আইটেম সং বিতর্ক ছড়াচ্ছে

উপমহাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে অঙ্কের হিসেবের মতো কিছু বিষয় আছে। যেমন- প্রতিটি ছবিতে ৩ থেকে ৬টি গান থাকবে, সঙ্গে নাচ থাকবে, ফাইট থাকবে। বিনোদনধর্মী সিনেমার এই ফর্মূলার বাইরে সম্প্রতি নতুন এক অনুসঙ্গ যোগ হয়েছে তার নাম আইটেম সং। বাণিজ্যিক ও বিনোদন ধারার প্রতিটি ছবিতে এখন আইটেম সং অবধারিত হয়ে উঠেছে। কারো কারো মতে দর্শকদের সিংহভাগই সিনেমা হলে যায় শুধমাত্র আইটেম সং দেখার জন্য।

তবে ছবির গল্পের সঙ্গে আইটেম সং-এর যোগসূত্র নেই। আইটেম গান শেষ হলেই ছবিতে সেই তারকার পারফর্ম করা শেষ। এখন যারা আইটেম সং-এ পারফর্ম করছেন তাদের বেশির ভাগই বড় বড় তারকা। বলিউডের ছবিতে কারিনা কাপুর, ক্যাটরিনা কাইফ, বিপাশা বসু, মালাইকা অবোরাদের মতো তারকারা বিগ বাজেটের ছবিগুলোতে আইটেম গানে অংশ নিয়েছেন। বলিউডের আইটেম গানের এই হাওয়া বাংলাদেশের সিনেমাগুলোতে ধাক্কা দিয়েছে। মৌসুমী, অপু বিশ্বাস, ববি, পরীমনি, মাহির মতো নায়িকারাও আইটেম গানে পারফর্ম করেছেন। সিনেমায় বড় তারকাদের দিয়ে আইটেম গান করার কারণও রয়েছে। ছবির বাজেটের কারণে  অনেক নির্মাতা বড় তারকাদের ছবিতে নিতে পারেন না কিন্তু বড় তারকা নিয়ে আইটেম গান করে সেই ছবি পোস্টারে ব্যবহার করে ছবির গুরুত্ব এবং কাস্টিং ভ্যালু বাড়িয়ে নেন। এটা এখন অনেক নির্মাতার কৌশল।

একটি আইটেম গানে বলিউডে কোটি টাকা খরচ হলেও ঢাকার সিনেমায় সেই তুলনায় খুব কম ব্যয় হয়। এখানে একজন নায়িকাকে আইটেম গানের জন্য সম্মানী দেয়া হয় এক থেকে দুই লাখ টাকা। সম্মানীর টাকা কোনো কোনো সময় উঠা নামা করে কষ্টিউম ও উপস্থাপনা অনুযায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে একটি খোলামেলা আইটেম গানের জন্য অফার দেয়া হয়েছিল একজন জনপ্রিয় নায়িকাকে। এর জন্য তিনি সম্মানী চেয়েছিলেন ১০ লাখ টাকা। পরবর্তীতে তাকে ছবিতে নেননি প্রযোজক।

সুড়সুড়ি আর চুটুল কথার আইটেম গান এখন প্রায় প্রতিটি বাংলাদেশের সিনেমায় রাখা হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালের এসব গান আক্ষরিক অর্থে প্রধান অনুসঙ্গ হয়ে উঠছে প্রতিটি ছবিতে। খুল্লাম খুল্লা আইটেম গানের এই শ্রোতে চলচ্চিত্র বোদ্ধারা শংকিত। কারণ এই দুষ্টু গানের মাধ্যমে অশ্লীলতা আবার বিষের মতো ছড়িয়ে না যায়।

কলকাতার সিনেমা শিল্পের যখন হাবুডুবু অবস্থা, তখন সেখানে সিনেমার ভেতর আমদানি হয়েছিল অদ্ভুত গান ও নাচের বিচিত্র সব আইটেম! অবস্থা বেগতিক দেখে অঞ্জন দত্ত তো গেয়েই ফেললেন একটি গান। প্রযোজক শুধু একটাই কথা বারবার বলে যান, একটা দুষ্টু গান ঢোকান না দাদা, দুষ্টু গান ঢোকান। শুধু কলকাতা কেন, পুরো ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমা শিল্পের চিত্র এখন এমনই। সঙ্গীত ও নৃত্যপ্রিয় বাংলাদেশি ও ভারতীয় দর্শকের কাছে সিনেমা ‘হিট’ করাতে দুষ্টু আইটেম গানের চেয়ে সহজ তরিকা আর নেই। কিন্তু আইটেম গান আসলে কী বস্তু?

