বায়েজীদের স্থাপত্য ভুবন!

বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য স্থপতি। দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করে স্বল্পমূল্যে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে স্থাপত্য শিল্পে দেশের জন্য সৃষ্টিশীল কাজ করে চলেছেন। তিনি ইট, কাঠ, কংক্রিটের চেনা জগতের বাইরে বেরিয়ে প্রকৃতিকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০০ সালে ছোট্ট পরিসরে নিজে গড়ে তোলেন ‘নকশাবিদ আর্কিটেক্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটি বনানীতে বড় পরিসরে এর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ যাবৎ তিনি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন করেছেন। এবার শাহ সিমেন্ট সুইটহোমে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক।

ইট, কাঠ কংক্রিটের চেনা জগতের বাইরে বেরিয়ে প্রকৃতিকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে ছিল বরাবরই। তবে সুযোগ মেলে কম। বাংলাদেশের মতো দ্রæত উন্নয়নশীল দেশে সাধ আর সাধ্যের মধ্যে চেষ্টাও চলতেই থাকে। শুরুতে সেই চেষ্টার কথাই বললেন স্থপতি বায়োজিদ মাহবুব খন্দকার। এরই মধ্যে তিনি রাজধানী ঢাকায় অসংখ্য এপার্টমেন্ট বিল্ডিং ডিজাইন করেছেন। বাণিজ্যিক ভবনও করেছেন ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীসহ ঢাকার সব অভিজাত এলাকাতেই। নকশাবিদ আর্কিটেক্টসের প্রধান স্থপতি বায়েজিদ বলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং এর বাইরে স্থাপত্য নামে যে একটি পেশা আছে, এদেশের মানুষ এর সঙ্গে পরিচিতই হয় স্বাধীনতার পর। আর স্বীকৃতি বা এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সময় নিয়েছে আরও দু’দশক। আর এর নান্দনিকতা নিয়ে কথা বলার সুযোগ অংশত মিলছে মাত্র কিছুদিন হলো।’

এক সময় সরকারি স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার চাকরিটা ছেড়েছিলেন স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য। বাবা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কালাম খন্দকারও বিচলিত ছিলেন এ সিদ্ধান্তে। বায়েজিদ চাকরি ছাড়লেনই। স্থাপত্যে ততদিনে মজা পেতে শুরু করেছেন তিনি। লোকজ জ্ঞানের সঙ্গে নিত্য নতুন প্রযুক্তির নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ মিলছিল না তেমন। ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া আর রংপুরে অসংখ্য বহুতল ভবনের নকশা করেছেন। মতিঝিলে সিটি সেন্টারের মূল নকশা তারই করা। মিরপুরে কিডনী ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ডিজাইন করেছেন তিনি। উত্তরায় জসিমউদ্দীন রোডে এবিসি হেরিটেজ ও সংলগ্ন এসএম টাওয়ার এবং বসুন্ধরায় মাগুরা গ্রæপের কর্পোরেট ভবনের স্থপতি তিনি।

বায়েজিদ জানান, ঢাকায় জমির উচ্চমূল্যের কারণে ক্লায়েন্ট বা ডেভেলপারের কাছে কোন ভবন বা স্থাপনার স্থাপত্যিক গুণাবলির চেয়ে ব্যবসাই মুখ্য। আমাকে ক্লায়েন্টের চাহিদাকে মাথায় রাখতে হয়েছে বেশি। আর এ কারণেই বাংলাদেশে চকচকে সুপরিসর যেসব ভবন দেখছেন, তা একদমই আমাদের ঘরানার নয়। পশ্চিমা ঘরানার।

তিন পুত্রের জনক বায়েজিদ থাকেন নিজেরই নকশা করা বনানীর একটি এপার্টমেন্টে। স্ত্রী আফরিন আরা চৌধুরী একসময় চাকরি করতেন। পরে তাকে পাশে নিয়ে নকশাবিদ প্রতিষ্ঠা করেন বায়েজিদ। অফিস, আর ব্যবসা দুজনেই মিলেমিশে দেখেন। তবে বায়েজিদের মতে, বড় কাজটা করেন তিনিই। হেসেল থেকে শুরু করে নকশাবিদ, তিন পুত্র সামলানো, সব ধরনের সামাজিকতা, সেই সরকারি চাকরিকালীন সময় থেকে এক হাতে সামলাচ্ছেন তার স্ত্রী। আর এই কারণেই কর্মক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে পেরেছেন বায়েজিদ। বায়েজিদের সহকর্মীরাও একবাক্যে বলেন, তাদের বস একদমই কাজ পাগল মানুষ।

এরকম কাজ পাগল মানুষ যখন রংপুরে আট লাখ বর্গফুটের বিশাল জায়গায় সাততলা কারখানা ভবনের কাজ পেলেন, তখন মনের আনন্দেই কাজ করলেন। পুরো কারখানাটিকে একটা বিশাল সবুজ বাগান বললে ভুল হবে না। নানা প্রজাতির গাছে ছেয়ে আছে ইট-পাথরের দালান। সাততলা ভবনের ওপর থেকে দেয়ালজুড়ে ঝুলছে লতাপাতার গাছ। ভবনের সামনেও গাছগাছালি। দক্ষিণের বাতাস এসে গাছে দোল খায়। এভাবে দেয়ালগুলো গাছে ছেয়ে ফেলা ভবন শীতল রাখার জন্যই করা। ভবনের দক্ষিণ দিকে সূর্যের আলো এসে পড়ে। এ জন্য ভবনের প্রতি তলায় সাড়ে চার ফুট দূরত্ব রেখে বারান্দা ও জানালা রয়েছে।

