Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

সবুজ বন বাঁচায় জীবন : মুকিত মজুমদার বাবু

বন মানেই এক বুক সজীব নিশ্বাস। বন মানেই একটি নয়, অসংখ্য গাছ। বন মানেই অক্সিজেন ভাণ্ডার। বন মানেই একখণ্ড ছায়া-সুনিবিড় সুশীতল সবুজে মোড়ানো চাদর। বন মানেই বিচিত্র লতাগুল্ম, বুনোফুলের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত গানের সুর, হাওয়ায় হাওয়ায় বাতাসের কাঁপনে গাছের শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায় কবিতার ছন্দ। বন মানেই সহ্র মানুষের কর্মস্হান, মাটির ক্ষয় রোধ, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। বন মানেই মানব মনের বিষণ্নতায় প্রশান্তি, সুপেয় পানির সংস্হান, ওষুধের কাঁচামালের উৎস, জ্বালানির অভাব পূরণ, উদ্ভিদ আর প্রাণিকুলের বাসস্হান। বন মানেই পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার গুরুত্বপূর্ণ এক নিয়ামক।

বন নানাভাবে আমাদের উপকার করে যাচ্ছে বিনিময় আশা না করে। সুন্দরবনের কথাই ধরা যাক- প্রাকৃতি দুর্যোগের কবল থেকে উপকূলবাসীর রক্ষাকবচ এ সুন্দরবন। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের প্রবল ঝাঁপটায় সুন্দরবন বুক পেতে দিয়ে উপকূলের অসংখ্য মানুষের জীবন রক্ষা করেছে। ২০০৯ সালের ২৫ মে’র প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাস আইলা থেকে ঢাল হয়ে উপকূলবাসীদের জীবন রক্ষা করেছে সুন্দরবন। জনশ্রুতি আছে ‘সুন্দরবন যদি না থাকত তাহলে সিডর ও আইলায় উপকূলে মানববসতির কোনো চিহ্নই থাকত না। ’ মূলকথা বন্ধুপ্রতিম সুন্দরবন পাহারাদার হয়ে পাহারা দিয়ে রাখছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের।

যদিও সেই ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের দাপট মোকাবিলায় সুন্দরবনকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে নিজেকে বিপন্ন করে। তাই নির্দ্বিধায় স্বীকার করতেই হবে বনের মতো উপকারী বন্ধু-আত্মীয় হয়ে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কানাডার জাতীয় পরিবেশ এজেন্সির একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ‘গড়পড়তায় একটি গাছ থেকে বছরে ২৬০ পাউন্ড অক্সিজেন তৈরি হয়। আর দুটি পরিপূর্ণ গাছ যে অক্সিজেন সরবরাহ করে তা ৪ সদস্যের একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট। ’

ইন্ডিয়ান ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষকরা ৫০ বছর বেঁচে থাকা একটি বৃক্ষ মানব সমাজকে কতটা আর্থিক সুবিধা দেয় তার একটা হিসাব তুলে ধরেন ‘বায়ু দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে ১০ লাখ টাকার, জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন দেয় ৫ লাখ টাকার, বৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, মাটির ক্ষয়রোধ ও উর্বরাশক্তি বাড়িয়ে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, গাছে বসবাসকারী প্রাণীর খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, আসবাবপত্র ও জ্বালানি কাঠসহ ফল সরবরাহ করে ৫ লাখ টাকার এবং বিভিন্ন জীবজন্তুর খাদ্য জোগান দিয়ে বাঁচায় আরো ৪০ হাজার টাকা। ’

যে বন আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে সেই বনকেই আমরা অসচেতনতা, অবহেলা আর লোভের বশবর্তী হয়ে উজাড় করে চলেছি প্রতিনিয়ত। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যিটা এই যে, ২০০ বছর আগেও বিশ্বের ৪৭ ভাগ এলাকা বনভূমিতে পরিবেষ্টিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে ২৯ ভাগ এলাকায় বনভূমি রয়েছে। প্রতি ৪ সেকেন্ডে একটি ফুটবল মাঠের সমান উষ্ণমণ্ডলীয় বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে যা বছরে দাঁড়াচ্ছে ১৩ মিলিয়ন হেক্টর। ২০০ বছর আগে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১৬ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার, আজ যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। পৃথিবী থেকে এভাবে ক্রমশ যদি বনাঞ্চল উজাড় হতে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের অস্তিত্ব্বও একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে!

পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে নেমে আসে বিপর্যয়। ধ্বংসের মুখে পতিত হয় প্রাণিকুল। সে চিত্র বড়ই করুণ, বড়ই মর্মান্তিক, üদয়বিদারক। আমরা উপকূলীয় অঞ্চলে সিডর-আইলার ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি। ভয়ঙ্কর সুনামির দানবীয় তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করেছি। হ্যারিকেন স্যান্ডির দাপটের সামনে প্রাণিকুল যে কতটা অসহায় সে চিত্র আমাদের অদেখা নয়। অনুন্নত, উন্নয়নশীল এবং উন্নত কোনো দেশই প্রকৃতির এ রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করতে সক্ষম নয়। তবে এ কথা উল্লেখ করা যায় যে, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির বদৌলতে উন্নত দেশগুলো আগেভাগে খবর সংগ্রহ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় সে দেশগুলোতে প্রাণহানির সংখ্যা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে কম।

পরিবেশ বিপর্যয়ের নেপথ্যের কারণগুলোতে আমাদের ভূমিকা কোনো অংশে খাটো করে দেখার নেই। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে আসছে। জলবায়ুর স্বাভাবিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের পরিবেশ রক্ষার সদিচ্ছা যদি যুক্ত হতো তাহলে আজ যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে তা হয়তো এতো ভয়ংকর রূপ ধারণ করত না।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন