Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

লুকিয়ে দেখা সিনেমার রাজকুমার বাস্তবের বন্ধু হলেন যেভাবে : ফরিদুর রেজা সাগর

আমি তখন তেজগাঁও পলিটেকনিক হাইস্কুলের ছাত্র। একদিন টিফিন পিরিয়ডে দেখলাম আমাদের ক্লাশের কয়েকজন ছাত্র গোপনে আলোচনা করে হঠাৎ স্কুলের বাইরে চলে গেল। ঘটনা কী? ওরা হঠাৎ চলে গেল কেন? ক্লাশ চলাকালীন এই ভাবে বাইরে যাবার তো নিয়ম নেই। কৌতুহল হচ্ছিলো। পরের পিরিয়ডের মাঝামাঝি সময়ে ওরা ফিরে এলো এবং যথারীতি সমাজ বিজ্ঞান স্যারের কাছে ধরা পড়ে গেল। স্যার ওদেরকে ক্লাশে ঢুকতে দিলেন। তবে শাস্তি স্বরুপ ক্লাশের ভিতর নীল ডাউন করে রাখলেন।
এধরনের পরিস্থিতিতে মন খারাপ হবার কথা। কিন্তু আমার ক্লাশের সেই বন্ধুদের একজনেরও মন খারাপ হতে দেখলাম না। আমার কৌতুহল আরও বেড়ে গেল। ওরা কোথায় গিয়েছিল যে ক্লাশে নীল ডাউন করিয়ে রাখার পরও মন খারাপ করছে না!
ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম- তোমরা ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?
সে বেশ গর্বের সাথে উত্তর দিলÑ একটা জরুরি কাজে গিয়েছিলাম।
-কি এমন জরুরি কাজ যে স্যার ক্লাশে নীল ডাউন করিয়ে রাখার পরও তোমাদের মুখে হাসি দেখতে পাচ্ছি।
-বন্ধুটি বলল- আমরা যে কাজে গিয়েছিলাম তার জন্য নীল ডাউনের শাস্তি কোনো ব্যাপারই না।
-কি এমন কাজ?
-আমরা নায়করাজ রাজ্জাকের বাসা দেখতে গিয়েছিলাম। গর্বের ভঙ্গিতে বন্ধুটি উত্তর দিল।
-আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলামÑ নায়করাজের বাসা কোথায়?
-ওইতো স্কুলের পাশেই… একটা ব্যাংক আছে না, তার পিছনে।
-নায়করাজের দেখা পেয়েছ?
-না। এই সময় কী বাসায় থাকেন? যা ব্যস্ত মানুষ। শুটিংয়ে ছিলেন। তবে রাজ্জাকের বাসা দেখেছি এটাই অনেক আনন্দের।
-তার মানে তোমরা কি এভাবেই প্রতিদিন নায়করাজ রাজ্জাকের বাসা দেখতে যাও?
-হ্যা যাই। আগামীকাল আবার যাব।
-তাহলে তো আবার নীল ডাউন?
