Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

এগ্রো ট্যুরিজম ডিজাইন নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসায় গড়া জাদুকাটা স্টুডিওজ

আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়ে স্থাপত্য শিল্পে যারা সৃষ্টিশীল কাজ চলেছেন তাদের মধ্যে রেজা নূর মুঈন ও জাকোয়ান সালওয়া তাকরিম অন্যতম। তারা স্বামী-স্ত্রী। দুজনেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর স্থাপত্য বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। তাদের রয়েছে ‘জাদুকাটা স্টুডিওজ’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। এই ফার্মের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন স্থপতি রেজা নূর মুঈন। আর পার্টনার হিসেবে আছেন স্থপতি জাকোয়ান সালওয়া তাকরিম। ইতোমধ্যে এ প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছে। এবার আনন্দ আলোর ভ্যালেন্টাইন সংখ্যায় শাহ্ সিমেন্ট ‘নিমাণে আমি’তে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
স্থপতি রেজা নূর মুঈনের গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলায়। সেখানেই তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। রেজার বাবার নাম মো: মুঈন উদ্দীন। তিনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা রোকশানা মুঈন একজন গৃহিনী। তিন ভাইবোনের মধ্যে রেজা সবার বড়। স্কুল জীবন থেকে ক্রিয়েটিভ কিছু করার প্রতি রেজার ভালোবাসা জন্মায়। সেই ভালোবাসা থেকেই আর্কিটেক্ট হওয়া তাঁর। রাজশাহী গভর্মেন্ট ল্যাবরেটরী হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ২০০৭ সালে। ২০০৯ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে কৃতিত্বে সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর স্থাপত্য বিভাগে। রেজা নূর মুঈন ছাত্রাবস্থায় ২০১৪ সালে জাদুকাটা স্টুডিওজের প্রতিষ্ঠা করেন। স্থাপত্যে স্নাতক সম্পন্ন করতে করতেই জাদুকাটা ইন্টেরিয়রের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট, ফুড জয়েন্ট, অফিস এবং বাড়ির অন্দর সজ্জার কাজ করেন বন্ধুদের সাথে নিয়ে। প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে স্থপতি নাকিব সাদাত চৌধুরী, স্থপতি আহমেদ হাসিব বুলবুল এবং স্থপতি জাকোয়ান সালওয়া তাকরিম ছিলেন রেজা নূর এর সঙ্গী হিসেবে। রেজা নূর মুঈন ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন ২০১৫ সালে। পাস করার ১ বছর পর ঢাকায় ফিরে এসে তিনি যোগ দেন দেশের শীর্ষস্থানীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘জে এ আর্কিটেক্টস লিমিটেড এ’। সেখানে স্বনামধন্য স্থপতি জালাল আহমেদের সাহচর্য পান। কালের পরিক্রমায় বর্তমানে স্থপতি রেজা এবং তাকরিম প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন এবং ‘জাদুকাটা স্টুডিওজ’ নামে পূর্ণাঙ্গ ডিজাইন সলিউশন প্রদান করে যাচ্ছেন। জার্মানী থেকে ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচারে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে সেখানেই স্কেপ এ কর্মরত আছেন বন্ধু নাকিব সাদাত। সুযোগ পেলেই তিনি কোলাবোরেট করেন জাদুকাটার সাথে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর স্থাপত্য বিভাগে পড়ার সময় জাকোয়ান সালওয়া তাকরিমের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর প্রেম-ভালোবাসা। অবশেষে ২০১৭ সালে তারা দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তইমুর রেজা এই স্থপতি দম্পতির একমাত্র সন্তান।

