তবুও ইচ্ছেটা মরেনি!

সুন্দর সকাল। প্রচণ্ড শীতেও পুব আকাশে আলোর ঝলকানি। এই বুঝি রোদের মুখ দেখা যাবে। এমনি সুন্দর একটি দিনে কানাডার টরেন্টো থেকে সেখানকার পাসপোর্ট ধারী এক বাঙালি অ্যাডভেঞ্চারিস্ট তার লেফটহ্যান্ডড্রাইভ মিটসুবিশি আউটল্যান্ডার গাড়িটি নিয়ে বের হলেন। প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় শুধু বললেন, আমি  গাড়ি নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণে বের হচ্ছি, তোমরা দোয়া করো ভ্রমণ শেষে যেন আবার তোমাদের কাছে ফিরে আসতে পারি। এটা ২০০৯ সালের ২ আগস্টের কথা।

কানাডা থেকে আটলান্টিং সমুদ্র পাড়ি দিয়ে প্রথমে গেলেন ইংল্যান্ড। সেখান থেকে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সার্বিয়া ঘুরে গেলেন তুরস্ক। তুরস্ক যাওয়ার পর ঘটে এক গা ছমছম করা ঘটনা। সেই ঘটনা অ্যাডভেঞ্চারিস্ট বাঙালি আবদুস সাত্তারের মুখ থেকে শোনা যাক।

তুরস্ক সীমান্ত পার হওয়ার সময় পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বললেন, আপনি কি তুরস্কের বিখ্যাত দর্শনণীয় স্থান ঘুরে এসেছেন? তার কথা শুনে ভাবলাম কাছাকাছিই যখন এসেছি তখন জায়গাটা দেখেই যাই। সামনে এগুতেই একজন পুলিশ অফিসার এসে বললেন আপনার গাড়িটি তল্লাসি করতে হবে। আমি অবাক হলাম, কিছুক্ষণ আগেই তো পুলিশের এক বড় কর্তার সঙ্গে কথা হলো। যা হোক তারা গাড়ি তল্লাসি করতে লাগলেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম অফিসার গাড়ির ভেতরে এমন সব জায়গায় তল্লাসি করছেন যেখানে টাকা-পয়সা ও দামি জিনিসপত্র রাখা হয়। গাড়িতে রাখা আমার দুই বছরে যে টাকা লাগবে তার পুরোটা ওরা নিয়ে গেল। সঙ্গে ব্যাংক, বীমা ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও সঙ্গে নিল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ওদের গাড়ির সামনে আসার জন্য ইশারা দিল। আমি গাড়ির ভেতরটা ভালোভাবে দেখে লক করে ওদের সামনে যেতেই ওরা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সামনের দিকে চলে গেল। আমিও পেছনে পেছনে ছুটতে থাকলাম। একটি হাইওয়ের বাইপাসের পথ ধরে ওরা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তাদের পিছু না নিয়ে পাশের একটি পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে সব বলার পর তারা বলল ওরা পুলিশ নয়, ডাকাত। পুলিশের পোশাক পরে আপনার সবকিছু লুটে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গাড়ি নিয়ে ছুটলো ওদেরকে ধরার জন্য। কিন্তু কাজ হলো না। পুলিশ ডায়েরি করে তদন্ত শুরু করলো। হাইওয়ের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ খুঁজেও কিছু পাওয়া গেল না। ওরা যে গাড়ি দিয়ে ডাকাতি করেছে সেটা পুলিশের কাছ থেকে ছিনতাই করা গাড়ি। ইউরোপে পুলিশের গাড়ি রাসৱা-ঘাটে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ফাঁকি দিয়ে চলাচল করে। এভাবেই পুলিশের ভিডিও ফুটেজ রেকর্ডারের অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে।

অকস্মাৎ এই ঘটনায় মন খুব খারাপ। পুলিশের অনুমতি নিয়ে গাড়ি সাপেক্ষে ইসৱাম্বুল চলে গেলাম। তখন আমার হাতে কোনো টাকা ছিল না, বলা যায় শূন্য হাত। সঙ্গে ছিল শুধু একটি ক্রেডিট কার্ড এবং গাড়িতে ছিল দুই বছর ট্যুর করা যায় এমন শুকনো খাবার। যেমন- চিড়া, মুড়ি, চাল, ডাল, মসলা, আলু, চুলা ও একটি ছোট জেনারেটর। তুরস্কের রাজধানী ইসৱাম্বুল থেকে চলে এলাম ইরান। আবার সেখান থেকে পাকিসৱান। পাকিসৱান থেকে সড়ক পথে চলে এলাম ভারতের দিল্লি। দিল্লি থেকে সড়ক পথে বেনাপোল হয়ে বাংলাদেশে আসার অনুমতি পেলাম না। তাই আবার চলে গেলাম  পাকিসৱান। করাচি সমুদ্র বন্দর থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছানোর জন্য একটি কনটেইনারে গাড়িটি লোড করে আমি প্লেনে চলে এলাম ঢাকায়।

