ জাগে’ উপন্যাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র নেতাকে এতটাই বিশ্বস্ত করে তোলা হয়েছে যে তাকে অনেকে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করে। প্রচÐ ঝড়ের কবলে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। গাছপালা ভেঙ্গে পড়েছে। ছাত্র নেতা তার দলবল নিয়ে ছুটে আসে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে উদ্ধার করতে। এক সময় ছাত্র নেতারা এমনই উদার ছিলেন। এখন এসব গল্প শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয়। একজন ছাত্রনেতা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বিপদে এগিয়ে আসবেন এটাতো কল্পনাও করা যায় না।

কিন্তু সমাজকে গড়ে তুলতে হলে টিভি নাটক, চলচ্চিত্র কবিতা ও উপন্যাসে রিয়েল হিরোর উপস্থিতি আরও বাড়ানো দরকার। হতে চাই তার মতো… কার মতো? যাকে আমি ভালোবাসি। আমি দেবদাসকে ভালোবাসি। আমি হিমু হতে চাই। ঐ যে মিসির আলী যায়। আহারে যদি শিমু হতে পারতাম। শাহেদের মতো আমার মেয়ের যদি একটা ‘বর’ জুটতো. ‘বাকের ভাই’ এর মতো প্রেমিক চাই… হতে চাই ‘পারলে না রুমকী’র মতো নাটকের নায়ক-নায়িকা। এমন স্বপ্নময় চরিত্রেরা যত বেশি নাটক, সিনেমা ও উপন্যাসে উপস্থিত হবে আমাদের সমাজ তত বেশি আলোকিত হবে।

শেষে একটি গল্প বলি। নায়করাজ রাজ্জাকের অভিনয়ের ভক্ত ছিল এক তরুণ। নায়করাজের মতো মাথার চুলের স্টাইল তার। নায়করাজের মতোই হাঁটাচলা, আচার ব্যবহার। তখনকার দিনে সিনেমাই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। সে কারণে নায়করাজের নতুন সিনেমা মুক্তি পেলেই প্রথম শোয়ের টিকেট কিনে ঢুকে পড়তো হলে। নায়করাজের একটি সিনেমা দেখে সে নিজেকে গড়ে তোলার পথ খুঁজে নেয়। সিনেমার কাহিনী ছিল অনেকটা এরকমÑ নায়ক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কিছু একটা করার ইচ্ছায় ঢাকা শহরে আসে। প্রথমে টিউশনী করে। তারপর ছোট ব্যবসা ধরে। ছোট ব্যবসা একদিন বড় হয়… সিনেমার কাহিনীকে বাস্তবে রূপদান করেছেন সেই তরুণ। এখন তিনি দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। প্রসঙ্গ ক্রমে বললেন, একটি সিনেমা আমার জীবনের গতি পাল্টে দিয়েছে। সিনেমার কাহিনী দেখে আমি ভেবেছিলামÑ রাজ্জাক পারলে আমিও পারবো। এরকম সিনেমা তখন আর দেখি না।

সত্যি তো তাই। সিনেমার কাহিনীর কোন নায়ক অথবা নায়িকা কি এখন কারও আইডল হন? উপন্যাসের কোনো বিশেষ চরিত্র কি ভাবায় আমাদের?

  • টিভি গাইড