রেজা নূর মুঈন ও জাকোয়ান সালওয়া তাকরিম

স্থপতি জাকোয়ান-সালওয়া তাকরিমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। তাকরিমের বাবার নাম নাজিম উদ্দীন। তিনি চাকরীজীবি ছিলেন। মা নার্গিস ফাতেমা একজন স্কুল শিক্ষিকা। দুই বোনের মধ্যে তাকরিম বড়। কুসুম কুমারীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ২০০৭ সালে। ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বে সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর স্থাপত্য বিভাগে। ২০১৫ সালে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তাকরিমও চট্টগ্রামের ফিয়ালকা লিমিটেড ছেড়ে ‘জে এ আর্কিটেক্টস’এ কাজ করেন। রেজা নূর মঈন যোগ দেন র‌্যাংগস গ্রুপে ইন্টেরিয়র ডিজাইন লিড হিসেবে। সেখানে দীর্ঘ সময় কাজ করে অবশেষে নিজেদের আর্কিটৈকচারাল ফার্মে মনোনিবেশ করার সুযোগ পান।
জাদুকাটা স্টুডিওজ এর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে গাজীপুর ভাওয়াল উদ্যানে একটি পরিবেশ সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠিান সিসিএ’র জন্য নির্মিত টার্টেল কনজারভেশন সেন্টারের ফিল্ড রিসার্চ স্টেশন ও ডমিটরি, উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের দেশি মুরগীর খামার বাড়ি, বৃহত্তর সিলেট এ নির্মানাধীন দেশের প্রথম বার্ড পার্ক ও এগ্রো বেইজড ইকো রিসোর্ট, সেইন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি ইকো রিসোর্ট, কুড়িলে টেক স্টার্টাপ এপন্যাপ লিমিটেড, মিরপুর ডিওএইচএস-এ টেককেয়ার লিমিটেড, বনানীতে চিত্র গল্পের অফিস, নিকুঞ্জ-১ এ মোবাইল জার্নালিজম বাংলাদেশ টাইমসের নিউজরুম, গুলশান-১ এ প্রোভিটা গ্রুপের চেয়ারম্যানের রেসিডেন্স ট্রিপ্লেক্স, চুনাতি ভ্যাকেমন হাউস, জাপানিস স্টাইলের ইন্টেরিয়র সহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প। বর্তমানে জাদুকাটা স্টুডিওজ এবং দ্য ভিঞ্চি লিমিটেড কোম্পানীর মাধ্যমে মাল্টি ডিসপ্লিনারি ডিজাইন, টার্ন-কি কন্সট্রাকশন এবং আইটি রিলেটেড কাজ করছেন এই দম্পতি।
স্থপতি রেজা নূর মুঈন বলেন, জাদুকাটা স্টুডিওজ স্থাপত্যকর্মে ও চিন্তায় সব সময় প্রকৃতি পরিবেশ, সমাজ এবং সংস্কৃতিকে মাথায় নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছে। প্রতিটি ডিজাইনের পেছনে ক্লায়েন্টের চাহিদা, গল্প, ব্যক্তিত্বের একটি ছাপ রাখার চেষ্টা করা হয় এবং তাতে প্রতিটি ডিজাইন হয়ে ওঠে অনন্য। আমাদের দেশে ডিজাইনকে শুধু নান্দনিকতার দিক থেকে সাধারনত বিবেচনা করা হলেও জাদুকাটা প্রতিটি প্রজেক্টককে কিছু সমস্যার সমষ্টি দেখতে পছন্দ করে এবং মূলত সেই সমস্যা গুলোর সমষ্ঠিগত সমাধান দিয়েই ডিজাইন চিন্তা গুলো ফুটে ওঠে। স্বাস্থ্যকর লাইফ স্টাইলের জন্য অধিকতর দিনের আলোর ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, যেখানে সুযোগ আছে সেখানে ন্যাচারাল ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে, প্যাসিভ ডিজাইনে এসির ব্যবহার হ্রাস করে এনার্জি সেভিংসের সুযোগ তৈরি, অন্দর