-হোক। কোনো অসুবিধা নাই।
পরের দিনও টিফিন পিরিয়ডে আমার ওই বন্ধুরা যথারীতি স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরে এসে আবারও সমাজ বিজ্ঞান স্যারের কাছে ধরা পড়ল এবং নীল ডাউনের শাস্তি পেল। স্যার হুমকি দিলেন অভিভাবকদের ডেকে বিষয়টি জানাবেন। কিন্তু এনিয়ে আমার বন্ধুদের মাঝে কোনো ভয়-ভীতির লেশমাত্র দেখলাম না। বরং ওরা আগের দিনের চেয়ে আরও আনন্দিত। কারণ ওরা নায়করাজ রাজ্জাকের গাড়ি দেখে এসেছে। ওই রকম লেটেস্ট মডেলের গাড়ি নাকি ঢাকা শহরে আর কারও নাই।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, রাজ্জাকের এই গাড়িটি ‘ছদ্মবেশী’ সিনেমায় দেখা গেছে। সুলতানা জামানের সঙ্গে নায়করাজ গাড়িতে চড়ে যাচ্ছেন, আসছেন। গাড়িটি পানিতেও চলে। তাই দেখে আমার সিনেমা পাগল বন্ধুরা অনেকটা অস্থির। যে কোনো মূল্যে গাড়িটা সামনা সামনি দেখতে হবে। যথারীতি ওরা প্রায় প্রতিদিন ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে নায়করাজের গাড়ি দেখতে বের হয়। ফলে নীল ডাউনের শাস্তি বেড়ে গেল। কিন্তু এনিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা নাই। দুশ্চিন্তাও নাই।
টিফিন পিরিয়ডে হুট করে চলে যায়। মাঝে মাঝে আমিও তাদের সঙ্গ দিতে শুরু করলাম। নায়করাজের গাড়ি দেখার আমারও খুব ইচ্ছে। ওই সময় চিত্রালী আর সিনেমা নামে দৈনিক পত্রিকার স্টাইলে দুটি সিনে সাপ্তাহিক প্রকাশ হতো। ব্যাপক পাঠক প্রিয় ছিল পত্রিকা দুটি। একটি পত্রিকায় প্রথম পাতা জুড়ে নায়করাজ রাজ্জাকের একটি বড় ছবি ছাপা হল। একটা দামী গাড়ির সামনে দুই আঙ্গুল উঁচিয়ে ধরে বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন নায়করাজ রাজ্জাক। দারুণ একটা ছবি। আমাদের বাসায় তখনকার দিনে কলিকাতা থেকে নিয়মিত জলসা, নব কল্লোল, উল্টোরথ সহ আরও কয়েকটি পত্রিকা আসত। একদিন দেখেছিলাম জলসার কাভারে কলিকাতার জনপ্রিয় নায়ক বিশ্বজিৎ এর গাড়ির সামনে দাঁড়ানো বিশেষ ভঙ্গির একটি ছবি ছাপা হয়েছে। নায়করাজের ছবির সাথে বিশ্বজিৎ এর ছবি তোলার ভঙ্গি প্রায় একই রকম। বিশ্বজিৎ এর ছবিটি নায়করাজের আগে তোলা। কাজেই ধরে নেয়া যায় কলিকাতার বিশ্বজিৎকে দেখে আমাদের নায়করাজ তার ছবিটা তুলেছেন। ছবিটির ব্যাপারে কৌতুহল বেড়ে গেল। রহস্যটা জানতে হবে। বিশ্বজিৎ আর নায়করাজের ছবির পোজ এক হয় কি করে?
একদিন যথারীতি ক্লাশ ফাঁকি দিয়েই নায়করাজের বাসায় গেলাম। গেটের দারোয়ানকে বললাম, আমরা নায়করাজের সঙ্গে দেখা করব…
দারোয়ান জিজ্ঞেস করলোÑ তোমরা কারা?
