সহজে তারকা হওয়া যায় না-চঞ্চল চৌধুরী

বহুমাত্রিক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তার খ্যাতি বেশ। একটি চরিত্র থেকে আরেকটি চরিত্রে নিজেকে উপস্থাপন করার ক্ষমতাও রয়েছে এই গুণী অভিনেতার। ক্যারিয়ারে যে কটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তার প্রত্যেকটিই দর্শক নন্দিত হয়েছে। বক্স অফিসে অন্যরকম এক আলোড়নও সৃষ্টি করেছে। পাঠক, নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন এই অভিনেতা কে হতে পারেন? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন- তিনি চঞ্চল চৌধুরী। বাংলা চলচ্চিত্রে কয়েক দশকে যে তিনটি সিনেমার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে মানে ‘মনপুরা, ‘মনের মানুষ’ ও ‘আয়নাবাজি’- এই তিনটি ছবিরই সফল অভিনেতা তিনি। তাই তো বলা হয়ে থাকে- যেই সময়ে দর্শক একেবারেই সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ঠিক সেই সময়ে তার অভিনীত ছবি দিয়ে আবারো দর্শকদের হলমুখী করা গেছে। টিভি পর্দায়ও চঞ্চলের রয়েছে বেশ জনপ্রিয়তা। নাটকে অভিনয় করছেন নিয়মিত। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় চরিত্র হিমু ও  মিসির আলী চরিত্রেও অভিনয় করছেন। লেখকের দেবী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হচ্ছে ছবি দেবী। অভিনয়ের এই যে বহুমাত্রিকতা, নিজেকে ভেঙে নতুন করে প্রতিনিয়ত ছুটে চলা- এমন বিষয় সহ ক্যারিয়ারের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন চঞ্চল চৌধুরী। লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল।

আনন্দ আলো: এই যে অভিনয়ে আপনি নিজেকে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে উপস্থাপন করছেন, এ ব্যাপারে আপনার প্রস্তুতির জায়গাটা কেমন থাকে?

চঞ্চল চৌধুরী: সবকিছুর আগে আমি নিজে একজন অভিনেতা। আমার কাজ হচ্ছে অভিনয় করা। তাই একটি চরিত্র হাতে পেলেই আগে সেটির সঙ্গে আমি মানান সই কি না তা নিয়ে চিন্তা করি। তারপর অভিনয় করবো কি না সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেই। আমার কাছে অভিনয় এবং দর্শক দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। অভিনয় তো আর নয়টা-পাঁচটা ডিউটির মতো না। এটি সৃজনশীল কাজ। যদিও এখন বেশিরভাগ কাজ হচ্ছে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। ভালো কাজের থেকে ব্যবসায়িক দিকে সবার নজর থাকে বেশি। তারপরও আমি চেষ্টা করি নিজের সবটুকু দিয়ে কাজটা করতে। একটা চরিত্র নিয়ে যখন কোনো নির্মাতা আমার কাছে আসে তখন আমি কিছু সময় নেই। আগে সেই চরিত্রে নিজেকে বারবার দাঁড় করাই, তারপর সিদ্ধান্ত নেই কাজটা করার। তারপরও আমি কিছু অ্যাভারেজ চরিত্রে যে কাজ করিনি তা নয়। অবশ্যই করেছি। তবে ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের সংখ্যাই বেশি। এই চরিত্রগুলোতে কাজ করার সময় নিজেকে প্রস্তুত করেছি অন্যভাবে। যদি আয়নাবাজির আয়নালের কথাই বলা হয় তাহলে বলবো- এটার জন্য অমিতাভ রেজা আমাকে অনেক সময় দিয়ে তৈরি করেছেন। আর আমি যা করেছি সেটা হলো চরিত্রটিকে ধারণ করেছি। আমি চারপাশে ছড়িয়ে থাকা চরিত্রগুলো নিয়ে ভেবেছি, দেখেছি এবং শেষমেশ নিজেকে তুলে ধরেছি। আর এখন যেমন- মিসির আলী চরিত্রটি নিয়ে বেশ পড়াশোনা করতে হচ্ছে। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দেবী উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। যেখানে আমি মিসির আলী চরিত্রে অভিনয় করছি। এই চরিত্রটি লেখকের অনবদ্য সৃষ্টি। তাঁর অনেক গল্প-উপন্যাসে মিসির আলীর কথা এসেছে। সেখান থেকে প্রায় প্রতিটি গল্প পড়ে চরিত্রটি বোঝার চেষ্টা করছি আমি।

আনন্দ আলো: আপনার কী মনে হয়- সৃজনশীল চিন্তা থেকে এখন সব কাজ হচ্ছে?

চঞ্চল চৌধুরী: সব যে হচ্ছে আমি সেটা বলবো না। আবার একেবারেই যে হচ্ছে না সেটাও ঠিক নয়। তবে এটা সত্যি সৃজনশীল কাজ এখন খুব কম হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেক সাধনার প্রয়োজন। সেটা অভিনেতা-নির্মাতা এবং লেখক সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনেক শেখার বিষয় রয়েছে। এখন বেশিরভাগ শিল্পীই চায় সহজে তারকা হতে। এখনকার শিল্পীদের মধ্যে শেখার মানসিকতাটা খুব কম। যার কারণে কাজের মান নি¤œগামী হচ্ছে। ভালো গল্প আর চিত্রনাট্যে সেভাবে কাজ হচ্ছে না। যা হচ্ছে টুকটাক। অন্যদিকে আমাদের দেশে অনেক ভালো পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, শিল্পী রয়েছেন। কিন্তু একটি ভালো কাজের জন্য যে বিষয়গুলোর যোগান দেয়া প্রয়োজন, সে বিষয়গুলো নেই। এখন তো প্রতি মাসেই সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু এর বাণিজ্যিক বাজার কতটুকু? কতটুকু বাণিজ্যিক দিক থেকে সফল হচ্ছে? আমরা  কি চিন্তা করেছি সব ধরনের মানুষের জন্য চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করব। আমি ভাবি আমার অভিনীত চলচ্চিত্রটির গল্পটি যেন সবার জন্য হয়। এই চিন্তাটি সবার থাকতে হবে। আমি আমার জায়গা থেকে ভালো চিত্রনাট্য, পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করি। এ বিষয়টিতে সবার নজর থাকতে হবে। সবাই সচেতন হলে ভালো কাজ করা সম্ভব। সবাই বলেন আমি ভালো কাজ করতে চাই। কিন্তু ভালো একটি কাজ করার জন্য যা যা দরকার সেটি কি আমরা করছি? বর্তমানে অনেক নাটক হচ্ছে। কিন্তু হাতে গোনার মতো নাটকের সংখ্যা কম। আমি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও শুধু ‘আয়নাবাজি’ ছবিটির জন্য অন্যকোনো কাজ তখন করিনি। অনেক নাটকে প্রস্তাব পেয়েও করিনি। কিন্তু তখন আমি খুব অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থায় ছিলাম। আমার জানামতে, পরিচালক অমিতাভ রেজাও সেসময় কোনো কাজ করেননি। কাজের প্রতি এই যে নিজেকে তৈরি করা, একাগ্রতা এবং একনিষ্ঠভাব- এটা সবার মধ্যে থাকতে হবে। তবেই সত্যিকারের ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবে।

আনন্দ আলো: বর্তমানে কী কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন?

চঞ্চল চৌধুরী: কোরবানি ঈদেও বেশকিছু নাটকের শুটিং নিয়ে ব্যস্ততা রয়েছে। কিছু খÐ নাটক ও টেলিফিল্মের কাজ করছি। আর কিছুদিন আগ পর্যন্ত দেবী সিনেমার শুটিং নিয়ে ব্যস্ততা ছিল। আপাতত দেবী সিনেমার শুটিং শেষ। এখন চলছে ছবিটির পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ।

আনন্দ আলো: ‘দেবী’ সিনেমাটি নিয়ে বলুন-

চঞ্চল চৌধুরী: এই সিনেমাটি আমার জীবনের আরেকটি অন্যতম কাজ। দর্শকরা তা দেখলেই বুঝতে পারবেন। এই চরিত্রটি করতে গিয়ে আমাকে অনেকগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হয়েছে। এই চরিত্রে আমার অভিনয়ের আগে চিন্তা ছিল- মিসির আলীর চেহারা বা অবয়বটা কেমন! ভক্তরা কীভাবে মিসির আলীকে দেখেন, ভাবেন। সেটা যেন ঠিক থাকে। আরেকটি বিষয় ছিল- দর্শকদের চাওয়ার সঙ্গে অভিনয়ের সংযোগটা ঠিক রাখা এবং সর্বশেষ গুণী সাহিত্যিক ও নন্দিত নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের তৈরি করা চরিত্রের বিষয়টি মাথায় রাখা। তাই নিজের সেরাটা দিয়ে অভিনয় করেছি দেবী ছবিতে। আর যারা হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলী পড়েছেন কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয় জানেন, তাদের মধ্যে একটা মিসির আলী বাস করেন। সেটিও মাথায় রেখে অভিনয় করেছি। এই ছবিটি নিয়ে আমি শুধু বলবো- এমন গেটআপে কেউ কখনও আমাকে দেখেনি। যখন ফার্স্টলুক কিংবা প্রমোশনাল বিষয়গুলো দেখানো হবে তখন বোঝা যাবে। চলচ্চিত্রটির শুরুতেই মিসির আলীর যে অ্যাপিয়ারেন্সটা আছে সেটিই দর্শকদের চমকে দেয়ার মতো। দর্শকরা সিনেমাটি দেখার পর যাতে বলতে পারেন- একজন শিল্পী কাজটি অনেক কষ্ট করেই করেছেন।  সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন অনম বিশ্বাস। আর প্রযোজনা করেছেন জয়া আহসান। এই ছবির প্রযোজকও কিন্তু জয়া আহসান নিজে। এতে আরো অভিনয় করেছেন অনিমেষ আইচ, ইরেশ যাকের ও শবনম ফারিয়া প্রমুখ।

আনন্দ আলো: আপনাকে দর্শক অনেক নাটকে হাসির চরিত্রেও দেখেছেন। আবার চলচ্চিত্র কিংবা অনেক নাটক-টেলিফিল্মে অনেক সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নিজেকে আসলে কোন চরিত্রে দেখতে বেশি ভালো লাগে?

চঞ্চল চৌধুরী: দেখুন, একজন অভিনেতার সব ধরনের চরিত্রে কাজ করার শক্তি থাকাটা জরুরি। আমি নিজেকে প্রতিনিয়ত  যাচাই বাছাই করতে পছন্দ করি। একসময় আমাকে বলা হতো- গ্রামের নাটকে অভিনয় করা শিল্পী। আমি কী শহুরে জীবনের নাটক করিনি? করেছি এবং এখনো গ্রাম ও শহর- দুই জীবনের চরিত্রেই কাজ করছি। আবার অনেকেই আমাকে কমেডি অভিনেতাও বলেছে। আমি আসলে এত কথা কিংবা এত ভেদাভেদে বিশ্বাসী না। আমি বিশ্বাস করি চরিত্র। যেহেতু আমি একজন অভিনেতা তাই আমার কাজটি হলো নিজের পছন্দ এবং নিজের সঙ্গে যায় এমন চরিত্র পেলেই সেটাতে অভিনয় করা। আমি সেটাই করার চেষ্টা করি।

আনন্দ আলো: ব্যক্তি জীবনের চঞ্চল আর অভিনেতা চঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পান?

চঞ্চল চৌধুরী: আমি যখন একটি চরিত্র নিয়ে ভাববার পর শুটিং শেষ করে বাসায় চলে যাই- তখন একেবারেই আমি একজন স্বামী, একজন পিতা হয়ে যাই। ব্যক্তি জীবনে আমি ঘুমাই বেশি। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে সিরিয়াস থাকি। ১৭ বছরের অভিনয় জীবনের প্রথম দিন যেমন সিরিয়াস ছিলাম আজও আছি। তবে বাস্তবে অনেক রিল্যাক্স থাকি।

আনন্দ আলো: আপনি যদি অভিনেতা না হতেন, তাহলে কী হতেন?

চঞ্চল চৌধুরী: যেহেতু আমি চারুকলায় পড়াশোনা করেছি তাই শিল্পকলা রিলেটেড কিছুই করতাম হয়তো। আমি কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছি। অথবা গান বাজনা করতাম। যদিও এ বিষয়ে আমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কী হতাম সেটা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে আমার তো মনে হয়- আমি অভিনেতা হওয়ার জন্যই এই পৃথিবীতে আসা। আমি আমার গন্তব্যেই হাঁটছি।

আনন্দ আলো: গান নিয়ে ব্যস্ততা কেমন?

চঞ্চল চৌধুরী: আসলে গানটা আমার একেবারেই শখের বসে করা। ভালো লাগে তাই গান করা। আমি নিজেকে শিল্পী ভাবি না। গানের মাধ্যমে দর্শকদের মুগ্ধ করতে পারবো তাও ভাবি না। আমি আসলে শুনে শুনে গান করি। পুরনো দিনের গান আমি সবসময় শুনি। গান নিয়ে আমার শখ ছিল, স্বপ্ন নয়। তাই এটা নিয়ে তেমন কোনো ব্যস্ততাও নেই।

আনন্দ আলো: এত ব্যস্ততার মধ্যে পরিবারে সময় দেয়া হয়?

চঞ্চল চৌধুরী: অবশ্যই। আমি সবসময় চেষ্টা করি পরিবারকে সময় দিতে। আমি বেশি রাত পর্যন্ত কাজ করি না। কিন্তু ডিরেক্টর ঝামেলায় পড়লে সেটা আলাদা কথা। আর ঢাকার বাইরে থাকলে তখন পরিবারে কম সময় দেয়া হয়। আমার একটি পুত্র সন্তান আছে, নাম শৈশব রুদ্র শুদ্ধ। আমার স্ত্রীর নাম শান্তা। তিনি একজন ডাক্তার এবং একটি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষিকা। আমার শুটিংয়ের ব্যস্ততা না থাকলে এরাই আমার সব। তাদের নিয়েই আমার যত ব্যস্ততা।

আনন্দ আলো: অনেক অভিনেতাই তো এখন পরিচালনা করছেন। আপনার তেমন ইচ্ছা আছে?

চঞ্চল চৌধুরী: না। আমি মূলত অভিনয়কে ভালোবাসি। পরিচালকের দায়িত্ব অনেক। শখের বসে যদি কখনো পরিচালনা করি তা আলাদা ব্যাপার, তবে আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। আমার কাছে মনে হয়- এখনো আমার অভিনেতা হিসেবে দর্শকদের অনেককিছু দেয়ার আছে। অনেক চরিত্র নিয়ে আমার খেলার ইচ্ছা আছে। সত্যি কথা বলতে কী- এই অভিনয়টা নিয়েই থাকতে চাই। দর্শকদের আরো ভালো ভালো কাজ উপহার দিতে চাই। যা দিয়ে তাদের মাঝে বেঁচে থাকবো সারাজীবন।

আনন্দ আলো: ক্যারিয়ারের এই পর্যন্ত আপনার যে অভিনয় জীবন- তা নিয়ে আপনি কতটা সন্তুষ্ট?

চঞ্চল চৌধুরী: একজন অভিনয়শিল্পীর ক্ষুধা কখনোই মিটে না। এটা অনেক সিনিয়র অভিনয়শিল্পীও বলতে পারবে না যে, তিনি তাঁর অভিনয়ে সন্তুষ্ট কি না। সুযোগ পেলেই একজন অভিনেতা বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে চায়। আমিও সুযোগ পাওয়ার ভিত্তিতে আরো বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দর্শকদের সন্তুষ্ট রাখতে চাই। আর তাতেই হয়তো আমি আমার অভিনয় জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকব। কি জানি এটা নিয়ে বলা আসলে বেশ মুশকিল!

আনন্দ আলো: নিজের কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে কী?

চঞ্চল চৌধুরী: আপাতত অভিনয়ের বাইরে আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন সব চরিত্রে দেখতে চাই প্রতিনিয়ত। হিরো নয়, বরং আমি একজন অভিনেতা হিসেবে সকলের ভালোবাসা পেয়ে এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে চাই।

  • এক্সক্লুসিভ
Comments (০)
Add Comment