সজ্জার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মাঝে সংযোগ বৃদ্ধির জন্য আরো ইনক্লুসিভ লেয়াউট প্রদান, প্রো-একটিভ থাকার জন্য ছাদ বাগান ভার্টিকাল বারো ওয়ালা ছাদ কৃষি ইত্যাদি তাদের ডিজাইনে অন্তভুর্ক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়। কর্মক্ষেত্রে মানুষ জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যয় করে। তবে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ জাকজমক পূর্ণ হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা হয়ে থাকে অস্বাস্থ্যকর। জাদুকাটা ইফিশিয়েন্ট ওয়ার্ক স্পেস ডিজাইনে স্পেশালাইজড সার্ভিস দিয়ে থাকে সেখানে কর্মীদের মানষিক এবং শারিরীক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে নানারূপ পদক্ষেপ নেয়া হয় যা আদতে কাজের এফিশিয়েন্সি বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠানের লাভ হয়েই ফিরে আসে। দীর্ঘ সময় অপ্রতুল আলো কিংবা অনুপযুক্ত ভাবে বসে কাজ করার মাধ্যমে আমরা নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরে যাচ্ছি যা খুব সহজেই সমাধান করে নেয়া সম্ভব ডিজাইনের মাধ্যমে। জাদুকাটা এই স্থপতি যুগল ঘুরে বেড়াতে অসম্ভব ভালোবাসা ভালোবাসেন গান গাইতে, রান্না করতে এবং আড্ডা দিতে। ঢাকা শহরের কোলাহল থেকে দূরে ১৮ নম্বর সেক্টরে তাদের স্টুডিও অফিস। সুযোগ পেলে শহর থেকে আরো দূরে চলে যান তাঁরা। রেজা নূর মঈন আনন্দ পান বন্যপ্রাণির ছবি তুলতে এরিয়াল ভিডিও গ্রাফি এবং লোকগান লোক গাঁথা সংগ্রহ করতে। জাকোয়ান সালওয়া কথা শিল্পী মুনমুন আহমেদের একজন ছাত্রী ছিলেন। তিনি শাবিপ্রবি স্থাপত্য বিভাগের এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন ‘আশা’র সাংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক এবং আজ মুক্তমঞ্চের সাবেক সহ সভাপতি।
বর্তমানে এগ্রো-বেইজড ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে জাদুকাটা স্টুডিওজ। বাংলাদেশের কৃষি খাতকে সমুন্নত রেখে সচরাচর ট্যুরিজম সাইট গুলোর ওপর চাপ কমিয়ে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় জনপ্রিয় এগ্রো বেইজড ট্যুরিজমকে জনপ্রিয় করতে এডভোকেসি করছেন স্থপতি রেজা নূর মঈন এবং স্থপতি জাকোয়ান সালওয়া। বৃহত্তর সিলেট, সেন্ট মার্টিন-দ্বীপ, কুমিল্লা ও নওগা জেলায় বেশ কয়েকটি এগ্রো-ট্যুরিজম, অবকাশকেন্দ্র প্রজেক্টের ডিজাইন/প্লানিং নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছেন স্থপতি এই দম্পতি। সঠিক ভাবে এক্টিভিটি ডিজাইনের মাধ্যমে একটি ধানক্ষেতকেও অন্ত্যন্ত মনমুগ্ধকর পর্যটন-অবকাশ কেন্দ্রে পরিণত করা যায়। স্থানীয় কমিউনিটি এবং অর্থনীতিতে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। স্থপতি জাকোয়ান সালওয়া তাকরিম ভব্যিষতে ট্যুরিজম, হ্যান্ডিক্রাফট নিয়ে প্রান্তিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সাথে কাজ করতে চান। রেজা নূর তার ভাষ্যে ‘ম্যানেজেবলি স্মল’ থেকে কর্ম ও জীবন উপভোগ করতে বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন আমাদের নদী বিধৌত পলির ব-দ্বীপে উর্বর মাটি ও কৃষিই সবচেয়ে বড় শক্তি। আধুনিক প্রযুক্তি, পরিকল্পনা এবং ডিজাইনের মাধ্যমে দেশের মানুষ ও পরিবেশের জন্য কাজ করে যেতে চান তিনি।