প্রীতি ওয়ারেছা
এক সময় আমাদের প্রচার মাধ্যমের আভিজাত্যই বলা চলে তা ছিল রেডিও। গল্প, উপন্যাস এমনকি সিনেমায় নায়ক-নায়িকাদের দেখা যেত তারা রেডিওতে গানের রেকডিং করছেন। সেই গান শুনছেন দেশের মানুষ। কী যে সেই আকুলতা! রেডিওতে প্রোগ্রাম করা মানেই শিল্পীর জাতে উঠে যাওয়া। ‘আজ আমার রেডিওতে প্রোগ্রাম আছে’ শিল্পীরা একথা বলতেন বেশ অহংকারের সাথেই। শুধু কী শিল্পীরাই আগ্রহ দেখাতেন? তা নয়। রেডিও ছিল সাধারণ মানুষের আনন্দ বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। টেলিভিশন ছিল কিন্তু তার গন্ডি ছিল হাতেগোনা কিছু মানুষের কাছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের ড্রয়িংরুমে টেলিভিশন শোভা পেত। অবশ্য টেলিভিশনে অনুষ্ঠান প্রচার হোত সন্ধ্যার পর মাত্র কয়েকঘণ্টা। কাজেই পরিবারের বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ ছিল রেডিও। ঘরে ঘরে রেডিও, পাড়ায় পানের দোকানে রেডিও, সেলুনে রেডিও, খেতে কাজ করছেন কৃষক তার ধারে কাছেও থাকতো রেডিও। অলস গৃহিণীর কোন কাজ নাই। দুপুরে অখন্ড অবসর। রেডিও কানের কাছে রেখে শুনতেন ‘অনুরোধের আসর’ অথবা পাঁচমিশালী গান। কিংবা আধুনিক গানের অনুষ্ঠান। জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে প্রিয় শিল্পীর গান রেডিওতে বাজানোর জন্য খাম অথবা পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতেন শত শত শ্রোতা। তারপর অনুষ্ঠানে ঘোষকের মুখে নিজের নামটি উচ্চারিত হয় কিনা তা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। হয়তো ঘোষক বলছেনÐ এখন শুনবেন রুনা লায়লার সেই বিখ্যাত গান… শুনতে চেয়ে অনুরোধ পাঠিয়েছেন ঢাকার যাত্রাবাড়ি থেকে অয়ন, চয়ন, পাপিয়া, রনজনা, ফরিদ, বাশার, লাবনী, খঞ্জনা, বাবলু, প্রিয়া, হুমায়ুনসহ অনেকে। ধরা যাক একজন অয়নের কথা। সে অনুরোধ পাঠিয়েছে রেডিও ভবনে। যাত্রাবাড়িতে হয়তো আরো অনেক অয়ন আছে। ক্রেডিট হয়তো সেও নিতে পারে। কিন্তু চিঠি পাঠানো অয়ন শুধু তার নামটা ঘোষকের মুখে শুনেই খুশীতে লাফ দিয়ে উঠলো। বলেছে, আমার নাম বলেছে। পরের দিন সে সবার কাছে হিরো হয়ে যায়। বন্ধুরা দেখা হলেই হয়তো বলতে শুরু করে রেডিওতে কাল তোর নাম বলেছে… তুইতো ব্যাটা হিরো হয়ে গেলি। রেডিওর ক্ষমতা ছিল এতটাই প্রখর। শুধু কি গান, নাটকের ক্ষেত্রেও রেডিওর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। সাপ্তাহিক নাটকের পাশাপাশি জনসংখ্যা সমস্যা, বাল্যবিবাহ রোধসহ নানা বিষয়ে নাটক/নাটিকা প্রচার হোত। শ্রোতারা ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে নাটক শুনতো। সাপ্তাহিক নাটকের শ্রোতা ছিল বিশেষভাবে উলেখ করার মতো। খবরের কথা বিশেষভাবে উলেখ করা জরুরি। রেডিওর খবর অনুষ্ঠান ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। ইদানিং যেমন পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ব্যস্ততা সত্তে¡ও টেলিভিশনে সন্ধ্যা ও দুপুরের খবর দেখতে ভুল করেন না। তেমনি রেডিওর সেই যুগে সন্ধ্যার খবর এবং দুপুরের খবর বেশ আগ্রহভরে শুনতো শ্রোতারা। দুর্যোগ প্রতিরোধে রেডিওর খবরই ছিল মূল ভরসা। মোট কথা সংবাদপত্রের পাশাপাশি রেডিও, একমাত্র রেডিওই ছিল একমাত্র প্রচার মাধ্যম। ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে কেনিয়ার সাথে ক্রিকেট খেলে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতে নেয়ার পর ক্রিকেটের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। সেদিন বাংলাদেশের মানুষকে ক্রিকেট জয়ের কাঙিক্ষত সেই মুহ‚র্তেগুলোর খবর শুনেয়েছিল বাংলাদেশ বেতার অর্থাৎ রেডিও। ক্ষণে ক্ষনে সে কী উত্তেজনা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল জিতে যাওয়ার মুহ‚র্তটি রেডিওতে ঘোষনার পরই সারাদেশ উৎসবে মেতে ওঠে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে দেশের অসহার মানুষকে উজ্জীবিত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল রেডিও। রেডিওতে ‘চরমপত্র’, ‘জলাদের দরবার’সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুনে শুনে মুক্তিযোদ্ধারা সহ দেশের মানুষ চরম সংকটেও এগিয়ে চলার প্রেরণা খুঁজে পেয়েছিল।
সারাদেশে আমাদের চারশ’র ওপরে শ্রোতা ক্লাব আছে
আনন্দ আলো: এফএম রেডিও আসার পর শ্রোতাগোষ্ঠীর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনটা কিভাবে দেখছেন?
কাজী আখতার উদ্দীন আহমেদ: সময় মানুষকে সামনের দিকে নিয়ে যায়। মানুষ পঞ্চাশ দশকের সেই সময়ে আটকে নেই, তাদের কর্মব্যস্ততা বেড়েছে, চাহিদা বেড়েছে। কারোরই সময় নেই ঘরে কোন বিনোদন মাধ্যমের সামনে বসে বিনোদিত হবার। রাস্তাঘাটে এখন হরহামেশাই চলন্ত মানুষের কানে হেডফোন চোখে পড়ে। সেই হেডফোন দিয়ে তারা যে শুধু বেতারই শুনছে এমন কোন সার্ভে আমাদের কাছে নেই। হতেই পারে অন্য কোন অডিও মাধ্যমের সাথে তারা নিজেকে সংযুক্ত রেখেছে। তবে তাদের সাথে এমন একটি মিডিয়া আছে যেটা শোনার জন্য তাকে আলাদা করে কোন সময় ব্যয় করতে হচ্ছে না। একসময় বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষকে খবরের কাগজ পড়তে দেখা যেত। দেশের বাইরে বাসে ট্রামেও একই দৃশ্য চোখে পড়ত, কিন্তু এখন কোথাও সেই দৃশ্য নেই। সবার চোখ এখন থাকে মোবাইলের স্ক্রিনে। সেখানেই তারা অনলাইনে খবরের কাগজ পড়ে। মানুষ কাজকর্মের মধ্যেও অডিও মাধ্যমের সাথে সংযুক্ত থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছে। এখন এই অডিও মাধ্যমের মধ্যে কতটা রেকর্ডেড কনটেন্ট, কতটা বাংলাদেশ বেতার, কতটা বেসরকারি এফএম রেডিও এসবের কোন সার্ভে আমাদের কাছে নেই। তবে এটা ঠিক যে প্রাইভেট এফএম একটা নির্দিষ্ট শ্রোতাগোষ্ঠী তৈরি করেছে। সেই নির্দিষ্ট শ্রেণীর শ্রোতারা কতটুকু বিনোদিত হচ্ছে কিংবা বিভ্রান্ত হচ্ছে সেটা ভাবা দরকার। বাংলাদেশ বেতারেরও নিজস্ব এফএম আছে। বাংলাদেশ বেতার একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় গণমাধ্যম। আমরা দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন করি। অবৈজ্ঞানিক ও সস্তা বিষয়বস্তু সম্বলিত অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয় হওয়া বাংলাদেশ বেতারের লক্ষ না। বাংলাদেশ বেতার বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। বিষয়টা খুব সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়- একজন মানুষের ফাস্টফুড পছন্দ হতেই পারে কিন্তু তাই বলে সপ্তাহের সাতদিনই ফাস্টফুড খেলে সে অসুস্থ হয়ে যাবে। সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষের প্রয়োজন সূষম খাবার। আমরাও ঠিক সেই কাজটি করি। আমরা অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করি সূষম পন্থায়, সেখানে থাকে বিনোদন, শিক্ষা, সচেতনতা, থাকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আনন্দ আলো: মূলত তরুণরাই এফএম রেডিওর শ্রোতা। পরিবারের সবাইকে রেডিওমুখি করার কোন কি উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বেতার?
