ঈদ অনুষ্ঠান এবং কৃষকের ঈদ আনন্দ

শাহেদ কামাল

ঈদ আসে। ঈদ যায়। ঈদ আনন্দের উৎসব। ঈদের আনন্দ-বিনোদনের সঙ্গে সম্প্রতি সংযুক্ত হয়েছে টেলিভিশন অনুষ্ঠান। ঈদের ছুটিতে কেউ বিদেশ ভ্রমণে যান। কেউ দেশের বাড়িতে যান। কেউ কেউ ঘুরতে বের হন। চিড়িয়াখানায় যান। পার্কে যান। কেউ কেউ আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে যান।

এসবের সঙ্গে এখন সবচেয়ে জোরালো ভাবে যুক্ত হয়েছে ঈদ টেলিভিশন অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের টেলিভিশনে সপ্তাহজুড়ে ঈদ আনন্দ আয়োজন এখন আমাদের সংস্কৃতির প্রধান অংশ। তবে প্রশ্ন থাকে, ঈদ ব্যসৱতার মধ্যে দর্শক মনোযোগ দিয়ে কয়টা নাটক দেখেছেন? কয়টা গানের অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন? বাছাই অনুষ্ঠান ছাড়া অনুষ্ঠান উপভোগ করার কোন সময় সুযোগ আমাদের নেই। কারো পক্ষেই সম্ভব নয় ঈদ অনুষ্ঠানের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখা। তাই আমাদের বাছাই করে নিতে হয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। নাটক বা গানের অনুষ্ঠান বা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বা টক শো’র বাইরে যে অনুষ্ঠানগুলো একক ও স্বতন্ত্র- সেগুলোর প্রতি দর্শকদের আলাদা আগ্রহ থাকে।

২.

ঈদের টিভি অনুষ্ঠানের বিনোদনে নতুন মাত্রা কি আমরা পাই? ঈদ নাটকের ব্যাপক প্রচার প্রপাগান্ডা থাকে। বৃত্তাবদ্ধ ঘেরাটোপ থেকে সমকালীন প্রসঙ্গে ঈদ নাটকের যাত্রা দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষন করেছে।

ঈদের গানে কোনো বৈচিত্র ছিলো না। প্রায় একই ধরনের লাইভ অনুষ্ঠান। চেনা শিল্পীদের চেনা গান- ঈদ স্পেশাল কিছু পাওয়া যায় না।

ঈদের চলচ্চিত্র এবার সাড়া জাগিয়েছে। শাকিব খান ছিলেন আলোচনার শীর্ষে। হলের চলচ্চিত্র ছাড়াও টেলিভিশনে অনেক ছবি মুক্তি পেয়েছে। পুরানো ছবি দেখানো হয়েছে। এসব ব্যাপারেও দর্শকদের আগ্রহ থাকে।

ঈদের অনুষ্ঠানের মধ্যে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান শিরোনামে কিছু অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। যে অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট চরিত্র থাকে না- বারোয়ারি বিষয়কে একসূত্রে গেঁথে দেয়া হয় তাকেই ‘ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান’ শিরোপায় ভূষিত করা হয়। বিটিভির যুগ থেকে এই প্রাচীন ও বহুল ব্যবহৃত ধারাটি অব্যাহত আছে। নাচ-গান-হাস্যকৌতুক ও খোঁচাখুচি করার প্রবণতা নিয়ে এই ধরনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের দিন বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু যাদের চোখ কান বন্ধ থাকে তারা এটা উপলব্ধি করতে পারেন না। এই ধরনের অনুষ্ঠানের জনক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই সরে এসে জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র স্থাপন করেন। প্রথিতযশা উপস্থাপক আনিসুল হক বর্তমানে ঢাকা উত্তরের নির্বাচিত মেয়র হিসাবে সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছেন। আবদুন নূর তুষার ‘শুভেচ্ছা’র একঘেঁয়েমি থেকে বের হয়ে নিজেকে বিকশিত করতে পেরেছেন। তবে হারিয়ে গেছেন রায়হান গফুর?

