Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বসত বাড়ি নিয়ে মাসুদুর রহমান খানের যত স্বপ্ন

মাসুদুর রহমান খান। বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান স্থপতি। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থাপত্য অঙ্গনে দৃপ্ত পদচারনা তার। সার্বজনীনতা, দেশপ্রেম, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে স্থাপত্যশিল্পে কাজ করে যাচ্ছেন। আন্তরিক সদিচ্ছা, দৃঢ় মনোবল ও উৎসাহ এবং কঠোর পরিশ্রম তাকে আজকের অবস্থানে এনেছে। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯২ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপত্য অধিদপ্তরে যোগ দেন সহকারি স্থপতি হিসেবে। সেখানে তিনি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আট বছর কাজ করেন। ২০০১ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘বসত আর্কিটেক্টস ইঞ্জিনিয়ার্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বনামধন্য এই আর্কিটেক্ট বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন তৈরি করেছেন। ঢাকা শহরের সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য ২০০৬ সালে তার প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর বিউটিফিকেশন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। তিনি বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট এর সহ সভাপতি ছিলেন। জাতীয় হকি দলের একজন সাবেক খেলোয়াড়। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি তে স্বনামধন্য এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক
বাংলাদেশের স্থাপত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। স্থপতিরা তাদের ব্যক্তিগত অনুশীলনে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। তাদের অবদানে বাংলাদেশী স্থাপত্য বৈচিত্র্যময় হয়েছে। সমসাময়িক স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন, নান্দনিক এবং প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত। আর এ কারণেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশি স্থপতিদের সুনাম অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমাদের সর্বদা মনে রাখা উচিত একটি ভালো নীতি এবং পরিকল্পনা ছাড়া একটি সম্পূর্ণ রূপে সঠিক স্থাপত্য তৈরি করা যায় না। এ কথা গুলো বললেন স্বনামধন্য স্থপতি মাসুদুর রহমান খান।
মাসুদুর রহমান খানের জন্ম ময়মনসিংহ শহরে। আদিভিটা নেত্রকোনা জেলার মদনপুর গ্রামে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহে। ফলে এক সময়ে শিল্প সংস্কৃতির চারণ ভূমি বলে খ্যাত এই শহরের একজন হিসেবে তিনি গর্ববোধ করেন। বাবা মো: মহিউদ্দিন খান ছিলেন তৎকালিন ময়মনসিংহ জেলার সুপরিচিতও স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ী চার ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার বড় মাসুদ ছোটবেলা থেকেই নেতৃত্ব দেয়ার মতো গুণ নিয়ে বড় হতে থাকেন। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাই মাসুদ থাকতেন সবার আগে।
১৯৭৯ সালে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৮১ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের ছাত্র হয়েও তার খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড থেমে ছিল না। একজন দক্ষ হকি খেলোয়াড় হিসেবে মাসুদকে ক্যাম্পাসে সবাই এক নামেই চিনতেন। বুয়েট হকি লীগ ছাড়াও ঢাকা লীগে তিনি হকি খেলতেন। আজাদ স্পোটিং ক্লাব, ময়মনসিংহ জেলা ও যুব হকি দলে তিনি টানা ৯ বছর খেলেছেন। ১৯৮৮ সালে বুয়েট থেকে স্নাতক পাস করে, ১৯৯২ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। স্থাপত্য অধিদপ্তরের অ্যাসিসটেন্ট আর্কিটেক্ট হেিসবে টানা আট বছর চাকরি করার পর ছেড়ে দিয়ে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সে সময় বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন করে সুনাম কুড়ান। সরকারি চাকরিরর নানা প্রতিবন্ধকতা ছেড়ে নিজে স্বাধীন ব্যবসা করার মানসে গড়ে তোলেন বসত আর্কিটেক্টস ইঞ্জিনিয়ার্স নামের একটি ফার্ম। চাকরির শেষ পর্যায়ে প্রথম কাজ পান বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ভবনের। ওই সময়ের নান্দনিক বিবেচনায় যেটি ছিল উল্লেখযোগ্য। ২০০২ সালে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের সমাধি কমপ্লেক্স এর কাজ পান। ২০০৪ সালে এটি শেষ করেন নান্দনিক বিবেচনায় কাজটি বোদ্ধা আর্কিটেক্টদের সুনাম অর্জন করেন। এরপর ২০০৬ সালে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘বসত’ প্রধানমন্ত্রীর বিউটি ফিকেশন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। নানামুখী কাজ করে বসত আর্কিটেক্টস ইঞ্জিনিয়ার্স এখন একটি স্বনামধন্য কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান। যার কর্নধার মাসুদুর রহমান খান নিজেই।