আমাদের পরিচয় দিলাম।
আমরা যখন দারোয়ানের সাথে কথা বলছিলাম তখন দেখলাম আমাদেরই বয়সী একজন কিশোর ব্যাপারটা ফলো করছে। এগিয়ে এসে সে সব কিছু শুনল। আমরা তার পরিচয় পেলাম। নায়করাজের শ্যালক। নাম ইয়াকুব। আমাদের স্কুলের উল্টো দিকের আরেকটা স্কুলে পড়ে। সে কথা দিল নায়করাজের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়ে দিবে। পরের সপ্তাহে আসতে বলল।
দারুণ একটা আনন্দ নিয়ে আমরা সেদিন যার যার বাসায় ফিরে এসেছিলাম। নায়করাজের সাথে দেখা হবে, সে যে কী এক্সসাইটমেন্ট সবার মাঝে কাজ করছিলো। বন্ধুরা সবাই নতুন হাফপ্যান্ট, জামা জোগাড় করল। একদিন বেশ সেজেগুজে আমরা আবার নায়করাজের বাসায় উপস্থিত হলাম। তখনকার দিনে মুদির দোকানে ১ আনা দামের চাঁদতারা মার্কা সন্দেশ পাওয়া যেত। এক ডজন চাঁদতারা সন্দেশ কিনলাম। নায়করাজের সাথে আমাদের দেখা হবে। খালি হাতে তো আর দেখা করা যায় না! তাই চাঁদতারা মার্কা সন্দেশ সাথে নিয়েছি। নায়করাজকে উপহার দিব। কিন্তু আমাদের আন্তরিক উদ্যোগ মাঠে মারা গেল। কারণ নায়করাজ সন্দেশ খান না। নায়কদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হয়। তাই মিষ্টি জাতীয় খাবার বারণ করা আছে।
আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল। এত আশা করে সন্দেশ নিয়ে এলাম অথচ নায়করাজ সেই সন্দেশ খাবেন না! একথা সেকথা। আমরা নায়করাজকে বিশ্বজিৎ এর ছবিটা দেখালাম। তিনি ছবিটা দেখে মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, এটা তো আরেকদেশের নায়কের ছবি। আমরা নায়করাজকে প্রশ্ন করলাম, আপনার একটা ছবির সাথে বিশ্বজিৎ এর এই ছবিটা হুবহু মিলে যাচ্ছে। তার মানে আপনি কি বিশ্বজিৎ এর ছবিটা দেখেই… নায়করাজ আমাদেরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, শোন, তোমাদেরকে একটা বিষয় বুঝিয়ে বলি। খোঁজ নিলে দেখা যাবে বিশ্বজিৎ সাহেব হয়তো হলিউডের কারও কাছ থেকে ছবির পোজটা নকল করেছে। তবে এটাকে নকল বলা চলে না। এটাকে বলে সিনিয়রের সাথে সিকুয়েল। আমার অভিনয় জীবনের অন্যতম প্রেরণা বিশ্বজিৎ সাহেব। এখনও মাঝে মাঝে তার মতো করে অভিনয়ের চেষ্টা করি। কতটুকু পারি তা জানি না। যাই হোক সিনেমার প্রতি তোমাদের এতো আগ্রহ দেখে বেশ ভালো লাগল। তোমরা আমাকে, আমার অভিনয়কে পছন্দ কর শুনে আরও খুশি হলাম। মাঝে মাঝে এসো তোমরা… আমাদের সিনেমায় অভিনয়ের জন্য মাঝে মাঝে তোমাদের মতো ছেলে-মেয়েদের প্রয়োজন পড়ে। তোমরা ইয়াকুবের সাথে যোগাযোগ রেখো। তোমাদের কিছু ছবি তার কাছে রেখে দিও। প্রয়োজনে তোমাদেরকে ডাকা হবে। যারা অভিনয়ে ইচ্ছুক তারা তৈরি থেকো।
বন্ধুদের মধ্যে একজন নায়করাজকে সরাসরি প্রশ্ন করলোÑ আমরা তো অভিনয় জানিনা। কিভাবে আমাদের দিয়ে অভিনয় করাবেন?
