Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্থপতি এবং স্থাপত্য গড়ার কারিগর নাজিমউদ্দীন পায়েল

আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়ে স্থাপত্য শিল্পে যারা সৃস্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে অন্যতম এস. এম. নাজিমউদ্দীন পায়েল। ২০০০ সালে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিন থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ডিসিপ্লিনেই সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থাপত্য চর্চা করে যাচ্ছেন নিয়মিত। ইতোমধ্যে তিনি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন করেছেন এবং স্থাপত্যকর্মে জাতীয় পর্যায়ে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছেন। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
স্থাপত্যের শিক্ষার্থীদের কাছে খুব প্রিয় শিক্ষক এস এম নাজিম উদ্দীন পায়েল। বর্তমান সময়ের একজন খ্যাতিমান স্থপতিও। রাজধানী ঢাকা থেকে বহুদূরের শহর খুলনায় দীর্ঘ ২২ বছর ধরে ওখানকার মানুষকে পরিচিত করছেন সমকালীন স্থাপত্যরীতির সঙ্গে। খুলনা অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় রয়েছে তার নান্দনিক স্থাপত্য কর্মের উপস্থিতি। শুধু নান্দনিক স্থাপত্যই নয়, এই অঞ্চলের উন্নয়নে দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন নিয়মিত ভাবে কারিগরি মতামত ও সহযোগীতা করে আসছেন। এর পাশাপাশি স্থাপত্য ঐতিহ্য সংরক্ষনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ গবেষনা করে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক খুলনা শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থিক সহায়তায় একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে যা ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। স্থপতি এস এম নাজিম উদ্দীন পায়েল ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন ২০০০ সালে।
পাস করে বের হওয়ার পরই পায়েল যোগ দেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনেই শিক্ষক হিসেবে। বর্তমানে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের তিনি স্থাপত্যের নানা বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থাপত্য চর্চার সঙ্গে জড়িত আছেন। তিনি সবখানেই চেষ্টা করেন নিজস্ব রীতিতে কিছু করার। তাই তার প্রতিটি কাজে ফুটে ওঠে আধুনিক স্থাপত্যরীতির ধারা। গত বছর তার দেশে ও বিদেশে সমাদৃত ডিজাইন ‘ভিলেজ সুপার মার্কেট’ পেয়েছে বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট এর কমান্ডেশন অ্যাওয়ার্ড। জাতীয় পর্যায়ের ডিজাইন কম্পিটিশন ও ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রামে তিনি বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ইতোমধ্যে নাজিম উদ্দীন পায়েল দেশের নামকরা কমার্শিয়াল টাওয়ার, অফিস বিল্ডিং, কর্পোরেট অফিস, সর্ববৃহৎ সীফুড ইন্ডাস্ট্রি সহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি, হোটেল, হাসপাতাল, মসজিদ সহ অসংখ্য আবাসিক ভবনের ডিজাইন করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ঢাকার জাহাঙ্গীর গেটের স্বাধীনতা টাওয়ার, উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ ভবন বগুড়াস্থ ডেলটা টাওয়ার, খুলনার ডেলটা টাওয়ার, ভিলেজ সুপার মার্কেট, এডমিনিস্ট্রেটিভ কনভেনশন সেন্টার খুলনা, খুলনার সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ইউসেফ রিসোর্ট এন্ড কনভেনশন সেন্টার ইত্যাদি।