আনজাম মাসুদ উপস্থাপিত ও পরিকল্পিত পরিবর্তন দেখলাম বিটিভিতে ঈদ অনুষ্ঠানে। সেই চর্বিত চর্বণ। একই ফরম্যাট। নতুন কিছু নেই। খন্দকার ইসমাইল কিংবা দেবাশীষ বিশ্বাস একই ধারার দুটি অনুষ্ঠান করেছেন এই ঈদে। আনন্দ-বিনোদনের ধামাকা ছিলো এই অনুষ্ঠান দুটিতে। কিন্তু একজন সামান্য দর্শক হিসাবে আমাদের মন আগ্রহী হয়ে ওঠে না এইসব অনুষ্ঠান দেখতে।

ম্যাগাজিন ধারার সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। একসময় জব্বার আলীর নাটক ও আনন্দ মেলা বলতে ঈদ বোঝাত। পরে ইত্যাদিও ঈদ সমার্থক হয়ে ওঠে। প্রচারের আলোয় এই অনুষ্ঠানের ধারে কাছে কিছু নেই। কিন্তু কি আছে এই অনুষ্ঠানে? নুতন কিছু তো পাওয়া যায় না। গভীর মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু আনন্দ-বিনোদনের নামে ভাঁড়ামি, কৌতুক আর খোঁচাখুচি ছাড়া সারবন্তু কিছু পাওয়া যায় না। বিখ্যাত এই উপস্থাপকের কাছ থেকে দর্শক হিসাবে আমরা নতুন কিছু চাই। নতুন আঙ্গিকের নতুন অনুষ্ঠান।

কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে সব। বোকাবাক্স টেলিভিশন এখন থাকবে কিনা, কোন ফরম্যাটে থাকবে সেটাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নেটওয়ার্কিং পৃথিবীতে এখন সব হাতের মুঠোয়। তাই দেখতে পাই- বদলের হাওয়া। টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখতে পাব আমার মোবাইলেও।

দেশে-বিদেশে টিভিতে কতো ধরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রাইভেট চ্যানেল না থাকলে অমরা বুঝতে পারতাম না রিয়েলিটি শোর গুরুত্ব। একই সঙ্গে এটা অনুষ্ঠান। আবার সামাজিক অনুসন্ধান। আবার শিল্পী খুঁজে পাবার প্ল্যাটফর্ম।

এখন চ্যানেলে চ্যানেলে দেখতে পাই নানা ধরনের গেম শো। আর টক শোর তীব্র জনপ্রিয়তার কথা নাইবা বললাম। আর দেখতে পাই লাইভ শো। এসব নানামুখী পরিবর্তনের ধারায় এগিয়ে চলেছে টেলিভিশন। সমাজ পরিবর্তনেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে টিভি। উন্নয়ন সাংবাদিকতায় খুলে যাচ্ছে নতুন দিগনৱ। নতুন দিনের প্রেক্ষাপটে টেলিভিশন অনুষ্ঠান এখন কেমন হওয়া প্রয়োজন সে নিয়ে বিসৱর বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু আমরা দর্শক হিসেবে নতুন কিছু চাই। সে প্রত্যাশা মেটানোর দায়িত্ব নিতে হবে টেলিভিশন ব্যক্তিত্বদের।

৩.

এই রকম নানা পথে নানামুখী চিনৱা মনে জমা হলো ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে গিয়ে। নাটক, সিনেমা, টেলিফিল্ম, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, টক শো, লাইভ শোর মাঝে এবারে সুস্থতার বাতাস বহমান হলো কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানে। গত কয়েক বছর ধরে ভিন্নধর্মী এই অনুষ্ঠানটি মৌলিকত্বের শীর্ষে। অনুষ্ঠানের চরিত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে এই অনুষ্ঠানকে উল্লেখ করা হয়েছে ফারমার্স গেম শো।

কয়েকটি কারনে এই অনুষ্ঠানটি সচেতন দর্শক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। প্রথমত কৃষকের ঈদ আনন্দ ষোলআনা বাংলা বাঙালি ও বাংলাদেশের অনুষ্ঠান। দ্বিতীয়ত ঐতিহ্য ইতিহাস ও স্বদেশীয়ানার মূর্ত প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় এই অনুষ্ঠানে। তৃতীয়ত গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ এই অনুষ্ঠানের প্রধান অংশগ্রহণকারী। চতুর্থত গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলাকে পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। পঞ্চমত এই একটি মাত্র অনুষ্ঠান যেখানে ভাড়ামিপূর্ণ হাস্যকৌতুক নাই। কিন্তু প্রতি দৃশ্যে পর্যাপ্ত হাসির খোরাক। স্নিগ্ধ সরলতা কৃষকের ঈদ আনন্দ এর প্রাণশক্তি।

অনুষ্ঠানের উপস্থাপক পরিচালক ও নির্মাতা আমাদের প্রিয় সর্বজনশ্রদ্ধেয় মাটি ও মানুষ খ্যাত শাইখ সিরাজ। বাংলাদেশে কৃষি নির্ভর বাঙালিদের নিয়ে প্রায় দুই যুগের অধিককাল ধরে তিনি একক প্রচেষ্টায় গণমাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন। তার এই নিবেদনের প্রকৃত মূল্য কি আমরা দিতে পেরেছি?

ঈদ আনন্দ আয়োজনে তাই শাইখ সিরাজ যখন কৃষকদের নিয়ে আনন্দময় একটি নির্মল অনুষ্ঠান দর্শকদের উপহার দেন তখন আমরা কৃতজ্ঞ হই তার কাছে। এখন টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জোয়ার বইছে। কোন অনুষ্ঠানটি ভালো, কোন নাটকটি সমাদৃত তা বোঝার কোন শটকাট রাসৱা নাই। কারণ প্রযুক্তির প্রচার ও প্রসার ঘটলে মদ ও দুধ এক হয়ে যায়। বেশি অনুষ্ঠান নির্মিত হলে ভালো অনুষ্ঠান সনাক্ত করাও মুশকিল।

তাই বলি কৃষকের ঈদ আনন্দ নির্মাণের স্বচ্ছতায়, বিষয়ের অভিনবত্বে আড়ম্বরহীন, সহজবোধ্যতায় সাধারণ মানুষের কল কোলাহলে এক আশ্চর্য ও অনুপম অনুষ্ঠান।

এবার অনুষ্ঠানটি ধারণ করা হয়েছে সন্দ্বীপে। সন্দ্বীপের কৃষকেরা এর প্রাণশক্তি। গ্রাম বাংলায় প্রচলিত খেলাধুলা ও জীবন ঘনিষ্ঠতা থেকে তুলে আনা বিষয়কে প্রতিযোগিতার অংশ বানিয়ে পুরো গেম শোটি সাজানো হয়েছে। ট্রলার থেকে মানুষকে কোলে নিয়ে নদী পার হতে হয়। এটাও প্রতিযোগিতায় ক্রিয়েটিভ বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। কলাগাছে তেল মেখে চড়া, সাঁকোর উপর বালিশ দিয়ে লড়াই, সন্দ্বীপের প্রাচীন বাসিন্দার স্মৃতিকথা, প্রাসঙ্গিক ভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর প্রতিবেদন একেবারে মুগ্ধ করে রাখে দর্শকদের।

অনুষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর সরলতা। ধার করা কোন বিষয় এই অনুষ্ঠানে নেই। অকারণে চিৎকার চেঁচামেচি ও জাকজমক নেই।

ঈদ আনন্দ আয়োজনে কৃষকের ঈদ আনন্দ অতি মৌলিক একটি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের সাথে অন্য অনুষ্ঠানের তুলনা হয় না। অতুলনীয় কৃষকের ঈদ আনন্দ-এর জন্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজকে অকৃত্রিম অভিনন্দন।

সাধারণ দর্শক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে টেলিভিশনে যেন বৈচিত্রময় অনুষ্ঠান দেখানো হয়। একই কুমিরছানাকে দেখতে দেখতে আমরা ক্লানৱ।

আমরা চাই নতুন দিনের নতুন ভাবনার অনুষ্ঠান। যে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থাকবে। আমাদের জনজীবনের প্রতিফলন থাকবে। বাঙালির স্বপ্ন ও আকাঙ্খার প্রতিফলন থাকবে। আমাদের উন্নয়ন ভাবনা থাকবে। আমাদের নিজস্বতা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কৃষকের ঈদ আনন্দ আমাদের সেই আনন্দময় উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায়।

  • টিভি গাইড
Comments (০)
Add Comment