নায়করাজ মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বললেন, শোন, আমিও সেই অর্থে অভিনয় জানতাম না। খুব ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকেছি, তোমরা কি ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ নামের ছবিটা দেখেছো? ওই ছবিতে বেবী ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসাবে আমার একটি মাত্র দৃশ্য ছিল। পরে জহির রায়হানের ছবিতে নায়ক হয়েছি। আমার স্বপ্ন আগামীতে প্রযোজক হবো। সিনেমার পরিচালক হবো…
আমরা তাকে প্রশ্ন করলামÑ তখন তো আপনি এই ছোট্ট বাড়ি ও সংসারের কথা ভুলে যাবেন। নায়করাজ একটু ভেবে নিয়ে বললেন, সময়ই সেটা বলে দিবে। এখনই আমি এব্যাপারে কিছু বলব না। তবে ঐ যে সংসারের কথা বললে তোমরা। সংসার ভুলে যাবো কেন? সংসার অর্থাৎ পরিবারই হল আসল। তোমরা বড় হলে বুঝবে পরিবারে যদি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পার তাহলে তুমি জীবনে উন্নতি করতে পারবে। পরিবার হল আসল শান্তির জায়গা।
সেদিন নায়করাজ আমাদেরকে তার একটা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। সিনেমা নির্মাণের জন্য একটা প্রডাকশন হাউস বানাবেন। সিনেমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। নাম হবে ‘রাজলক্ষ্মী’। নায়করাজের স্ত্রীর নাম লক্ষ্মী। নায়করাজ বললেন, আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের প্রতীক হবে ঢাকার রাস্তায় রাখা চৌকোনা কাঠের বাতি। এক সময় ঢাকার গুরুত্বপুর্ণ রাস্তায় চৌকোনা কাঠের বাতি রাখা হতো। প্রত্যেক সন্ধ্যায় একজন লোক বাতিতে তেল ভরিয়ে দিয়ে জ্বালিয়ে দিত। ওই বাতিই হবে আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের লোগো। নায়করাজ তার কথা রেখেছেন। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘রাজলক্ষ্মী’র লোগো দেখলেই ঢাকার পুরনো দিনের ছবি ভেসে ওঠে।
দেশীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় দারুণ ভাবে আন্তরিক ছিলেন তিনি। কথা দিলে সে কথা রাখার চেষ্টা করতেন। রাজ্জাক সাহেব আমাদেরকে অভিনয়ের ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। সে কথাও তিনি রেখেছেন। তাজ নামে আমাদের এক বন্ধু ছিল। নায়করাজের ঐকান্তিক আগ্রহে তাজ একাধিক সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে। অধিকাংশ ছবিতে নায়করাজের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছে সে।
নায়করাজ রাজ্জাক ছোটদের জন্য ছবি বানাবেন বলে অনেক স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক আলী ইমামের সাথে এব্যাপারে বহুবার বৈঠক করেছেন। স্ক্রীপ্ট লেখানোর চেষ্টাও করেছেন। নানা কারণে শেষ পর্যন্ত ছোটদের জন্য ছবিটি করা হয়নি তার।
আমাদের ইমপ্রেসের ব্যানারে সামিয়া জামান একটা ছবি বানিয়েছিলেন। নাম ‘আকাশ কত দূরে’। ওই ছবিতে নায়করাজকে অভিনয়ের অফার দিতেই তিনি সানন্দে রাজি হয়ে যান। এটিও একটি ইতিহাস। সময় পেলে আরেকদিন এ ব্যাপারে লিখব। তবে মাঝে মাঝে আমি নিজে খুব অবাক হই। যে নায়কের গাড়ি দেখার জন্য স্কুল পালিয়ে তার বাড়িতে যেতাম সে মানুষটির সাথেই আমার জীবনের অনেকগুলো স্মরণীয় অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। একথা ভেবে মাঝে মাঝে বেশ অবাক হই।
