Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বিলুপ্ত প্রায় ঘানি

আনন্দ আলো প্রতিবেদন: আসাদ ঘুম থেকে বেশির ভাগ সময় দেরিতে ওঠে।  আজ তা হয়নি।  সকাল ৬টায় ঘুম ভেঙেছে তার।  ঘুম ভাঙার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে হাসছে সে।  বাড়ির দক্ষিণ পাশের এই ঘরটিতে সপ্তম শ্রেণি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত মহাসুখে কাটিয়েছে সে।  গতকাল ৪ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসে এই ঘরটিতে শুয়ে এক ঘুমে রাত পার করেছে।  ঢাকায় থাকলে রাতে অন্তত তিন চারবার উঠতো সে।  ছেলের ঘুম ভাঙা টের পেয়ে মা জানতে চাইলেন চায়ের সঙ্গে নাস্তায় কি খাবি বাবা।  বাড়ি আসার আগে আসাদ ভেবে রেখেছিল এই চারটা দিন সে পছন্দের খাবার খাবে আর শুধু ঘুমাবে।  মায়ের অসুস্হতা দেখে সেটা আর বলতে ইচ্ছে করছে না তার।  মাকে শুধু বলল, ঘানিভাঙা সরিষার তেল দিয়ে তোমার হাতে মাখানো মুড়ি ও চা খাবো।  কতদিন এই মজার খাবারটি খাইনি।  মা চমকে উঠে বললেন, ঘানিভাঙা সরিষার তেল কোথায় পাবো বাবা? এ অঞ্চলে কোথাও আর ঘানি নেই।  বাজারের কাছে যাও একটা ছিল সেটাও একবছর হলো বন্ধ হয়ে গেছে।  কিছুদিন আগে তোর কাছে যে সরিষার তেল পাঠিয়েছিলাম সেটা তোর বাবা মেশিনে ভাঙিয়ে এনেছিলেন।

মার মনটা খারাপ হয়ে গেল।  আহারে কত দিন পর ছেলেটা বাড়ি এসেছে অথচ সামান্য ঘানিভাঙা তেলে মুড়ি মাখানো খাওয়াতে পারছেন না মা।  মায়ের কষ্টমাখা মুখ দেখে আসাদের যেন কান্না পেয়ে গেল।  মায়ের মন ভালো করার জন্য বলল মা যে তেল আছে সেটা দিয়েই মুড়ি মাখাও।

তোমার হাতে মাখানো মুড়ি বলে কথা।  এখানে তেল কোনো বিষয় না।  আসাদ খুব পিকুলিয়ার স্বভাবের।  একবার কোনো বিষয় তার মাথায় ঢুকলে শেষ না দেখে ছাড়ে না।  এ মুহূর্তে তার মাথায় ঢুকেছে ঘানিভাঙা সরিষার তেল।  দিনাজপুরে তার এক ফটো জার্নালিস্ট বন্ধু কবীরকে ফোন করল।  আচ্ছা কবীর তোদের ওখানে কী ঘানিভাঙা সরিষার তেল পাওয়া যায়? খবরটি আজ না হলেও কাল জানিয়ে দিলেই হবে।

কবীরের মাথায় ছবি, ক্যামেরা, লেন্স ছাড়া আর কিছু নেই।  মনে হলো আসাদের কাছে ঘানিভাঙা সরিষার তেলের কথা সে প্রথম শুনল।  আশ্চর্য হয়ে বলল, ঘানি।  কিসের ঘানি? ঘানির কোনো ছবি লাগবে তোর? আমার আর্কাইভ খুঁজে দেখতে হবে ঘানির কোনো ছবি আছে কিনা।  মনে হয় ছবি নিশ্চয় আছে।  ছবি পেলে তোকে মেইল করবো।  আসাদ ফোন কেটে দিল।  না হলে কম করে হলেও আধা ঘণ্টা ঘানির ছবির নিয়ে নানান তথ্য উপাত্ত উপস্হাপন করতো কবীর।

05_2শুধু কবীর না কোথায় ঘানিভাঙা সরিষার তেল পাওয়া যায় তা জানার জন্য চট্টগ্রামের মুনীর, ফেনীতে মোহাম্মদ আলী, বরিশালে সুশান্ত এবং ময়মনসিংহের বন্ধু ফারুককে ফোন দিল আসাদ।  সবারই একই প্রশ্ন পৃথিবীতে এতো বিষয় থাকতে ঘানিভাঙা সরিষার তেল নিয়ে জানার আগ্রহ কেন? আসাদ বলল, আমাদের মা খালারা যে সুস্বাদু খাবার তৈরি করতেন একসময় তার নেপথ্যে ছিল ঘানিভাঙা সরিষার তেলের কারিশমা।  সেই বিশুদ্ধ তেল এখন কেন পাওয়া যায় না সেটা জানা অবশ্য জরুরি।

এই গল্পের বাস্তবতা আছে।  কারণ আক্ষরিক অর্থেই এখন ঘানিভাঙা সরিষার তেল বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না।  একসময় বাংলাদেশের শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত খাঁটি সরিষার তেল বলতে ঘানিভাঙা সরিষার তেলকে বোঝানো হতো।  এখন সময় বদলে গেছে।  সময়ের সাথে সাথে তেলের বাণিজ্যিক ভাবনারও পরিবর্তন হয়েছে।  একসময় ঘানিতে ১০ কেজি সরিষা ভাঙিয়ে তেল পাওয়া যেত ৪/৫ কেজি।  প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে হাটেবাজারে ছিল ঘানি।  কলু সম্প্রদায়ও বাণিজ্যিকভাবে ঘানিতে তেল উৎপাদন করে বিক্রি করতো।  কিন্তু তেলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘানিতে ভাঙানো সরিষার তেল চাহিদা পূরণ করতে পারছিল না।  সঙ্গত কারণে ঘানির জায়গায় আসন গেড়েছে আধুনিক ইলেকট্রিক মেশিন।  যে মেশিনে একমন সরিষার তেল উৎপাদন করতে সময় নেয় মাত্র আধা ঘন্টা।  ঘানিতে এই পরিমাণ সরিষা ভাঙতে সময় লাগতো দুইদিন কখনও তারও বেশী সময়।  বর্তমানে বাজারে যে সরিষার তেল পাওয়া যাচ্ছে তার একশত ভাগ সরিষার তেল মেশিনের মাধ্যমে উৎপাদন করা হচ্ছে।

08_1বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এখন আর দেশের কোথাও ঘানিতে বাণিজ্যিকভাবে সরিষার তেল উৎপাদন করা হয় না।  এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে সেটা সম্ভবও নয়।  তাছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন ঘানি নেই বললেই চলে।  দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে কিছু ঘানি থাকলেও সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে কোনো তেল উৎপাদন করে না।  অনেক ভোজন রসিক আছেন যারা ঘানিভাঙা সরিষার তেলের স্বাদ নিতে চান।  তারা টিভি বা পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে সরিষার তেল কিনে নেন কিন্তু সেই তেল যে ঘানিভাঙা নয় তা অনেকেই বুঝতে পারেন না।

আধুনিক মেশিনে অল্প সময়ে সরিষার তেল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে দেশে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কয়েক ডজন।  এর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের দাবি তারা ঘানিতে তেল উৎপাদন করে বাজারজাত করছেন।  এই দাবি কতটা সত্য সেটা নিয়ে নানান প্রশ্ন রয়েছে।  বর্তমানে বাজারে যে যে প্রতিষ্ঠান সরিষার তেল উৎপাদন করে থাকে তাদের প্রতি মাসে তেল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা কয়েক লাখ লিটার।  প্রশ্ন হচ্ছে ঘানিতে কী এই বিপুল পরিমাণ তেল উৎপাদন করা সম্ভব? তবে এটা সত্য যে দেশে এখন আর কোথাও ঘানিতে সরিষার তেল উৎপাদন করা হয় না।  গত কয়েক বছরে যাও টিকে ছিল সেটাও এখন প্রায় বিলুপ্ত।