কাজী আখতার উদ্দীন আহমেদ: তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আমি একটু দ্বিধা দ্বন্দের মধ্যে থাকি। তারা আসলে কি শোনে! কোন মাধ্যম শোনে- বেতার নাকি প্রাইভেট এফএম! বিনোদনের উদ্দেশ্যে তারা কি শুধু গানই শোনে? নাকি রাতের বেলা ভূতের গল্প শোনে? নাকি দিনের বেলা পড়ালেখার অনুষ্ঠান শোনে! খেলার সময় না হয় বুঝতে পারি তারা খেলার কমেন্ট্রি শুনছে। কারণ খেলা সবার কাছে উৎকৃষ্ট বিনোদনের উৎস। বাংলাদেশ বেতার কৃষি নিয়ে কাজ করে, স্বাস্থ্যের ওপরে কাজ করে, পরিবেশের ওপরে কাজ করে। বেতারের প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানেরই নির্দিষ্ট শ্রোতাগোষ্ঠী আছে। সব শ্রোতাই পরিবারকেন্দ্রিক শ্রোতা। সারাদেশে বাংলাদেশ বেতারের প্রায় চারশর ওপরে শ্রোতা ক্লাব আছে। শুধুমাত্র বেতারের অনুষ্ঠানগুলো শোনার জন্যেই তারা শ্রোতা ক্লাব গঠন করেছে। সববয়সী শ্রোতা আছে শ্রোতা ক্লাবে। এরা বেতারের পাগল শ্রোতা। প্রচুর ফিডব্যাক পাই তাদের কাছ থেকে।
পরিবর্তনই যুগের চাহিদা
আনন্দ আলো: এফএম রেডিও আসার পর শ্রোতাগোষ্ঠীর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনটা কিভাবে দেখছেন?
মনোরঞ্জন দাস: পরিবর্তনই যুগের চাহিদা বিষয়টা মানতে হবে। পজিটিভ পরিবর্তনের সাথে যুগ এগিয়ে যাবে। রেডিওর ক্ষেত্রেও তাই। বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার আরম্ভ হয় উনিশ শতকের প্রথম ভাগে। সেসময় খবরের কাগজের সাথে শিক্ষিত শ্রেনীর যোগসূত্র ছিল। খবরের কাগজের পাশাপাশি শিক্ষিত শ্রেণী বেতারের প্রতিও আকৃষ্ট হয়। তবে সত্যিকার অর্থে বেতারের গ্রহনযোগ্যতা বাড়ে পঞ্চাশের দশকে। বেতার শোনার জন্য লেখাপড়া জানার প্রয়োজন পড়ে না, সব শ্রেনী-পেশার কাছে সহজে পৌঁছে যায়। একটা সময় মানুষের কাছে ক্যাসেট প্লেয়ার আসে। বেতারের চেয়ে ক্যাসেট প্লেয়ারের তুলনামূলক উন্নত সাউন্ডে মানুষ চমৎকৃত হয়। একসময় টেলিভিশন আসে। মানুষের দৃষ্টি ঘুরে যায় টেলিভিশনের দিকে। দেখা আর শোনা একসাথে, বিরাট আকর্ষণ। আরো পরে স্যাটেলাইট চ্যানেল আসে। এই চ্যানেল ভালো না লাগলে সেটা, সেটা ভালো না লাগলে ঐটা। এরপর সিডির যুগ শুরু হয়। সিডির সাউন্ড সিস্টেম আরো উন্নত। এইসব উন্নত প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হতে হতে মানুষের একসময় শোনার কান তৈরি হয়ে যায়। স্বভাবতই তখন শ্রোতারা অনুন্নত সাউন্ড সিস্টেমের প্রতি অনাগ্রহ দেখাতে থাকে। এরপর বাংলাদেশ বেতার সীমিত পরিসরে এফএম চালুর উদ্যোগ নেয়। এই মাধ্যমকে আরো জনপ্রিয় করার সিদ্ধান্ত হিসেবে বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি খাতে এফএম চালুর অনুমতি দেয়। রেডিওকে জনপ্রিয় করতে প্রাইভেট রেডিও কর্তৃপক্ষ প্রথমেই যে পদক্ষেপটি নেয় তা হলো উপস্থাপনার স্টাইল পরিবর্তন। এক শ্রেণীর শ্রোতা এই পরিবর্তিত স্টাইল লুফে নেয় কারণ এখানে খুব ক্যাজুয়ালি কথা বলা হয়। এফএম রেডিওর শব্দ কোয়ালিটি খুব ভালো। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল পোর্টেবল ডিভাইস যেটা মোবাইলেও শোনা যায়।