কারখানার দক্ষিণে খোলা জায়গাটি সবুজ গাছগাছালিতে ভরা। যে কোনো দর্শনার্থীর মনে হবে পার্ক। বায়েজিদ এজন্য ক্রেডিট দেন শিল্পী সাইদুল হক জুইসকে। বাল্যবন্ধুর বড় ভাই  শিল্পী জুইস কারখানার পরিবেশ আর নির্মাণ স্থাপত্যের সঙ্গে সবুজের আবহেরনিবিড় বন্ধন তৈরি করে পুরো কারখানাকেই একশিল্পকর্মে পরিণত করেছেন তিনি।

বায়েজিদ প্রবীণ স্থপতি আলী ইমামকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের কাজ করছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর নির্মাণ শুরু হয়েছে। বিজয় সরনিতে এ জাদুঘর হচ্ছে পাঁচ লাখ আঠারো হাজার পাঁচশ বর্গফুটের। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদলে প্রকল্প এলাকাকে ধরা হয়েছে পতাকার সবুজ জমিন। স্বাধীনতার দীপ্ত সূর্য রক্ত লাল বৃত্তের প্রতিফলনে মূল জাদুঘর ভবন হচ্ছে একটি বৃত্তাকার স্থাপনা। দেশের ভূমি, আকাশ এবং জলসীমার অতন্দ্র প্রহরী অকুতোভয় সেনাদের প্রতীকায়িত করা হয়েছে তিনটি ওয়েভ দ্বারা, কংক্রিটের বিশালায়তন ফ্রি ফর্মের এ তিন স্থাপনা ছড়িয়ে গেছে পুরো প্রকল্পের জমিনে, শৌর্যের রূপক হয়ে। তিন লেভেলে এ জাদুঘরে রয়েছে সিনেপ্লেক্স, সেমিনার হল, লাইব্রেরি, আর্কাইভ, থিয়েটার হল, অডিও ভিসুয়াল কন্ট্রোল কক্ষ ও কাফেটেরিয়া।  বৃত্তাকার এ স্থাপনার উপরিতলে রয়েছে প্রায় এক লাখ বর্গফুটের উন্মুক্ত প্রদর্শনীর জায়গা। যেখানে স্থলযুদ্ধে ব্যবহৃত সমরাস্ত্র ও যুদ্ধযান প্রদর্শন করা হবে।

এছাড়াও বায়েজিদ করছেন পাঁচ লাখ বর্গফুটের চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মিউজিয়াম ও মনুমেন্টের কাজ। প্রায় ১০ একর জায়গা জুড়ে এ প্রকল্পটি নির্মাণ শেষ হলে চট্টগ্রামে একটি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রকল্পে নির্মিত হবে চারশ ফুট লম্বা গøাসের তৈরি ওয়াচ টাওয়ার। কর্ণফুলি নদী থেকে বন্দরগামী সব জাহাজ থেকে দেখা যাবে এটি। বায়েজিদ আনন্দ পেয়েছেন আমান গ্রæপের এমডি রফিকুল ইসলামের বাসভবন ডিজাইন করতে গিয়ে। উত্তরা তিন নং সেক্টরে নির্মাণাধীন এ ভবনে দুটো সুইমিং পুল ছাড়াও রয়েছে কয়েকটি মুক্ত জলাধার। যার ধারণাটি এসেছে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি বাড়ির পাশে নিজস্ব পুকুরের ধারণা থেকে। বগুড়ার নিভৃত গ্রাম গোহাইলে সাধারণ একটি মসজিদ ডিজাইন করেছেন। গ্রামীণ পটভূমিতে লাল ইটের তৈরি এ স্বল্প বাজেটের এ মসজিদকে তার একটি ভালো কাজ বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম স্বয়ংসম্পূর্ণ গেটেড কম্যুনিটি বিজয় রাকিন সিটি ডিজাইনও করেছেন বায়েজিদ। মিরপুরে পুলিশ কনভেনশন হলের পিছনে গড়ে উঠছে এ উপশহর। ২৫ বিঘা জায়গার উপরে নির্মিত এ সিটিতে রয়েছে দুশ’রও বেশি এপার্টমেন্ট, নিজস্ব বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সুপরিসর একাধিক খেলার মাঠ, শিশু পার্ক, সুইমিং পুল, কম্যুনিটি সেন্টারসহ প্রায় সব ধরনের নাগরিক সুবিধা। রাজধানীর উপকণ্ঠে চার হাজার এপার্টমেন্টের রাকিন কাঁচপুর সিটি’রও কাজ শুরু করেছেন তিনি। নি¤œমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আওতার মধ্যে স্বল্পমূল্যের এপার্টমেন্ট হবে এগুলো।

বায়েজিদ একসময় কবিতা লিখতেন। ইট, কাঠ কংক্রিটের জগতে কবিতা লেখা আর হয়ে ওঠে না। শিখতেন  সেতার। প্রিয় সেতারে ধুলোর আস্তর  জমেছে। ছেলের জন্য কেনা পিয়ানো শিখতে শুরু করেছেন এখন। নতুন কিছু শেখায় তার আগ্রহ বরাবরের। অবসরে গান শোনেন। ছুটির দিনে স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন লং ড্রাইভে, রাজধানীর ব্যস্ত জীবন ছেড়ে সবুজের খোঁজে।

বায়েজিদের কাছে এখন  চ্যালেঞ্জ, দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করে স্বল্পমূল্যে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা । এ নিয়ে কাজ করতেও শুরু করেছেন তিনি। প্রকৃতপক্ষেই গরিবের শহর নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন তিনি। স্থাপত্যকে অতি সাধারণ মানুষের জীবনধারায় সম্পৃত্ত করা আর তাদের  জীবনবোধ নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। এখনও অনেকটা পথ বাকি, স্বল্পভাষী বায়েজিদ সে কথাটাই জানান।

  • শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি