মঞ্চে আলো ছড়ালো সুরগাঁও

সুজন হায়দার: নাটক শুরু হওয়ার কথা সন্ধ্যে সাড়ে ৬টায়। কিন্তু তার আগেই মিলনায়তন ভরে গেল। শিল্পকলা একাডেমির মূল মিলনায়তন মাসুম রেজার রচনা ও পরিচালনায় ‘সুরগাঁও’ নামে একটি নতুন মঞ্চ নাটক দেখার জন্য দর্শকের এত ভিড়। আসন খালি নেই। তাই পেছনে দাঁড়িয়ে গেলেন প্রায় শ খানেক দর্শক। শিল্পকলার জাতীয় নাট্যশালার উপরে নীচে বসা প্রায় ৮শ দশকের উপস্থিতিতে শুরু হলো ‘সুরগাঁও’-এর প্রথম বাণিজ্যিক মঞ্চায়ন।

গোটা মিলনায়তন জুড়ে সুনসান নীরবতা। ‘সুরগাঁও’ আসলে কোন গ্রাম? কোন জনপদ? সেখানকার মানুষগুলোই বা কেমন? তাই নিয়ে দর্শককের বিপুল আগ্রহ। তাই কেউ কোনো কথা বলছেন না। মঞ্চে কী ঘটতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য সকলে উম্মুখ।

নাটকের শুরুতেই জাদুবাস্তবতায় পরিবেশ হয়ে উঠলো অন্যরকম।

আসমান ফকির হাতের মুদ্রায়আবিষ্ট করেন দর্শকদের। তিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান। সুরগাঁওয়ে পত্তনকারী আনাল ফকির একশ আশি বছর আগে এক রাতে গ্রাম থেকে উধাও হয়েছেন। তিনি ফিরে আসছেন সুরগাঁওয়ে। সময়ে বিপরীতে একশ আশি বছর আনাল ফকির প্রত্নকাল ভ্রমণ করেছেন। কালের গর্ভ থেকে নিয়ে এসেছেন মূল্যবান সব সামগ্রী। স্যার টমাস মুরের নিজের হাতে লেখা কাগজ। ষোলো শতকের স্মারক। সক্রেটিসকে যে পানপাত্রে হেমলক পান করানো হয়েছিল সেই পাত্র। আমাদের মনে হায়এ বুঝি অতীত কথা। পুরোনো গল্প। অতীত ঠাঁই নেয়া বর্তমানে। অতীত আর বর্তমান গিয়ে মেশে ভবিষ্যতে।

আমরা নিটল গল্পের ঠাস বুনন দেখি মঞ্চে। আলোড়িত হই। আনন্দিত হই। আনন্দের ভাঁজে ভাঁজে থাকে চিন্তা। গভীর ভাবনা। তাতে আনন্দের রস এতটুকু ম্লান হায়না। সুরগাঁও আনন্দের গল্প আর গভীর দর্শনের ভাবনা নিয়ে অসামান্য শিল্পে পরিণত হায় মানুষ যা যুক্তি দিয়ে বোঝে, সেই যুক্তির ওপর ভর করে আগামীর স্বপ্ন দেখে। তার আছে অতীত অভিজ্ঞতা। সুরগাঁও-এ যা ঘটে, তা কেবল সুরগাঁও গ্রামের ঘটনা থাকে না। সেই ঘটনা মিলে যায় বৈশ্বিক রাষ্ট্রনীতি আর সমরনীতির সঙ্গে। যুদ্ধ সব সময় মানবতাকে ধ্বংস করে। সুরগাঁও যুদ্ধের বিপক্ষে  বাঁশিবুড়ি দাঁড়ায় বাঁশির সুরে মানুষের ভাবশুদ্ধি ঘটায় পঙ্কিল মনের মানুষ শুদ্ধ হায় নাটক যেমন শুরু হায় মোহ দিয়ে পরিক্রমা করে গভীর দর্শন। শেষ হায় মানবতার পক্ষে ভালোবাসা দিয়ে নাটকে দৃশ্যপট বদলায়, মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায় কিন্তু নির্দেশক দর্শকের মনোযোগ অন্যত্র সরাতে দেন না। আঁধারে শেষ সংলাপ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

অনেকে বলেন, মঞ্চে দর্শক কমে গেছে। কিন্তু ‘সুরগাঁও’ এর প্রথম মঞ্চায়নের দিন তা একবারও মনে হয়নি। সুরগাঁও’-এর প্রযোজনা সংগঠন দেশ নাটক সূত্রে জানা গেছে প্রথম দিন প্রায় শ দেড়েক দর্শক সুরগাঁও-এর টিকেট না পেয়ে ফিরে গেছে। তার মানে যারা বলেন, মঞ্চো দর্শক নাই তার, কী ভুল বলেন? নাকি তারা বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চান না।

সুরগাঁও কেন দেখতে এসেছিল দর্শক? উত্তরে বলা যায়ণ্ড সুরগাঁও ঢাকার মঞ্চে নতুন নাটক। এর রচয়িতা ও নির্দেশক টিভি নাটকের জনপ্রিয় নাট্যকার। কাজেই টিভির মানুষ মঞ্চে কি করলেন বোধকরি তা দেখার আগ্রহ নিয়েই অনেক দর্শক হয়তো এসেছিলেন। তবে মাসুম রেজার এই নাটক দেখে দর্শক হতাশ হননি। প্রথম মঞ্চায়নের দিন কয়েকজন দর্শকের মতামত গ্রহণ করেছে আনন্দ আলো। সবার অভিন্ন মন্তব্যণ্ড সুরগাঁও দেখে ভালো লেগেছে। নাটকের কাহিনি, পাত্র-পাত্রীদের অভিনয়সহ নাটকটির সার্বিক উপস্থাপন ভঙ্গি সবার মনোযোগ কেড়েছে। একজন দর্শক বললেনণ্ড আমাদের জীবন-মান, ব্যস্ততা, পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন ঘটলেও অধিকাংশ দলের মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে সেটার প্রতিফলন দেখা যায় না। কী চলচ্চিত্র, কী নাটক সবখানেই দর্শক চায় নতুন কিছু দেখতে। সুরগাঁও দর্শকের এই চাহিদা মোটামুটি পূরন করেছে। তিনি বলেন, আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে অনেকে হতাশা প্রকাশ করেন। অথচ ‘আয়নাবাজি’ নামের একটি নতুন চলচ্চিত্র রীতিমত আলোড়ন তুলেছে। এর কারণ কী? কারণ হলো আয়নাবাজিতে একটি আকর্ষণীয় গল্প আছে। নির্মাণ শৈলীতে নতুনত্ব আছে। যে কারণে দর্শক ‘আয়নাবাজিকে’ গ্রহণ করেছে। সুরগাঁও’-এর ক্ষেত্রেও একই মন্তব্য করা যায়।

আনন্দ আলোর পক্ষ থেকে সুরগাঁও’-এর প্রতি অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। মঞ্চ নাটকের জয় হোক।

  • প্রতিবেদন
Comments (০)
Add Comment