চট্টগ্রামে গাড়ি আসার পর গাড়ি ছাড় করাতে গেলাম কিন্তু  গাড়ি ছাড় করাতে গিয়ে ঘটল বিশাল এক ঘটনা যা তুরস্কে ডলার ডাকাতির চেয়েও ভয়াবহ। যা মনে করলে এখনো আতকে উঠি। আমি বলছি ২০১০ সালের মে মাসের কথা। আমার মিটসুবিশি আউটারল্যান্ডার গাড়িটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছানোর পর যখন ছাড় করাতে গেলাম তখন কাস্টমস থেকে বলা হলো- আপনাকে ট্যাক্স দিয়ে গাড়ি ছাড় করাতে হবে। আমি বললাম, বিশ্ব ভ্রমণের জন্য কানাডা থেকে বাংলাদেশে গাড়িটি নিয়ে এসেছি। এ সংক্রান্ত সব ধরনের ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে। আমি মাত্র ক’দিন বাংলাদেশে থেকে ভারত হয়ে আবার বিশ্ব ভ্রমণে যাব। কিন্তু এসব কথায় কোনো কাজ হলো না। আমি ছুটতে থাকলাম এ মন্ত্রণালয় থেকে ওই মন্ত্রণালয়ে। এই দফতর থেকে ওই দফতরে। এমনি করে ছয়টি বছর আমি এদেশের সরকারি বিভিন্ন অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি কিন্তু গাড়িটি ছাড় করাতে পারিনি। একেক সময় মনে হতো সব ছেড়ে আবার কানাডা চলে যাই। আবার মনে হতো যদি সব ছেড়ে চলেই যাই তাহলে তো পরাজিত হলাম। বাঙালি পরাজিত হতে জানে না। সেটা ৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ৭১ এ মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রমাণ করেছি আমরা। আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সম্মুখ সমরে যুদ্ধ  করেছি। অবশেষে মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বলি এবং তাঁর হস্তক্ষেপে গত ৪ মে ২০১৬ তে গাড়িটি ৪৩ লাখ টাকা মওকুফে ছাড় করাতে পেরেছি। গাড়িটি ছাড় করে চৌমুহনীর একটি গ্যারেজে ৩৩ দিন মেরামত করে চলার উপযোগী করা হয়। কারণ ৬ বছর গাড়িটি একটি কনটেইনারে থাকায় এর চাকা ও অনেক পার্টস নষ্ট হয়ে যায়। বেশ বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করে গাড়িটি সচল করেছি। আশা করি গাড়িটি নিয়ে আবার বিশ্ব ভ্রমণে বের হতে পারব।

গত ৪ সেপ্টেম্বর আব্দুস সাত্তারকে বাংলাদেশ স্কাউট এন্ড গাইড ফেলোশীপ সংবধনা দেয় স্কাউট ভবন মিলনায়তনে। সেখানে তার সঙ্গে কথা হয় আনন্দ আলোর। সেই আলাপ চারিতার অংশ বিশেষ পত্রস্থ হলো।

আনন্দ আলো: আপনি তো কানাডার নাগরিক। তো কি উদ্দেশ্য নিয়ে একটি মাত্র গাড়ি নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণে বের হলেন?

আব্দুস সাত্তার: আমি গত ২৫ বছর আগে কানাডার নাগরিত্ব পেয়েছি। আমার শখ হলো- দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করা। ভ্রমণ করতে করতেই পরিকল্পনা করি ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করার এবং আমার প্রধান উদ্দেশ্য হলো-ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করে গিনেজবুকে নাম লেখানো।

আনন্দ আলো: শুধু গিনেজবুকে নাম লেখানোর জন্য গত ৭/৮ বছর ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন?

আব্দুস সাত্তার: আমার স্ত্রী অনেকটা অভিমান নিয়ে বলেছে, এই রেকর্ড টেকড করার দরকার নেই। সব ছেড়ে কানাডা চলে আসো। কিন্তু আমি আমার লক্ষ্যে অবিচল।

আনন্দ আলো: আপনার গাড়িটি চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আটকে দেয়ার প্রধান কি কারন বলে মনে করেন?

আব্দুস সাত্তার: এর প্রধান কারণ হলো- এক দেশ থেকে আরেক দেশে কোনো পর্যটকের গাড়ি রাসৱায় চলাচলের যে কার্নেট ডি প্যাসেজ জাতিসংঘ সনদে আছে সেখানে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি। এ কারণে গত ৬টি বছর আমাকে গাড়িটির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।

আনন্দ আলো: এই ৬ বছর কোথায় ছিলেন?

আব্দুস সাত্তার: আমি পুরো ৬ বছর বাংলাদেশে ঢাকা আর চট্টগ্রামে ছিলাম গাড়িটি ছাড় করার জন্য। এক দিনের জন্যও দেশের বাইরে যাইনি।

আনন্দ আলো: আপনি পেশাগতভাবে কী করেন? কানাডা থেকে কত টাকা নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়েছিলেন?

আব্দুস সাত্তার: আমি পেশাগতভাবে একজন হিসাবরক্ষক। কানাডার একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। কত টাকা নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়েছিলাম সেটা না হয় নাই বললাম।

আনন্দ আলো: এবার বিশ্ব ভ্রমণে কোথায় কোথায় যাবেন?

আব্দুস সাত্তার: প্রথমে ভারত হয়ে নেপাল, ভুটান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মরক্কো, তিউনেশিয়া, মিশর, তারপর ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ঘুরে  আমেরিকা মহাদেশ ভ্রমণের ইচ্ছা আছে।

  • ভ্রমণ
Comments (০)
Add Comment