স্থপতি এস এম নাজিম উদ্দীন পায়েল বলেন, আমাদের দেশের একটা বড় অংশ বড় বড় শহরের বাইরে ছোট শহর বা গ্রামে থাকে। তাই আমি অনেক তরুণ স্থপতিকে উদ্বুদ্ধ করছি যাতে তারা তাদের নিয়মিত স্থাপত্য পেশায় পাশাপাশি মূল কেন্দ্রের বাইরে ছোট শহর গুলোতে এমন কী গ্রামাঞ্চলেও স্থাপত্য চর্চার বিস্তার ঘটায়। আমার স্থাপত্য চর্চার শুরুটা ছিল সুবিধাবঞ্চিত নগরের জন্য স্থাপত্য। ভবিষ্যতে ইচ্ছা সরাসরি সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য তথা সবার জন্য স্থাপত্য চর্চার সুফল নিশ্চিত করা।
আপনি স্থাপত্য বিভাগে শিক্ষকতার সাথে জড়িত আছেন। বাংলাদেশের স্থাপত্য বিষয়ে কিছু বলুন? এ প্রশ্নের উত্তরে এস এম নাজিম উদ্দীন পায়েল বলেন, পাঁচ বছরের স্থাপত্য বিষয়ে লেখাপড়া করার পর যে ডিগ্রী অর্জন করি তার বুনিয়াদে আমরা স্থপতি হই। তখন থেকেই আমাদের প্রফেশনাল শিক্ষার জগত শুরু হয় এবং এর ক্ষেত্রটাও বেশ বিস্তৃত। স্থাপত্যে পাশ করার পরে আমরা অনেকে শিক্ষকতা পেশায় থাকি অথবা সরাসরি স্থাপত্য চর্চায় থাকি। এখানে দুইটা বিষয়ই পরিপূরকÑ আমি শিক্ষকতায় আছি অথবা আমি সরাসরি পেশায় আছি এবং এই দুইটারই একটা সমন্বয় দরকার। যারা শিক্ষকতায় থাকবে তাদের উচিত হচ্ছে স্থাপত্য চর্চার ফিল্ডের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা। কারণ আমরা ফিল্ড থেকে জ্ঞান অর্জন করে প্রতিষ্ঠান গুলাতে নিয়ে আসি। এখানে আমাদের শিক্ষা কাজে লাগাই, আবার এখানকার জ্ঞান আমরা ফিল্ডে পাঠাই। কেউ যদি শিক্ষকতায় আসে, আমার অনুরোধ থাকবে তারা যেন স্থাপত্য পেশার সাথে তাদের সম্পৃক্ততা বজায় রাখে এবং খুব দ্রুত উচ্চশিক্ষায় নিজেকে উচ্চশিক্ষিত করে। যে কোনো ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ/বিশেষায়িত কোন বিষয়ে পড়াশোনা করে। আর যারা পাশ করে স্থাপত্য চর্চায় যাচ্ছে তাদের জন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে যে পাশ করার পরেও কিছুদিন তাদেরকে স্থাপত্যের ছাত্র হিসেবেই কাটানো উচিত। স্থাপত্যের এই বিস্তৃত দুনিয়ার জ্ঞান অর্জনটাও খুব জরুরী। সেটা বিভিন্ন মাধ্যমে হতে পারে। যেমনÑ দলগত ভাবে কাজের মাধ্যমে, আবার সিনিয়র স্থপতি যারা আছেন তাদের সাথে দীর্ঘ দিন কাজ করেও বিভিন্ন বিষয়ে বিষদ জ্ঞান অর্জন করা যেতে পারে। এতে করে সে নিজেকে নিজে তৈরী করতে পারবে পরিপূর্ণ একটা প্রকল্প নিজের মতো করে ডিজাইন করার জন্য। প্রতিটি প্রকল্পে ফাংশনাল আসপেক্ট, কনটেক্সট, জলবায়ুর প্রভাব, যুগপযোগী প্রযুক্তি, ক্লায়েন্টদেরকে কিভাবে সার্ভিস দিতে হয় এ বিষয় গুলো জানা খুবই জরুরী। তবে সব ক্ষেত্রেই অনেক কাজ করতে হবে, প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে পাশ করার পর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। আমার তো মনে হয় শেখার কোনো শেষ নেই। আর তাই শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের শিখতে হবে। তবে প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট একটা সময় তার লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত যে, আমি এই ভাবে এই পদ্ধতিতে কাজ শিখব এবং নিজেকে প্রস্তুত করবো।