মনোরঞ্জন দাস: এফএম রেডিওর টার্গেট পিপল হল তরুণ সমাজ, এটা সত্যি কথা। বলতে গেলে সবগুলো প্রাইভেট এফএম স্টেশনই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করে তরুনদের চাহিদাকে মাথায় রেখে। তবে পরিবারের বয়স্কদের আকর্ষণ করে এমন অনুষ্ঠানও কিন্তু অনেক হচ্ছে। তরুণরা যেভাবে সারাক্ষণ এফএমের সাথে কানেক্ট থাকছে, ফিডব্যাক দিচ্ছে সেটা হয়ত বয়স্ক শ্রোতারা করছে না, পার্থক্য এটুকুই।
গত বছরের চেয়ে এবছর রেডিও শ্রোতা বেড়েছে ২৪%
মাকসুদুল হক ডিরেক্টর অপারেশন, ঢাকা এফএম
মাকসুদুল হক: মাঝখানের একটা সময় রেডিও মাধ্যম পিছিয়ে পড়ার কারণ সেসময় মানুষ বেশি ভিজুয়্যাল এটাচমেন্টে ছিল। শোনার চেয়ে দেখার ব্যাপারটা তাদের আকর্ষণ করেছিল। রেডিও যে কি পাওয়ারফুল মাধ্যম, একটা উদাহরণ দেই। স্বাধীনতার পরপর আমরা টেলিভিশনে ফুটবল খেলা দেখতাম কিন্তু কমেন্ট্রি শুনতাম রেডিওতে। টেলিভিশনের সাউন্ড মিউট করে রাখতাম। রেডিওতে কমেন্ট্রি দিচ্ছেন শাহজাহান ভাই। শাহজাহান ভাইয়ের কমেন্ট্রির আকর্ষণ ছিল দুর্বার। তিনি বলের গতিতে কমেন্ট্রি করতে করতে গোলপোস্টে বল ঢুকিয়ে দিতেন। রেডিওতে ভয়েজের মাধ্যমে যে ডায়নামিজম আনা যায় সেটা ভিজুয়াল মিডিয়ায় সম্ভব না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রেডিও ভীষণ জনপ্রিয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জাতীয় ভাষণ টেলিভিশনে না দিয়ে রেডিওতে দেন, পরে সেটা টেলিভিশনে যায়। সারা বিশ্বেই শ্রোতারা টেরিস্ট্রিয়াল রেডিও বেশি শোনে। অনেকটা সময় পার করে এসে রেডিও এখন যে পর্যায়ে আছে সেটা ব্যাপক জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার উলেখযোগ্য কারণ এফএম রেডিওর স্টাইল এবং পোর্টেবিলিটি। চলতে ফিরতে শ্রোতারা কানে হেডফোন লাগিয়ে সেলফোনে রেডিও শুনতে পাচ্ছে। এফএম কালচারটা খুবই সিম্পল। এখানে শ্রোতারা হৈচৈ, ফুর্তি এসব উপাদান পছন্দ করে। সিরিয়াস কিছু যেমন পলিটিক্যাল ডায়লগ, ইন্টেলেকচুয়াল কথাবার্তা এসব শুনতে চায় না। শ্রোতারা ভাল গান শুনতে চায়, ভাল কথা শুনতে চায়, তারা আনন্দ চায়। গতবছরের চেয়ে এবছর রেডিও লিসেনারের সংখ্যা ২৪% বেড়ে গেছে। কারণ বড় অদ্ভুত! কারণটা হল ট্রাফিক জ্যাম। একটা লোককে যখন চার থেকে ছয় ঘন্টা রাস্তায় কাটাতে হয় তখন সে কি করবে? ডিজিটাল রেভ্যুলশন আসার পরে মানুষ বিভিন্ন মাধ্যম ঘুরে তার চয়েস স্থির করছে। সেখানে উলেখযোগ্য মাধ্যম হিসেবে এফএম রেডিওর অবস্থান।