অন্তর্জালের দুনিয়া ঘেঁটে কিংবা চলচ্চিত্রবিষয়ক মোটা মোটা বই পড়েও ‘আইটেম গান’ কিংবা ‘আইটেম গার্ল’-এর সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে এখনকার দিনে হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসা কোনো বিষয় নয়, আইটেম গানের আছে পুরোনো ইতিহাস। ভারতীয় চলচ্চিত্রেই ‘আইটেম গান’ বিষয়টি প্রথম চালু হয়। এ এমন এক গান, যার সঙ্গে নির্ধারিত চলচ্চিত্রের সরাসরি কোনো যোগসূত্র থাকবে না। এই গানে ছবির গল্পের মোড় ঘুরবে না, গানে অংশ নেয়া শিল্পীদের সরাসরি সম্পর্ক থাকবে না মূল গল্পের সঙ্গে। এ যেন একঘেয়েমি দূর করতে একটু স্থূল মাত্রার বিনোদন। আর আইটেম গার্ল হবেন তাঁরাই, যাঁরা অভিনয়ের বদলে শরীরী ভাষা আর অভিব্যক্তির মাধ্যমে নাচবেন।

আইটেম গার্লের পথিকৃত

ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঘেঁটে প্রথম আইটেম-কন্যা হিসেবে পাওয়া যায় কাক্কুকে। পুরো নাম কাক্কু মোরে। অ্যাংলো -ইন্ডিয়ান এই নৃত্যশিল্পীকে বলা হতো ‘রাবার গার্ল’। তিনি ছিলেন নামী এক ক্যাবারে নৃত্যশিল্পী। কাক্কু যেমন নাচতেন, তেমনি ছিল তাঁর সৌন্দর্য্য। কিন্তু পিছিয়ে ছিলেন অভিনয়ে। তাই চলচ্চিত্রে তিনি থেকে যান একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবেই। ১৯৪৮ সালের ছবি আনোখি আদাতে কাক্কুকে দেখা যায় আইটেম গার্ল হিসেবে। সেই ছবিতে তিনি একটি গানে আবির্ভূত হন, নাচেন, গান করেন। কিন্তু ছবির গল্পের লিখিত প্লট যদি কেউ পড়েন, তাহলে স্পষ্ট দেখতে পাবেন তাঁর কোনো অংশেই উল্লেখ নেই কাক্কুর সেই গান কিংবা নাচের কথা। উল্লেখ নেই ছবিতে কাক্কুর চরিত্রটি নিয়েও।

কালে কালে আইটেম গান

কাক্কুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন হেলেন, বলিউডের ‘আইটেম রানি’। কাক্কুই হেলেনকে পরিচয় করিয়ে দেন বলিউডের সঙ্গে। বলিউডে ‘আইটেম গান’-এর মূলধারা মূলত তাঁকে দিয়ে শুরু। হেলেনের অভিনয়ের কথা হয়তো কেউ সহজে মনে করতে পারবেন না। কিন্তু তাঁর সেই ‘মনিকা, ও মাই ডার্লিং’, ‘ইয়ে মেরা দিল’ কিংবা ‘মেহবুবা ও মেহবুবা’ গানগুলো তো বলিউডে ইতিহাস। হেলেন অভিনীত সেই গানগুলোকে পুঁজি করে এখনো অনেক নাচের আসর জমে ওঠে। হেলেনের পর আরও অনেকেই আইটেম গার্ল হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে চেয়েছিলেন বিভিন্ন সময়, যাঁদের মধ্যে আছেন বিন্দু, অরুণা ইরানিদের মতো শিল্পীরা। কিন্তু হেলেনের মাইলফলক ছুঁতে পারেননি কেউ। শেষমেশ হেলেনের উত্তরসূরি হলেন তাঁরই ছেলের বউ মালাইকা আরোরা খান। দিল সে ছবির ‘ছাইয়া ছাইয়া’ দিয়ে মালাইকা শুরু করলেন একবিংশ শতাব্দীতে আইটেম গানের নতুন ধারা।