তরুণ স্থপতিরা যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ বা উপদেশ? এ প্রসঙ্গে স্থপতি এস এম নাজিম উদ্দীন পায়েল বলেন, অনেক দিন ধরে শুধুমাত্র বুয়েটেই এ দেশে স্থাপত্য শিক্ষার সুযোগ ছিল। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে দ্বিতীয় স্কুল হিসেবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য শিক্ষা চালু হয়। এরপর ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ত্রিশটির মত স্কুলে স্থাপত্য শিক্ষা চালু হয়েছে বলে আমি জানি। স্থাপত্য শিক্ষা শুধুমাত্র লেকচার ভিত্তিক নয় বরং এর বেশির ভাগই হচ্ছে ডিজাইন কেন্দ্রিক, স্টুডিও কেন্দ্রিক। সে ক্ষেত্রে এখানে শিক্ষকের প্রতুলতা, পর্যাপ্ত স্টুডিও স্পেস ও সুযোগ সুবিধাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খুব ছোট একটা লেকচার রুমে আপনি স্টুডিও চালাতে পারবেন না। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত প্রস্তুতি ছাড়াই স্থাপত্য বিভাগ খোলা হচ্ছে এটা ভেবে যে গতানুগতিক ভাবেই অন্যান্য বিভাগের মতো এগুলো চলবে। সে সকল ক্ষেত্রে স্থাপত্য শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশের সকল স্থাপত্য বিভাগের জন্য এই গণগত মানের একটি স্ট্যান্ডার্ড মানদন্ড ও তার স্বীকৃতি নেওয়ার বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটের একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে এবং প্রত্যেক স্কুলকেই সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েই স্বীকৃতি নিতে হয়। যারা এখনো এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আসতে পারেনি তাদেরকে খুব দ্রুত মান নিশ্চিত করে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে আসতে হবে। এটা না করতে পারলে এই অপ্রতুলতার মধ্যে দিয়ে যে সব শিক্ষার্থীরা পাশ করে যাচ্ছে তাদের তো ঘাটতি থেকেই যাবে। যেটা খুব সহজেই পূরণ হবে বলে আমি মনে করি না। এ ব্যাপারে সকলেরই সচেতন হওয়া খুবই দরকার।
আপনি যখন ডিজাইন করেন তখন কোন বিষয়টা মনে রাখেন? এ প্রসঙ্গে স্থপতি এস এম নাজিম উদ্দীন পায়েল বলেন, স্থাপত্য একটি ফাংশনাল আর্ট। প্রথমেই আসে ভবনের ব্যবহারিক বিষয় গুলো, যা নিখুত ভাবে বিন্যস্ত করা প্রয়োজন। এর সাথে সাথে ভবনের আভ্যন্তরীন পরিসর এবং বহিরাবরণ যা আছে সেটাকে এমন ভাবে দেখা উচিৎ যা এই ভবনটিকে একটা নিজস্বতা দিবে। মূলত একটি অবকাঠামোকে স্থাপত্যে রুপান্তর করতে গেলে যে বিষয় গুলো মাথায় রাখতে হবে তা হলো ভবনটির আভ্যন্তরীন পরিসর এবং আচরনের মধ্যে থেকে ব্যবহারকারীর আবেগ, অনুভূতি, জীবনাচরন, ভবনটি যে অঞ্চলে হচ্ছে তার পরিবেশ-প্রতিবেশ, তার নির্মাণ কৌশল, যে সময়ে তা তৈরী হচ্ছে তাকে ধারণ করা এবং এ বিষয় গুলোকে সমন্বয় করা। আমরা দীর্ঘ দিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু সব সময়ে যে সফল ভাবে শেষ করতে পারছি তা বলা যাবে না। আসলে আমি মনে করি শুধুমাত্র একটা প্রোডাক্ট তৈরী করাই না, বরং স্থাপত্য চর্চা হচ্ছে যে বিষয় গুলো উল্লেখ করলাম সেগুলোকে ধারণ করে নিরন্তন একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া।
বর্তমানে আমাদের স্থাপত্য সম্পর্কে স্থপতি নাজিমউদ্দীন পায়েল বলেন, বর্তমানে আমাদের স্থাপত্যের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখবো যে, সে গুলো কিন্তু দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অঙ্গনে বেশ সমাদৃত হচ্ছে। এ বছরেও আগাখান অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছে আমাদের দুটি প্রকল্প। তাছাড়া বেশ নিয়মিত ভাবেই আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রকল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরস্কার পেয়ে আসছে। প্রবীণ স্থপতিদের পাশাপাশি নবীন স্থপতিরাও সুন্দর সুন্দর কাজ উপহার দিচ্ছে যা সত্যিই অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। সব মিলিয়ে আমাদের স্থাপত্যের বর্তমান প্রেক্ষাপট একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করছে।