মাকসুদুল হক: বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর শতকরা কতজন তরুণ? ৬০%। ঠিক এফএম রেডিওর শ্রোতার হিসেবও তাই। ৬০% তরুন শ্রোতা। ঢাকা এফএম ফ্যামিলি অরিয়েন্টেড স্টেশন। সপ্তাহের প্রতিদিনই আমাদের স্পেসিফিক কিছু কিছু অনুষ্ঠান আছে যেগুলো আমরা সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য করি। আমাদের স্টেশন বিভিন্ন ধরণের সামাজিক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করছে। সাতরং নামে গৃহিনীদের জন্যেও একটি অনুষ্ঠান আছে। সেখানে নানা ধরণের প্রয়োজনীয় টিপস্ থাকে। ঢাকা এফএমর প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানই মেসেজ অরিয়েন্টেড। আমরা শ্রোতাদের নিয়ে স্টাডি করি। পুরনো দিনের গান থেকে শুরু করে আনপ্লাগড গানেরও প্রচুর চাহিদা আছে শ্রোতাদের মাঝে।
এফএম রেডিও সেটাই করছে
আনন্দ আলো: এফএম রেডিও আসার পর শ্রোতাগোষ্ঠীর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনটা কিভাবে দেখছেন?
জাহিদ বাবুল: বেতারের ভূমিকা যে অসাধারণ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। হয়ত বিভিন্ন ধরণের মিডিয়ার ভীড়ে বেতারের অবস্থান কিছুটা অবদমিত ছিল কিন্তু তাই বলে গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়নি। প্রাইভেট এফএম সেই গ্রহণযোগ্যতার জায়গাটা আরো খানিকটা প্রতিষ্ঠা করেছে। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। শ্রোতার কথা যদি কেউ বলে দেয়, শ্রোতার সাথে তাৎক্ষণিক সংযোগ রক্ষা করে তাহলে শ্রোতা তাকে অবশ্যই শুনবে এবং খুব কাছের মনে করবে। এফএম রেডিও সেটাই করছে- শ্রোতাদের কথা বলছে, তাদের চাহিদা বিবেচনা করছে, সবসময় কানেক্ট থাকছে।
আনন্দ আলো: মূলত তরুণরাই এফএম রেডিওর শ্রোতা। পরিবারের সবাইকে রেডিওমুখি করার কি কোন উদ্যোগ নিয়েছে রেডিও টুডে।
আনন্দ আলো: ভবিষ্যতে শ্রোতা বৃদ্ধির জন্য কি ধরণের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
জাহিদ বাবুল: বিভিন্ন পণ্যের বিক্রি বাড়াতে বাজারে একটার সাথে আরেকটা ফ্রি দেয়ার রীতি আছে। শ্রোতাদের সন্তুষ্ট করতে আমরা সেই রীতিতে চলি না। তবে শ্রোতাদের পছন্দের কথা মাথায় রেখে অনুষ্ঠান ডিজাইন করি। খুব তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান পরিবর্তন করি না, শ্রোতাদের পরামর্শক্রমে অনুষ্ঠানের পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে থাকি। রেডিও টুডে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে গবেষণা করছে। সামনে আরো চমৎকার সব অনুষ্ঠানের সাথে শ্রোতারা পরিচিত হবে।
এখন শুধুই এগিয়ে যাবার পালা
আনন্দ আলো: এফএম রেডিও আসার পর শ্রোতাগোষ্ঠীর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনটা কিভাবে দেখছেন?
