প্রকাশনার গুণগত মানই জরুরি

প্রকাশনায় সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ, নাকি মান বজায় রেখে কম সংখ্যা বই-ই প্রয়োজন? যে বই বুদ্ধি বৃত্তিক চেতনাকে উন্মোচন করে, জাতীয় চেতনা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করে, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে তোলে সেই বই-ই ভালো বই। হ্যাঁ, পাঠক প্রকাশনার মানোন্নয়ন, শুদ্ধ বানান, পান্ডুলিপি বাছাই, সম্পাদনাসহ এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সম্প্রতি বাংলা একাডেমির ড. মুহম্মদ শহীদুল­াহ্ ভবনের সভাকক্ষে আয়োজিত ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা: প্রকাশনার মানোন্নয়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় উপরোক্ত বিষয়গুলো উঠে আসে। ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক, প্রবীণ প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, লেখক-সাংবাদিক আবুল হাসনাত, শিক্ষাবীদ আব্দুল­াহ আবু সায়ীদ, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, শিশুসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন, গবেষক আহমাদ মাযহার, সাংবাদিক সাজ্জাদ শরীফ, তারেক সুজাত, অজয় দাশগুপ্ত, প্রকাশক ফরিদ আহমেদ, মিলন নাথ, শাহাদাত হোসেন, লোটন শিকদার, খান মাহবুব, নিশাত রানাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা। অনুষ্ঠানে একটি লিখিত ধারণাপত্র পাঠ করেন প্রকাশক বদিউদ্দিন নাজির।  যে বই মননকে স্পর্শ করে, ঋদ্ধ করে, সেসব বই-ই ভালো। আজে বাজে প্রকাশনার ভিড়ে ভালো বই হারিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া বেশির ভাগ প্রকাশনা সংস্থার নেই নিজস্ব সম্পাদক। সম্পাদনা ও পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইসহ মানসম্পন্ন লেখকদের বই প্রকাশে গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনেরা উলে­খ করেন। বইয়ের মান উন্নয়নে সরকার, লেখক-প্রকাশকসহ সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে বলে তারা মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে বক্তারা আরো বলেন, ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাণিজ্য বা শিল্পমেলা নয়, এটা বাঙালি জাতির সর্বোৎকৃষ্ট সাংস্কৃতিক পর্ব। কিন্তু প্রতি বছর হাজার হাজার বই প্রকাশ হলেও প্রকাশনা ও লেখার মান উন্নত হচ্ছে না। এমতাবস্থায় আগামীর প্রজন্মের জন্য বুদ্ধিদীপ্ত এবং মনন উৎকর্ষের জন্য মানুষের চিন্তার উন্মেষ যেনো ঘটে তেমন বই প্রকাশ করা দরকার।’   স্বাগত বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘দেশের প্রকাশনার উন্নয়ন ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবনা-বিনিময়ের চিন্তা থেকে এ বৈঠকের আয়োজন করেছি। আশা করি এর মধ্য দিয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজনের পাশাপাশি সারা বছর প্রকাশনা শিল্পের সার্বিক উন্নয়নের রূপরেখা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।’ সভাপতির বক্তব্যে আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের প্রকাশনাশিল্প অনেক দূর এগিয়েছে। একটু যতœবান হলেই এর সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা সম্ভব। তবে বইয়ের সংখ্যার চাইতে এর মানের দিকে নজর দেয়া একজন লেখকের যেমনি প্রয়োজন তেমনি প্রকাশকেরও লক্ষ্য রাখতে হবে।’ আহমদ রফিক বলেন, ‘গুটিকয় প্রকাশক ছাড়া কেউই সম্পাদনা ও পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাই করেন না। ফলে প্রতিবছর বইমেলায় হাজার হাজার বই প্রকাশ হওয়ার পরও ভালো মানের তিনশ বই পাওয়া যায় না। এটার দিকে নজর দিতে হবে প্রকাশকদের। ফর্মার হিসেবে কলকাতার বইয়ের চেয়ে আমাদের বইয়ের দামও বেশি। এই বিষয়টিও প্রকাশকদেরকে চিন্তা করতে হবে।’ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের লেখার মান এক ধাপও এগোয়নি। পুস্তক প্রকাশনা চলচ্চিত্র প্রযোজনার মতোই। এখানে কপি এডিটিং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই এই বিষয়টির দিকেও সকলকে নজর দিতে হবে। এটা আমাদের জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নও বটে। কলকাতার বইগুলোর দিকে তাকালে তাদের বইয়ের লেখা ও প্রিন্টিং-এর মানের সঙ্গে আমাদের বইগুলো মিলে না। আমাদের এখানে তিন হাজার, চার হাজার এবং পাঁচ হাজার বই প্রকাশ করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এটা ঠিক না। বইয়ের মানটাই আসল।’ চিত্রশিল্পী হাশেম খান বলেন, আমাদের পাঠক সংখ্যা বাড়ানোর দিকেও নজর দিতে হবে। একবার চিন্তা করে দেখুন আমাদের ষোল কোটি মানুষ যদি পড়াশুনা জানতো তাহলে আমাদের প্রকাশনা শিল্প আজ কোথায় থাকতো। তাই আগামীর প্রজন্ম অর্থাৎ শিশুদের বইয়ের দিকে নজর দিতে হবে।  কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘বইয়ের মানোন্নয়ন শুধু প্রকাশনায় নয়, বরং এর লেখার মানের দিকেও নজর দিতে হবে। মুক্তধারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখকদের খুঁজে নিয়ে আসতো এবং তাদের লেখা ভালো মানের বই প্রকাশ করতো। কিন্তু বর্তমানে ক’জন প্রকাশক তা করেন এটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু প্রকাশকই পারেন একজন ভালো লেখক কে আবিস্কার করতে। এর পাশাপাশি আমি বলবো একজন প্রকাশকের অবশ্যই ভালো জানাশোনা মানুষকে দিয়ে বই সম্পাদনার কাজটা করা উচিৎ। আরেকটা বিষয় না বললেই নয় তা হলো-এখন তো যে কেউ লেখক। আমার মতে, লেখার জন্যও একজন লেখকের প্রস্তুতি প্রয়োজন। তার জানাশোনা প্রয়োজন। আর প্রচুর বই বের হচ্ছে। তা নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। তবে আবর্জনা থাকবেই। সেই আবর্জনা থেকে যেনো একটি পদ্মফুল ফুটে সেটার জন্য প্রকাশকদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।’ প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘প্রকাশকদের ব্যাপারে যে কথাটি বার বার বলা হচ্ছে যে, আমরা নাকি বই সম্পাদনা করি না। আমার মতে, গুটি কয়েক প্রকাশনা ছাড়া প্রতিটি প্রকাশকই একটি বই সম্পাদনা করে থাকেন। শুধু তাই নয়-যদি আমার কথা বলা হয় তাহলে বলবো আমার প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বইগুলোর জন্য যথাযথভাবে সম্পাদনা হয়ে থাকে। আর আমরা প্রকাশনাকে শুধু ব্যবসা হিসেবে দেখি না। তাহলে অন্য আরো অনেক ব্যবসা করতে পারতাম। এটা সৃজনশীল একটা কাজ। আমরা সেভাবেই বিষয়টাকে দেখি।’

  • বইমেলা প্রতিদিন
Comments (০)
Add Comment