দ্বীপের রূপে কালো ছায়া-মুকিত মজুমদার বাবু

পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই দ্বীপদেশ। দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটকের তীর্থস্থান প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন যেমন আছে তেমনি আছে উপক‚লীয় অন্যান্য দ্বীপও। তবে উল্লেখযোগ্য হলোÑ নিঝুম দ্বীপ, সোনাদিয়া, স›দ্বীপ, উড়িরচর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী। এক সময় ২৮টি উল্লেখযোগ্য উপক‚লীয় দ্বীপ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের অহঙ্কার হলেও বৈরী জলবায়ুর প্রভাব আর মানবসৃষ্ট কর্মকাÐের কারণে আজ অনেক দ্বীপই হারিয়ে যেতে বসেছে। সর্বশেষ যে দ্বীপটি হারিয়ে গেছে তার নাম দক্ষিণ তালপট্টি।

সোনাদিয়া দ্বীপ: কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় সোনাদিয়া দ্বীপের অবস্থান। দ্বীপটির আয়তন মাত্র ৭ বর্গকিলোমিটার। জেলাসদর থেকে উত্তর-পশ্চিমে ১৫ কিলোমিটার দূরে মহেশখালী দ্বীপের দক্ষিণে এটি অবস্থিত। তিনদিকে সমুদ্রসৈকত, সাগরলতায় ঢাকা বালিয়াড়ি, কেয়া-নিশিন্দার ঝোপ, ছোট-বড় খাল বিশিষ্ট প্যারাবন আর নানা প্রজাতির বিচিত্র জলচর ও পরিযায়ী পাখির অবস্থান দ্বীপটিকে করে তুলেছে অপূর্ব সুন্দর। বিস্তীর্ণ এই দ্বীপের প্যারাবনে রয়েছেÑ কেওড়া, হারগোজা, সাদা বাইন, কালো বাইন, নূনিয়া ইত্যাদিসহ প্রায় ২৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। দ্বীপে প্রায় ৭০ প্রজাতির জলজ ও উপক‚লীয় পরিযায়ী পাখি আসা-যাওয়া রয়েছে। দ্বীপটিতে পৃথিবীর বিপন্ন তিন প্রজাতির পাখিÑ চামচঠুটোঁ বাটান, এশীয় ডাউচার এবং নর্ডম্যান সবুজপা দেখা যায়। সোনাদিয়ার সৈকতে দেখা যায় বিপন্ন প্রজাতির অলিভ রিডলি কাছিমের ডিম। দ্বীপের খাল ও তীরবর্তী সমুদ্রে বিপন্ন ইরাবতী ডলফিন, বটলনোজ ডলফিন ও পরপয়েস দেখা যায়।

নিঝুম দ্বীপ:সৌন্দর্যের আধার হয়ে দক্ষিণে অবস্থান করছে নিঝুম দ্বীপ। কয়েকটি দ্বীপ মিলে প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একর জায়গা নিয়ে গঠিত এই দ্বীপ অঞ্চলটি নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে জেগে ওঠে। ১৯৭০ সালের আগে দ্বীপে অস্থায়ী কিছু বসতি দেখা গেলেও অধিকাংশ সময় জনশূন্য থাকতো। যার কারণে দ্বীপটির নাম হয় নিঝুম দ্বীপ। চিত্রা হরিণ আর পরিযায়ী পাখির কারণে নিঝুম দ্বীপ সকলের দৃষ্টি কাড়ে। পাখির মধ্যে রয়েছেÑ নানা জাতের হাঁস, কয়েক প্রজাতির বাটান, স্যান্ডারলিং, কালামাথা এবং খয়রামাথা গাঙচিল, ধলাপেট সিন্ধু ঈগল, দেশি গাঙচষা, মেটেমাথা সিন্ধু ঈগল প্রভৃতি। নিঝুম দ্বীপে হরিণের দেখা মেলে। তবে দিন দিন এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ খাদ্য সংকট, মিঠাপানির অভাব ও শিকারিদের দৌরাত্ম্য।

সেন্টমার্টিন দ্বীপ:বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ হলো অপরূপ রূপের সেন্টমার্টিন। কক্সবাজার-টেকনাফ পেনিনসুলা থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে নাফ নদীর মুখে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষিণের অংশ সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সারি সারি নারিকেলের গাছ, দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের গর্জন, নীল জলরাশির তীরে আছড়ে পড়া, পানির নিচের প্রবালের প্রাচীর আর নানা বৈচিত্র্যের মাছ ও প্রাণীর ছুটোছুটি সবকিছুই সেন্টমার্টিনকে দিয়েছে আলাদা এক সৌন্দর্য। রাতের অন্ধকারে সাগরের গর্জন আর তার ঢেউয়ের ফসফরাসের আলোয় পুরো দ্বীপটাকে মনে হয় স্বপ্নপুরী। দ্বীপের সৌন্দর্যের টানে প্রতিবছর হাজার হাজার প্রকৃতিপ্রেমী ছুটে আসেন এই স্বপ্নদ্বীপে। নারিকেল গাছের প্রাচুর্যতার কারণে স্থানীয়ভাবে কেউ কেউ দ্বীপটিকে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলেন। ছোট এই দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৮ কিলোমিটার। মূলদ্বীপ ছাড়া আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত একটি বর্ধিতাংশ আছে যেটি ছেঁড়াদ্বীপ নামে পরিচিত। মূল সেন্টমার্টিন দ্বীপে জনবসতি থাকলেও ছেঁড়াদ্বীপে কোনো বসতি নেই।

সেন্টমার্টিনে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক ঘুরতে যায় যা দ্বীপটির ধারণ ক্ষমতার বাইরে। দিন দিন দ্বীপটি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। অতিরিক্ত মৎস্য, প্রবাল এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ, পর্যটকদের ভিড় আর তাদের পরিবেশ বিরূপ আচরণ দ্বীপটিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় সেন্টমার্টিন দ্বীপ যেন বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। পর্যটকদের চাহিদার জন্য প্রবাল প্রাচীর হারিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় লোকজনদের মধ্যে অনেকে এখন প্রবাল সংগ্রহকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দ্বীপের সৌন্দর্য এবং স্বকীয়তা দুটোই ধ্বংস করা হচ্ছে।

পরিবেশের নান্দনিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের আধারের ভরপুর দ্বীপগুলো আজ অস্তিত্ব সংকটে। প্রতিবেশব্যবস্থাও ভালো নেই।

পর্যটনের অমিত সম্ভাবনাময় এই দ্বীপগুলো টিকিয়ে রেখে রক্ষা করতে হবে এর জীববৈচিত্র্য। তবেই সকলে দেখতে পাবে রূপসী বাংলাকে, সোনার বাংলাকে।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন

প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন
  • প্রকৃতি কথা