নায়করাজ রাজ্জাক মানেই বাংলা সিনেমার বিরাট এক ইতিহাস। এলাম আর জয় করলাম এমন সহজ ছিল না তাঁর অভিনয় জীবন। অভিনয়ে টিকে থাকার জন্য অনেক সংগ্রাম করেছেন। নায়করাজ উপাধি পেয়েছেন। প্রযোজক থেকে সিনেমার নামকরা পরিচালকও হয়েছেন। নেপথ্যে থেকে ভালো কাজের নেতৃত্ব দেয়ার দুর্দান্ত সাহস ছিল তার। অনেক মানুষের ভীড়ে একজন রাজ্জাক দাঁড়িয়ে আছেন অথবা তাঁর উপস্থিতিই ছিল অনেক সাহস ও প্রেরণার। আমরা যখন বিদেশে শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছি তখন নায়করাজই হয়ে উঠেছেন নেপথ্যের সাহস ও প্রেরণা। চ্যানেল আইকে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠান বলে ভাবতেন এবং সেভাবেই সবসময় পরামর্শ দিতেন।
সিনেমায় রাজ্জাক-কবরী জুটির কথা একটু বলি। একদিন এ ব্যাপারে নায়করাজকে প্রশ্ন করেছিলাম। নায়করাজ একটু ভেবে নিয়ে বলেছিলেন, হ্যা, একথা সত্য আমাদের সিনেমায় রাজ্জাক-কবরী জুটি ছিল অনেকের প্রেরণার উৎস। দর্শক পছন্দ করেছিল বলে এই জুটির সিনেমা দেখার জন্য হলে হলে ভীড় করতো। কিন্তু এ তথ্য কেউই জানেন না যে, এই জুটিকে জনপ্রিয় করতে গিয়ে আমাদেরকে কি কষ্টই না করতে হয়েছে! প্রতিনিয়ত অনেক মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে। এই গল্প লিখলে একটা মহাভারত লেখা হয়ে যাবে। তুমি বুঝে নিও গল্পটা…
নায়করাজের এই কথার অর্থ আমি বুঝি। শাইখ সিরাজ চ্যানেল আইতে বাংলাদেশের সিনেমার স্বর্ণযুগের কালজয়ী গান নিয়ে ‘সেরাকণ্ঠ ফিরে দেখা সেরা গান’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠান ধারন করার সময় শাইখ সিরাজ আমন্ত্রিত অতিথি নায়করাজ ও কবরীকে একাধিকবার হাত ধরে পারফরমেন্স করার অনুরোধ জানালেও তারা হাত ধরেননি। অথচ অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে দু’জন এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন যে তখন আর হাত ধরার কথা বলতে হয়নি। অজান্তে দু’জন দু’জনার হাত ধরেছেন। গানের সাথে অভিনয় করেছেন। এতেই বোঝা যায় তারা দু’জন কত বড় মাপের শিল্পী।
ওই যে বললাম, নায়করাজকে ঘিরে কত যে স্মৃতি উঁকি ঝুকি দিচ্ছে একদিনে তা বলে শেষ করা যাবে না। সব কথা বলব আরেকদিন। একটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখ করে আজকের মতো লেখাটির ইতি টানবো।
ইমপ্রেস এর ব্যানারে ‘আয়না কাহিনী’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ইমদাদুল হক মিলনের গল্প অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করেন তিনি। সুটিং চলাকালে একাধিকবার আমাকে যাবার জন্য অনুরোধ করেছেন নায়করাজ। নানান ব্যস্ততায় যেতে পারিনি। ছবির সুটিং শেষ। অন্যান্য কাজও শেষ। তার মানে ছবি সিনেমা হলে প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত। আমি ছবির ক্যাসেট চাইলাম। কিন্তু রাজ্জাক ভাই তেমন একটা গুরুত্ব দেন না। যতবারই ক্যাসেটের কথা বলি ততবারই জিজ্ঞেস করেনÑ তুমি কবে সময় দেবে?