নতুন শতকে আইটেম গান

কাক্কু ও হেলেনের পর বলিউডে মালাইকাকেই পুরোদস্তুর আইটেম গার্লের তকমাটি দিতে হবে। ‘ছাইয়া ছাইয়া’ দিয়ে শুরু করে সবশেষ ‘মুন্নি’-তে এসেও এ খান-পত্নী ক্ষান্ত হননি। অভিনেত্রী হিসেবে কখনোই নয়, নিজেকে ‘আইটেম-কন্যা’ হিসেবেই তুলে ধরেছেন সবার সামনে। বিংশ  শতাব্দীতে মালাইকার পথ অনুসরণ করেছেন রাখি সাওয়ান্ত, ‘বাবুজি’ গানের ইয়ানা গুপ্ত কিংবা ‘কাটা লাগা’ গানের শেফালি জরিওয়ালারা। কিন্তু মালাইকার উচ্চতায় কেউ পৌঁছাতে পারেননি। তাদের নাচ নিয়ে কথা ওঠে বিভিন্ন সময়ে। বলা হয়ে থাকে, এঁদের পরিবেশনা শুধুই অশ্লীলতাকে উসকে দিয়েছে। এর বাইরে এই আইটেম কন্যাদের আর কোনো অবদান ছিল না বলিউডে। সম্প্রতি তাঁদের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন সানি লিওন।

আইটেম গানে সুবোধ মেয়েরা

হেলেন, বিন্দু, অরুণা ইরানিদের পর্দায় দেখা যেত ‘বার ড্যান্সার’ কিংবা খলনায়কের সঙ্গিনীর ভূমিকায়। তাই একটা সময় বলা হতো, আইটেম গান ‘ভালো মেয়েদের’ জন্য নয়। কিন্তু সেই স্টেরিওটাইপ বা ধরাবাঁধা ভাবনা ভেঙে দিলেন সত্তর-আশি দশকের বলিউড সুন্দরীরা। জিনাত আমান, পারভিন ববি ও রেখার মতো মূল নায়িকারা অংশ নিলেন আইটেম গানে। সেই থেকে চালু হয়ে গেল আইটেম গানে তারকা অভিনেত্রীদের অংশগ্রহণ। যেমনটা দেখা গিয়েছিল ‘তেজাব’ ছবিতে মাধুরী দীক্ষিতকে ‘এক দো তিন’ গানে, খলনায়ক ছবিতে ‘চোলি কে পিছে’ গানে কিংবা ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ ছবিতে শ্রীদেবীকে ‘হাওয়া হাওয়াই’ গানে। তাছাড়া একেবারে খাঁটি আইটেম-কন্যা হিসেবে মূলধারার নায়িকারা নাম লেখাতে শুরু করেন তখন থেকেই। শিল্পা শেঠি, ঊর্মিলা মাতন্ডকার, রাভিনা ট্যান্ডন থেকে শুরু করে হালের ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন, কারিনা কাপুর, ক্যাটরিনা কাইফ, সোনাক্ষী সিনহার নামও সেই তালিকায় এসে যায়।

লাভজনক আইটেম

আইটেম গান নিয়ে কটু কথা অনেক, কিন্তু এর ইতিবাচক দিকও খুঁজে বের করেছেন বলিউডের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ কোমল নাহতা ও তরণ আদর্শ। তাঁদের মতে, আইটেম গানের সঙ্গে ব্যবসায়ের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। আইটেম গান ছবির জৌলুশ অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এক আইটেম গানের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে ছবির গানের অ্যালবাম বিক্রি, প্রচারস্বত্ব থেকে পাওয়া আয়সহ আরও অনেক বিষয়। একটি সফল আইটেম গান একজন অভিনেত্রী কিংবা আইটেম-কন্যাকে কোটি কোটি টাকার মালিক করে দিতে পারে। এক ‘শিলা’ কিংবা ‘মুন্নি’র গানে নেচে প্রতিবছর নায়িকারা হয়ে যান লাখ থেকে কোটিপতি। নিজেদের আইটেম গানের সঙ্গে বিভিন্ন ‘প্রাইভেট’ আর ‘পাবলিক’ পার্টিতে নেচে ঘরে লক্ষ্মী তুলে নিচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে আইটেম গান কিন্তু মন্দ কিছু নয়।

বাংলায় আইটেমের অনুপ্রবেশ

নব্বই দশকের শেষের দিকে ঢাকাই সিনেমায় শুরু হয় ভয়াবহ অশ্লীলতা। সেটি খানিকটা কমতে শুরু করে ২০০৭ সালের পর। এর বদলে সিনেমায় শুরু হয় ‘একটি বিশেষ গান’-এর ধারা। বলিউডের অনুকরণে বাংলাদেশের সিনেমার এই গান অশ্লীলতাই থেকে যায়। আইটেম কন্যার সংক্ষিপ্ত পোশাক, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, গানের অরুচিকর কথা ও ইঙ্গিতপূর্ণ সুরের সেই গানগুলো দেখে মনে হবে পুরোনো কাসুন্দি ফিরে এসেছে নতুন বোতলে। এখনকার অনেক পরিচালক তো মনেই করেন। আইটেম গান না থাকলে সিনেমা হবে না।

বাংলা সিনেমায় মূল নায়িকার পাশাপাশি শুধু আইটেম গানে নাচ করার জন্য রয়েছে বেশ কজন আইটেম-কন্যা। এঁদের মধ্যে রেদওয়ান রনি পরিচালিত চোরাবালি ছবিতে নেচেছেন সিন্ডি রাউলিং। কমন জেন্ডার ও কিসিৱমাত ছবিতেও দেখা গেছে তাঁকে। পেশাদার আইটেম কন্যা বিপাশা কবির তিন বছরে নেচেছেন ৩০টি ছবির গানে। তালিকায় আরও আছেন সাদিয়া  আফরিন, শিরিন শীলাসহ অনেকে। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া তন্ময় তানসেন পরিচালিত রানআউট ছবিতে আইটেম-কন্যা হিসেবে ছিলেন নায়লা নাঈম। তবে দর্শকদের মতে, নায়লা নাচেননি, সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে শুধু নড়াচড়া করেছেন। আলভী আহমেদের ছবি ইউটার্ন-এ নেচেছেন র‌্যাম্পের মডেল রুমা। তাতে জমকালো সেট, আলোর ঝলকানি, জবরজং পোশাক আর মেকআপের সৌন্দর্য্য বলিউডকেও ছাড়িয়ে গেছে। রুমার নাচেও ছিল বেশ জড়তা।

মূলধারার নায়িকাদের মধ্যে অনেকেই নেচেছেন আইটেম গানে। এর মধ্যে ইফতেখার চৌধুরীর বডিগার্ড সিনেমায় ছিলেন নায়িকা ববি। তালিকায় রয়েছে সিমলা, মাহিয়া মাহি, পরীমনি, মৌসুমী হামিদ, হ্যাপিসহ আরও কিছু নাম। সম্প্রতি ঢাকা-কলকাতার একটি যৌথ প্রযোজনার ছবিতে নেচেছেন নিপুণ। তিনি বলেন, ‘আইটেম গান রাখা হয় ছবির প্রচারণার জন্য। দর্শকেরা সেটা ভালোভাবে গ্রহণও করেন। তবে আইটেম গানের মেয়েদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, সেটা একটু অন্য রকম। মূল নায়িকারা আইটেম গানে নাচলে ওভাবে উপস্থাপিত হন না।’

আইটেম গানের অশ্লীলতা প্রসঙ্গে নায়ক শাকিব খান বলেন, ‘অতটুকু অশ্লীলতা দেখতে দর্শক হলে যাবেন কেন? সবার হাতেই আছে মুঠোফোন-ইন্টারনেট। দর্শক বরং অশ্লীলতার কারণে ওই ছবিগুলো প্রত্যাখ্যান করছেন। আইটেম গানের নামে ওই সব অশ্লীল গানের কারণে রুচিমান ও নারী দর্শক কমে যাচ্ছে। এসব গান রাখা যেতে পারে, তবে সেটা ব্যতিক্রম ও রুচিশীল হতে হবে।’ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের অন্যতম সদস্য মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘অনেকেই ছবিতে আইটেম গানের নামে অশ্লীল গান রাখছেন। অনেক সময় সেগুলো সেন্সর বোর্ডের সবাই একসঙ্গে বসে দেখাও যায় না।’ ‘আইটেম-কন্যা’ বিপাশা কবির মনে করেন, আইটেম গানের নৃত্যপরিচালকদের উচিত আরও রুচিমান হওয়া। সম্প্রতি বাংলাদেশের টেলিছবি আমাদের গল্পতেও ব্যবহার করা হয়েছে আইটেম গান। এবার কি তবে ছোট পর্দাতেও এই গান পাকাপাকি আসন করে নেবে।

  • সিনেমা
Comments (০)
Add Comment