শ্রিয়া সর্বজয়া: সময়টা ভীষণ দৌঁড়াচ্ছে। দেশ, জাতি একটা পরিবর্তিত সময়ের মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় রেডিও এখন যে জায়গায় আছে তাতে করে শুধু সামনে এগিয়েই যাবে। রেডিও এমন একটা মাধ্যম যেটা সবসময় শ্রোতার নিঃসঙ্গতার সাথি হয়ে থাকতে পারে। একটা মানুষ যখন কলেজ, ইউনিভার্সিটি কিংবা অফিসে যাচ্ছে তখন সে রেডিও শুনছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এক বাসায় একটা টিভির প্রচলন। আর বিনোদন একেকজনের কাছে একেক রকম। এক টিভি একই সময়ে সেটা মেটাতে অক্ষম। সুতরাং সারাদিন পর বাসায় ফিরে বেশিরভাগ মানুষ বিনোদনের উৎস হিসেবে রেডিওর শরনাপন্ন হচ্ছে। যেহেতু রেডিও তাদের হাতের মুঠোয়। রাতের বেলাও শ্রোতা রেডিওর শো শুনছে। এফএম রেডিওতে সুবিধা হল একজন শ্রোতা আরজে থেকে শুরু করে অন্যান্য শ্রোতাদের সাথেও সরাসরি সংযুক্ত থাকতে পারছে। রেডিও তখন সেই শ্রোতার কাছে বন্ধুর ভূমিকা পালন করছে। এই যে রেডিও মাধ্যমের পরিবর্তিত পটভূমি সেটা আগামিতে আরো নতুন নতুন বিষয় বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হবে।
আনন্দ আলো: মূলত তরুণরাই এফএম রেডিওর শ্রোতা। পরিবারের সবাইকে রেডিওমুখি করার কি কোন উদ্যোগ নিয়েছে রেডিও স্বাধীন।
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে রেডিও একটা শক্ত অবস্থান নিবে
আনন্দ আলো: এফএম রেডিও আসার পর শ্রোতাগোষ্ঠীর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনটা কিভাবে দেখছেন?
শামস্ সুমন: বাংলাদেশে অনেকগুলো প্রাইভেট রেডিও স্টেশন হয়েছে। সবগুলো রেডিও স্টেশনেরই কিছু নির্দিষ্ট শ্রোতাগোষ্ঠী আছে। সব শ্রোতাকে একত্রিত করলে হিসেবটা কিন্তু বেশ বড় রকমের। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যে টিভি চ্যানেলগুলো আমরা দেখার সুযোগ পাচ্ছি সবগুলোই একই ধরণের অনুষ্ঠান প্রচার করছে, সিনেমাও তাই। কোন চ্যানেলেরই কোন স্বকিয়তা নেই। চ্যানেলগুলো কি দেখাতে পারে সে ব্যাপারে দর্শকের মাইন্ড সেটআপ হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা জিনিস মানুষের কাছে এখন প্রিসাইজ। একমাত্র রেডিও পারে নতুন বিষয়বস্তু একেবারে ভিন্নতর আঙ্গিকে শ্রোতার সামনে তুলে ধরতে। টিভি দেখার জন্য টেলিভিশনের সামনে বসে থাকতে হয়, তাকিয়ে থাকতে হয়। এত সময় আছে কারো! রেডিও মাধ্যমে বিনোদিত হওয়ার জন্য স্থির হয়ে বসার প্রয়োজন পড়ে না। এসব অনেক কারণেই রেডিও জনপ্রিয়। অনেকেই ভাবছেন রেডিওর থ্রেট অনলাইন মাধ্যম, সোশ্যাল মাধ্যম ইত্যাদি। আমার মনে হয়েছে অনলাইন কিংবা সোশ্যাল মাধ্যমকে সাথে নিয়ে যদি রেডিও সামনের দিকে হাঁটতে পারে তাহলে এটা কারো জন্যেই কারো থ্রেট না। দুই মাধ্যম একে অপরের পরিপূরক হতে পারে। এটাই বর্তমান বাস্তবতা। শ্রোতারা এখন অনলাইনে রেডিও শুনতে পাচ্ছে। রেডিও পরিচালনার ব্যয়ভার টেলিভিশনের চেয়ে অনেক অনেকগুণ কম। আশা করতে পারি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে রেডিও খুব শক্ত একটা অবস্থান করে নেবে।