নানান ব্যস্ততায় আমি সময় ম্যানেজ করতে পারি না। তবুও আমি অনুরোধ করতে থাকি- রাজ্জাক ভাই আপনি কাউকে দিয়ে ক্যাসেটটা পাঠিয়ে দেন। আমি পেয়ে যাব।
রাজ্জাক ভাইয়ের ওই একই কথাÑ তা হবে না। তুমি সময় দাও।
আমি বিনয়ের সাথে বলি, রাজ্জাক ভাই আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? ক্যাসেটটা পাঠিয়ে দিন।
রাজ্জাক ভাই আবারও একই কথা বললেন, আমি এতো কথা শুনতে চাই না। তুমি সময় দাও। আমি আসব ক্যাসেট দিতে।
একটা সত্য কথা বলি। আমি মূলতঃ রাজ্জাক ভাইকে এভোয়েড করছিলাম। দিন শেষে তিনি তো ফিল্মেরই লোক। হয়তো ক্যাসেট দিয়ে বলবেন, বাজেট বেড়েছে। টাকা দাও…
তবুও সময় দিলাম। বললাম, আপনি আসেন। আমি
থাকব।
নির্ধারিত দিনে আমি মিনিস্ট্রিতে একটা কাজে আটকে গেছি। চ্যানেল আই থেকে আমাদের হেলাল খান ফোনে জানাল রাজ্জাক ভাই এসেছেন। ভেবে দেখলাম সহসাই চ্যানেল আইতে আমি পৌছাতে পারব না। হেলালকে বললাম, তুমি রাজ্জাক ভাইকে বুঝিয়ে বল আমি একটা কাজে আটকে গেছি। ক্যাসেটটা যেন তোমার হাতে দিয়ে যান।
কিছুক্ষণ পর হেলাল ফোন করে বলল, রাজ্জাক ভাইকে সে আমার কথা বলেছে। কিন্তু তিনি বলেছেন সাগর না আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব।
মিনিস্ট্রির কাজ শেষ করে দ্রুত অফিসে অর্থাৎ চ্যানেল আইতে এলাম। রাজ্জাক ভাই আমার রুমে বসে আছেন। আমাকে দেখেই সুন্দর করে প্যাকেটে মোড়ানো একটি ক্যাসেট আমার হাতে তুলে দিলেন। প্যাকেটটি এতটাই সুন্দর যে দেখে মনে হল প্যাকেটটি বানাতেও মাথা ঘামাতে হয়েছে রাজ্জাক ভাইকে। একটা ছবির ক্যাসেটই তো। সুন্দর প্যাকেটে না মুড়িয়েও তো দিতে পারতেন। কিন্তু রাজ্জাক ভাই তা করেননি। সুন্দর প্যাকেটে মুড়িয়ে ছবির ক্যাসেট এনেছেন। এতেই বোঝা যায় সিনেমাটি তিনি কতটা দরদ দিয়ে নির্মাণ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে আরেকজন নির্মাতার কথা বলি। রেজানুর রহমান। চ্যানেল আইতে বিজয় এবং স্বাধীনতার মাসে তিনি বছরে দুটি টেলিফিল্ম বানান। তাকেও দেখেছি লাল সবুজ পতাকায় মুড়িয়ে টেলিফিল্ম এর ক্যাসেট আমার হাতে তুলে দিতে।
রাজ্জাক ভাই আমার হাতে তার সিনেমার ক্যাসেট তুলে দিলেন। আমি বিনয়ের সাথে বললামÑ ক্ষমা করবেন। আমারই উচিৎ ছিল আপনার কাছে যাওয়ার…
রাজ্জাক ভাই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, সেটা হয় না সাগর। আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটা নিয়ম আছে। আমি পরিচালক। তুমি প্রযোজক। পরিচালক প্রযোজকের হাতে ছবির ক্যাসেট তুলে দিবেন এটাই নিয়ম। কার কি বয়স, কার কি সম্মান বড় কথা নয়। বড় কথা হল পরিচালক ও প্রযোজকের মধ্যে প্রফেশনাল সম্পর্ক। এই সম্পর্ক যদি বজায় না রাখি তাহলে কনা রেজা আমার ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিটা আবার নতুন করে তৈরি করার সুযোগ নাও দিতে পারে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজ্জাক ভাই ‘অনন্তপ্রেম’ ছবিটা পুণঃনির্মাণ করে যেতে পারেননি। বড় শিল্পীদের এরকম কিছু অতৃপ্তি থাকেই….
রাজ্জাক ভাইকে নিয়ে আরও অনেক অনেক স্মৃতি আর বুকের গভীরে জমা হয়ে আছে। সময় সুযোগ পেলে আরেকদিন লিখব আশাকরি।