মাসুদুর রহমান খান

মাসুদুর রহমান খানের কাজের ধারাই হলো সার্বজনীনতা। অর্থাৎ সবার জন্য উম্মুক্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানকে জনসমক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা। এই চেষ্টাই তাঁর কাজকে ভিন্নতা দিয়েছে। আর তাই মাসুদুর রহমান খানের প্রতিটি কাজই হয়ে উঠেছে দর্শনীয় ও আকর্ষনীয়। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ভবন, মিরপুরে শেরেবাংলা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, সেগুন বাগিচায় জনস্বাস্থ্য ভবন, সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, পটুয়াখালিতে পায়রা পাওয়ার প্ল্যান্ট এর মাস্টার প্ল্যান, এবং অন্যান্য স্থাপনা, বিশেষ করে পায়রা পুনর্বাসন প্রকল্পটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। জামালপুরের জেলা স্টেডিয়াম, শেখ কামাল ফুটবল স্টেডিয়াম, ওমেন স্পোটার্স কমপ্লেক্স, সুইমিংপুল এন্ড জিমনেশিয়াম কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম ডিভিশনার সুইমিংপুল, কুয়াকাটাতে রিসোর্ট হোটেল সীহ্যাভেন, দেশের বাইরে উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে- ভারতের গোয়াতে গোয়াইনডোর স্টেডিয়াম, গোয়া হকি স্টেডিয়াম, গুলশানে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের আভ্যান্তরিন নকশা নির্মাণ কাজ, বনানীতে এনডিই কর্পোরেট বিল্ডিং, ক্ল্যাসিক সেন্টার, ইস্ট ওয়েস্ট ইন্ডিস্ট্রিয়াল পার্ক লিমিটেড সহ অসংখ্য স্থাপনার ডিজাইন করেছেন। তাঁর চলমান কাজের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম এর সংস্কার ও উন্নয়ন, শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম, মানিকগঞ্জ ক্রিকেট স্টেডিয়াম, কক্সবাজার স্টেডিয়াম, গোপালগঞ্জ স্টেডিয়াম, সিলেট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, ইত্যাদি। এছাড়াও বর্তমানে তিনি বেশ কিছু নতুন প্রকল্পের কাজ করছেন। স্থপতি মাসুদুর রহমান খান তার কাজের ক্ষেত্রে সার্বজনীনতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে মুক্তচিন্তা, পেশার প্রতি অবিচল থেকে তিনি এ দেশের স্থাপত্য শিল্পে সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে মাসুদের প্রতিটি ডিজাইনই হয়ে উঠেছে আকর্ষনীয় ও দৃষ্টিনন্দন ও দর্শকপ্রিয়।
কার অনুপ্রেরণায় আপনার ক্রীড়া জগতের স্থাপত্যে আসা? এ প্রশ্নের উত্তরে খ্যাতিমান স্থপতি মাসুদুর রহমান খান বলেন, আমি সেই ছাত্র জীবনে থেকেই খেলা ধুলার সঙ্গে অতোপ্রত ভাবে জড়িত ছিলাম। কেননা পৃথিবীর অন্যান্য কর্মকান্ডের