আনন্দ আলো: মূলত তরুণরাই এফএম রেডিওর শ্রোতা। পরিবারের সবাইকে রেডিওমুখি করার কি কোন উদ্যোগ নিয়েছে রেডিও ভূমি।
শামস্ সুমন: মাসখানেক আগে দেশের বিশিষ্ট লেখক ইমদাদুল হক মিলন রেডিও ভূমিতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন। সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। রেডিও ভূমি থেকে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আজকে এই যে বর্ষার রুপ দেখছেন, আপনার শৈশবে বর্ষার রুপ কেমন ছিল ? ইমদাদুল হক মিলন বিক্রমপুরের অধিবাসী। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। তিনি তাঁর শৈশবের বৃষ্টির চিত্রকল্প বর্ণনা করছিলেন। তিনি বৃষ্টিতে ভেজার কথা বললেন, মাছ ধরার কথা বললেন, বর্ষায় মাছ ধরার অনেকগুলো কৌশল আছে, তিনি সেই কৌশলগুলো বর্ণনা করছেন ঠিক তখনই রেডিও ভূমিতে একটা এসএমএস আসে। এসএমএসটি করেছেন লেখকের বয়সীই একজন মানুষ, গ্রামের বাড়ি লেখকের বাড়ির ঠিক দুই গ্রাম পরে। বিল খালের গল্প শুনে সেদিন তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে এসএমএসটি করেছেন। তার মানে আমি বলতে চাচ্ছি পঞ্চাশোর্ধ মানুষও কিন্তু রেডিও শুনছেন।
শামস্ সুমন: রেডিও ভূমির শ্রোতার ভেরিয়েশন আছে। একটিভ শ্রোতা ও প্যাসিভ শ্রোতা। প্যাসিভ হচ্ছে যারা শুধু ক্রিকেটের সময় রেডিও ভূমির সাথে থাকে। তবে খেলার মাঝখানে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা এবং বাংলা গানের জন্য এই প্যাসিভ শ্রেণী থেকেও আমরা একটি নিয়মিত শ্রোতা সৃষ্টি করতে পেরেছি। সপ্তাহের ছয়দিনই আমাদের স্টেশনে খেলা বিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। সেখানে সেই প্যাসিভ শ্রোতারা আমাদের শোনেন, অংশগ্রহণ করেন। ধারাভাষ্যের জনক বাংলাদেশ বেতার। ১৯৬৮ সালের ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ বেতার প্রথম খেলার ধারাভাষ্য প্রচার করে। ২০১২ পর্যন্ত একমাত্র বেতারই ধারাভাষ্য প্রচার করে গেছে। রেডিও ভূমির আগে বেসরকারি কোন রেডিও ধারাভাষ্য প্রচার করেনি তবে মাঝখানে পিপলস্ রেডিও বিপিএল নিয়ে ধারাভাষ্যের চিন্তা করেছিল কিন্তু এগোতে পারেনি। ২০১৩ সালের শুরুর দিক থেকে রেডিও ভূমি ধারাভাষ্য শুরু করে। ধারাভাষ্য প্রচারের ক্ষেত্রে রেডিও ভূমির মোটো হচ্ছে বাংলাদেশ যখন খেলবে তখন ধারাভাষ্য অবশ্যই বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার করতে হবে, আর বাংলাদেশের বাইরের দুটো দেশ যখন খেলবে তখন আমাদের স্টেশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে।