জাকীর হাসান: মানিকগঞ্জ থেকে শুটিং করে ঢাকায় ফিরছিলেন চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। আছর নামাজের ওয়াক্ত হওয়ায় রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করে নামাজ পড়ে সালাম ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখেন বেশ ক’জন বয়স্ক কৃষক হাতের কাজ ফেলে তারপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। হাসি, মুখে কুশল বিনিময় করলেন এই বরেণ্য অভিনেতা এমন সময় চল্লিশোর্ধ্ব এক কৃষক সদর্পণে এসে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন অভিনেতাকে এবং হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। এটিএম শামসুজ্জামান কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরে ক্রেজী সেই ভক্তের সঙ্গে কথা বলে এটিএম শামসুজ্জামান জানতে পারেন, লোকটি তার একনিষ্ঠ পাগল ভক্ত। তার অভিনীত সিনেমা ছাড়া অন্য কারো সিনেমা দেখেন না। তার বহুদিনের শখ একদিন খুব কাছ থেকে প্রিয় অভিনেতাকে দেখবেন, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখবেন। সেই প্রত্যাশা পূরণ যখন হলো- তখন নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি ভক্ত। কি করতে কি করবেন এই ভাবনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। শুধু সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তারকারাই নন খেলার মাঠের তারকারাও এই ফিচারের মূল পতিপাদ্য বিষয়। সাম্প্রতিক আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার ক্রিকেট সিরিজের শেষ ওয়ান ডে ম্যাচের সময় মাঠে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশ অধিনায়ককে জড়িয়ে ধরে এক মাশরাফি পাগল ভক্ত। তারপর সেই ভক্তকে পাকড়াও করা হয়। তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য টেনে হিঁচড়ে বাইরে নেয়ার চেষ্টা করা হলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের গর্বিত অধিনায়ক ১৬ কোটি মানুষের প্রাণভ্রমরা মাশরাফি বাধা দেন। বলেন, এই ভক্তের কোনো ক্ষতি যেন না করা হয়। তখন আফগানিস্তান ৭ উইকেটে করেছে ১০২ রান। জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ৩ উইকেট। এই পরিস্থিতিতে একজন অধিনায়ক মহা টেনশনে থাকেন। কিন্তু অধিনায়কটি যে মাশরাফি। শ্রান্ত হলেও তিনি শান্ত থাকেন, মহাদুর্যোগেও তিনি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তার স্থির থাকেন। ভক্ত মাঠে ঢোকার পরও তিনি তাই করলেন। তার মানবিক আচরণ এবং একজন কমপ্লিট স্পোর্টস স্টারের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করলেন। সারা পৃথিবীর বাঙালিরা এই দৃশ্য দেখে সবিনয়ে মাশরাফির প্রতি কুর্নিশ করলেন। এই মানুষটি শুধু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নয় বাংলার হাটে, মাঠে-ঘাটে, কৃষক-যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ-শিশু সবার আদর্শের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ভারতের মানুষের কাছে ক্রিকেট হচ্ছে ধর্ম আর শচীন টেন্ডুলকার হচ্ছে সেই ধর্মের দেবতা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্পোর্টস তারকাদের মধ্যে অন্যতম সেরা তিনি। বিশেষ করে তার মানবিক আচরণের জন্য। প্রতিপক্ষের বলে সত্যিকারের আউট হলে থার্ড আম্পায়ারের প্রয়োজন পড়তো না। মাথানত করে নিজে থেকেই প্যাভেলিয়নে ফিরে যেতেন।
শচীন টেন্ডুলকারের অনেক ভক্তের কথা আমরা জানি। ভক্তদের মধ্যে একজন মধ্যপ্রদেশের সুভাষ। মা তাকে একদিন বলেছিল বাবা মন্দিরে যাও পুজো দিয়ে আসো। ছেলে রেডি হয়ে একটি প্ল্যাকার্ড হাতে বেরিয়ে পড়লো। দুই ঘণ্টা পর মা টিভির খবরে জানতে পারল ছেলে একটি প্ল্যাকার্ডসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচে মাঠে প্রবেশের দায়ে। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে শচীন টেন্ডুলকারের অনুরোধে। আর ওই প্ল্যাকার্ডে ইংরেজিতে লেখা ছিল মা আমাকে মন্দিরে যেতে বলেছে দেবতার পুজো দিতে। আমি দেবতার পুজো দিয়ে গেলাম মা। এই ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল তখন।
তবে ক্রিকেটের চেয়ে পৃথিবীতে ফুটবল নিয়ে ভক্তদের পাগলামিটা বেশি হয়। বিশেষ করে ইংল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি ও ল্যাটিন আমেরিকায়। ভক্তরা যে শুধু তারকাদের সান্নিধ্য পেতে এবং আবেগে মাঠে প্রবেশ করে কাণ্ডকারখানা করে তাই নয়। যেমন- শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার কুশলের এক ভক্ত মাঠে ঢুকে পড়ে একটি ফ্ল্যাগ নিয়ে। কুশলের সঙ্গে মাঠে দাঁড়িয়ে কথিত তামিল রাষ্ট্রের পতাকা প্রদর্শন করছিল ভক্ত এবং তামিলদের প্রতিনিধি হিসেবে এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছিল।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর ফুটবল বিশ্বের সেরা তিন তারকা রিয়াল মাদ্রিদের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, বার্সেলোনার মেসি ও নেইমার।
রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে বার্সেলোনার খেলার সময় হঠাৎ রোনালদোর উপর চড়াও হয় এক বার্সেলোনার ভক্ত। তাকে মারতে উদ্যত হয়। পরে পুলিশ এসে ভক্ততে পাকড়াও করে নিয়ে যায়।
ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার মধ্যে বিশ্বকাপ (২০১৮) ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার আগের দিন অনুশীলন হচ্ছিল কলাম্বিয়ায়। কড়া নিরাপত্তায় অনুষ্ঠিত এই অনুশীলনে ব্রাজিল দলের সুপাস্টার নেইমারকে লক্ষ করে এক যুবক ধেয়ে আসে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নেইমার প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। ওদিকে ভক্তটিও তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে। এক সময় ভক্ত ধরে ফেলে নেইমারকে। নেইমার ভয়ে চিৎকার দেন। মুহূর্তে নিরাপত্তা রক্ষীরা ধরে ফেলে ভক্তকে। পরে ভক্তের কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন তিনি এমনটি করলেন। তার উত্তরে ভক্ত বলেন, আমি নেইমারের মহা ভক্ত, তাকে ভালোবাসি। তাকে দেখলে ঠিক থাকতে পারি না। তার সংস্পর্শে থাকতে চাই সব সময়।
পাগল বা ক্রেজী ভক্তদের পাল্লায় পড়ে খেলোয়াড়রা শুধু অবাকই হন না, অনেক সময় তাদের বিব্রতও হতে হয়। এই যেমন- আইভরিকোস্টের গার্ভিন হোর কথাই ধরা যাক। খেলার সময় মাঠে ঢুকে এক পাগল ভক্ত গার্ভিন হোকে ধরার জন্য দৌড় শুরু করে। ভক্তের ভয়ে তিনিও দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যান। পরে ভক্ত তার শর্টপ্যান্ট খুলে ফেলেন। এতে গার্ভিন প্রচণ্ড রেগে যান এবং নিরাপত্তা কর্মীদের এক হাত নেন।
ব্রাজিল ফুটবলের এক সময়কার সুপারস্টার ছিলেন রোনালদিনহো। বার্সোলানার এই মহাতারকা ব্রাজিলের হয়ে বহু ম্যাচ জয় করেছেন। ব্রাজিলের জার্সি গায়ে এই তারকা আর্জেন্টিনার সঙ্গে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে গোল করার পর এক ভক্ত মাঠে ঢুকে তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন এবং তার ভাই হতে চান। যতক্ষণ না ভাই হওয়ার সম্মতি দেন ততক্ষণ পা ছাড়বেন না বলে হুমকি দেন। অবশেষে রোনালদিনহো হাসি মুকে ভক্তকে ভাই হওয়ার সম্মতি দেন।
পক্ষ বিপক্ষ
আফগানিস্তানের সাথে শেষ ওয়ানডে ম্যাচে যখন টাইগারদের জয়ের পাল্লা ভারী হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ করে মিরপুর শের-এ বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অভূতপূর্ব এক ঘটনা ঘটে যা বাংলাদেশের খেলার ইতিহাসে প্রথম।
খেলার সময় হঠাৎ করেই মাশরাফি ভক্ত এক যুবক মাঠে ঢুকে পড়ে। টাইগার অধিনায়ক মাশরাফিকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী দৌড়ে এসে যুবককে ধরে শাস্তি দিকে চাইলে টাইগার ক্যাপ্টেন ভক্তের কোনো ক্ষতি যাতে না হয় সে ব্যাপারে নিরাপত্তা কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। পরবর্তীতে ওই যুবককে মিরপুর থানায় সোপর্দ করা হয়। পরের দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দেয়া হয়। এই নিয়ে পুরো বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব শ্রেনি পেশার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ বলেছেন নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ওই ক্রিকেট ভক্ত মাঠে ঢুকে পড়েছিল। সে নিছক একজন মাশরাফির ভক্ত, তাকে নিয়ে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অযথাই বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে এটা কোনো ঘটনাই নয়।
অনেকেই অন্যদিকে বলেছেন, মাঠে ঢুকে ওই ভক্ত খুবই অন্যায় করেছে। তার বিচার হওয়া প্রয়োজন। কারণ তার বিচার না হলে অন্য তরুণ ভক্তরাও এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে উৎসাহিত হবে। তাছাড়া ওই ভক্ত যদি কোনো বিস্ফোরক নিয়ে যেত, যদি মাশরাফিকে আঘাত করতো তাহলে পরিস্থিতি কি হতো? গুলশান, শোলাকিয়া, কল্যাণপুরে জঙ্গি হামলার পর এমনিতেই সারাবিশ্বে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই সময় ক্রিকেট মাঠের এ ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।