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, সেগুনবাগিচা, ঢাকা

ভেতর এই বিষয়টিকেই আমার কাছে অনেক স্বচ্ছ এবং সুস্থ প্রতিযোগিতা হিসেবে মনে হতো। আর এটার মধ্যে সুস্থতা এবং সুস্থতার সঙ্গে সুস্থ মনের একটা সম্পর্ক রয়েছে। স্কুল, কলেজ জীবনে এবং ময়মনসিংহ জেলা দলের হয়ে বহু টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে সাফল্য অর্জন করি। সবচেয়ে বড় কথা আমি একজন জাতীয় হকি খেলোয়াড় ছিলাম।
আমি সব সময় এটা বিশ্বাস করি যে একটি দেশ বা জাতি কতটুকু উন্নত, সেটা তার খেলাধুলার মানের উপর অনেক খানি নির্ভরশীল। তাই আমি দেশের ক্রীড়া অঙ্গনের মান উন্নয়নের ব্যাপারে সব সময়ই চিন্তা করি। সৌভাগ্যক্রমে ২০০৪ সালে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের কাজ পাওয়ার মধ্য দিয়েই বড় পরিসরে ক্রীড়া কাঠামোর আনুষ্ঠানিক ডিজাইন কাজ শুরু হয়। সম্ভবত নিজের ক্রীড়া চর্চার পাশাপাশি ক্রীড়ামোদী এবং ক্রীড়াসংগঠক হওয়ার কারণেই প্রকৃতিগত ভাবেই নিজের আনন্দ এবং আগ্রহ থেকে ক্রীড়া জগতের স্থাপত্যে আমার আজকের অবস্থান।
নতুন প্রজন্মের স্থপতিদের উদ্দেশ্যে স্থপতি মাসুদুর রহমান খান বলেন, আমাদের সময়ে শুধু বুয়েটে স্থাপত্য শিক্ষা পড়ানো হতো। ফলে বড় জোড় ৩০/৩৫ স্থপতি প্রতিবছর স্থাপত্য পেশায় নিয়োজিত হত। সে জায়গায় বর্তমানে ২০/২২টি বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রতিবছর তিন চার শত স্থপতি বের হচ্ছেন। সংখ্যায় বেশি হওয়ার কারণে বর্তমান নতুন প্রজন্মের স্থপতিদের গুণগত মান নিয়ে সংশয় থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এছাড়া স্থাপত্য পেশায় কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তাই বর্তমান স্থপতিদের কাছে প্রথম পরামর্শ হলো স্থাপত্য পেশায় নিজের অবস্থান তৈরি করতে হলে তাদের পরিশ্রমী ও মনোযোগী হতে হবে। দ্বিতীয়ত ঃ যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চর্চায় নির্মাণ ক্ষেত্রে বাস্তব ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার সুযোগ কম থাকে সেজন্য তাদেরকে গতানুগতিক চাকরি কিংবা পেশা চর্চার বাইরে ব্যবহারিক নির্মাণ কাজের চ্যালেঞ্জে নিয়োজিত হওয়া উচিত। তাহলে পরবর্তীতে তাদের স্থাপত্য চর্চায়, নকশা প্রণয়নে ওই ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস তৈরি করবে। সর্বশেষে বলবো, তাদের নকশা প্রণয়নে গতানুগতিক ব্যবহারিক সমাধানের বাইরে নতুন কিছু সংযোজন কিংবা দেয়ার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। যেটাকে আমরা বলে থাকি আর্কিটেকচার প্লাস। এছাড়া প্রতিনিয়ত সফল এবং উল্লেখযোগ্য স্থপতিদের স্থাপত্য কর্ম পরিদর্শন এবং পর্যবেক্ষণ যে কোনো স্থপতিদের সৃষ্টিশীল স্থাপত্য চর্চার ক্ষেত্রে একান্ত অপরিহার্য একটি বিষয়। মনে রাখতে হবে ‘যত পরিদর্শন তত জ্ঞান অর্জন’। তবে আমরা যত পারি দেখব, শিখব, কিন্তু নকশা প্রণয়নে নিজস্ব ভাবনা, সৃষ্টিশীলতা এবং বিচক্ষণতার প্রতিফলন থাকবে, তবেই সৃষ্টি হবে নিজস্ব আত্মতৃপ্তিপূর্ণ সার্থক স্থাপত্য কর্ম।
১৯৮৬ সালে তিনি বিয়ে করেন নাহিদ ফাতেমা খানকে। চার সন্তানের ভেতর বড় মেয়ে আদৃতা মাহিন খান। সে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। ছেলে মাসরুর রহমান খান ও লেভেল দিচ্ছে। মাহির ও মাহরুজ যমজ দুই ছেলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশোনা করেছেন। এই স্থপতি তার কাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে ভালোবাসেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি মাসুদুর রহমান খান বলেন, এই স্থাপত্য শিল্পর্চ্চাকে আপামর জনগনের মাঝে পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করছি। করতে আশা পোষন করে এই স্থপতি। যে কোনো ভালো কাজ মানুষের মাঝে অনেক দিন বেঁচে থাকে। এভাবনায় কাজের প্রতি ভালোবাসা আর মমত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে যেতে চান আগামীর দিন গুলোতে।