Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

এই ঈদে পদ্মা সেতু আনন্দ

রেজানুর রহমান
সোবহান সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবার বরিশালে মেজ ছেলের বাসায় ঈদ করবেন। এই সিদ্ধান্তের পিছনে একাধিক কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হল স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আগে ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে ৬/৭ ঘণ্টা সময় লাগত। আর এখন মাত্র ৩ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়া যায়। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না সোবহান সাহেবের। এও কি সম্ভব? সাত ঘণ্টার রাস্তা মাত্র ৩ ঘণ্টায় পার হচ্ছে মানুষ। এটা কি জাদু নাকি? সোবহান সাহেব নিজের চোখে সব কিছু দেখতে চান। তাছাড়া মেজ ছেলে আখতারুল আলম খুব করে ধরেছে, সোবহান সাহেব এবার যেন বরিশালেই ঈদ করেন। আখতারুল বরিশালের বিএম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের হেড। নিজের গাড়ি আছে। এর আগে একবার বরিশাল থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল আখতারুল। ঢাকায় বড় ছেলে মিজারুলের ধানমন্ডির বাসা থেকে ভোরে ভোরে বরিশালের উদ্দেশে রওয়না হয়েছিলেন। ঢাকা থেকে মাওয়া ফেরিঘাটে আসার পর ওই যে ফেরী পারাপারের যন্ত্রনা শুরু হল, যন্ত্রনা মিটল পাক্কা ৬ ঘণ্টা পর। অর্থাৎ এক নাগাড়ে ৬ ঘণ্টা গাড়ির মধ্যে বসে ছিলেন সোবহান সাহেব। তারপর গাড়ি ফেরীতে উঠল। পদ্মার এপার থেকে ওপারে যেতে সময় নিল ৩৫ মিনিট। এখন পদ্মার এপার থেকে ওপারে যেতে নাকি সময় লাগে মাত্র ৬ মিনিট। এও কি বিশ্বাস যোগ্য কথা? ৬ ঘণ্টার বদলে মাত্র ৬ মিনিট। সোবহান সাহেব এটাই দেখতে চান। ৬ ঘণ্টা কিভাবে ৬ মিনিট হল তাই দেখার ইচ্ছে। সে জন্য আখতারুল ফোন করার সাথে সাথেই বরিশালে যাবার জন্য রাজি হয়ে যান।
বড় ছেলে মিজারুল অবশ্য কিছুটা মনক্ষুন্ন হয়েছে। সে ভেবেছিল সোবহান সাহেব এবার ঢাকাতেই ঈদ করবেন। সেজন্য ১৫ দিন আগেই রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন সোবহান সাহেব। তার পছন্দ মত কোরবানীর গরু কেনা হয়েছে। অথচ তিনি ঢাকায় থাকবেন না। এটা কি হয়? মিজারুলের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে ঢাকা ভার্সিটিতে জার্নালিজমে পড়ছে। ছোট ছেলে ধানমন্ডি গবর্নমেন্ট স্কুলের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র। একমাত্র মেয়ে ইডেনের ছাত্রী। সোবহান সাহেব এবার ঢাকায় ঈদ করবেন শুনে ওরা ৩ ভাই-বোন বেশ খুশি হয়েছিল। কিন্তু সোবহান সাহেব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় তাদের মন খারাপ। তবে সোবহান সাহেব তাদেরকে বুঝিয়েছেন, শোনো দাদা ভাইয়েরা কদিনই বা বাঁচব আমি। এই যে নিজেদের টাকায় এতবড় পদ্মা সেতু হল একবার দেখতে চাই। এককাজ করো তোমরাও ঈদে বরিশালে আসো। সবাই মিলে বেশ মজা হবে। সোবহান সাহেবের কথাটা বেশ মনে ধরেছে সবার। কথাটা মিজারুল ও তার স্ত্রী সুরাইয়ার কানেও গেল। তারাও রাজি। সোবহান সাহেব ঈদের আগেই বরিশাল যাবেন। ঈদের পরের দিন পরিবারের অন্য সবাই বরিশাল যাবে। এবারের ঈদ হবে বরিশালে।
এক শুক্রবারে ভোরে ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওয়না দিলেন সোবহান সাহেব। গাড়ির ড্রাইভার মজিদ মিয়া খুব খুশি। সে শরিয়ৎপুরের বাসিন্দা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় শরিয়ৎপুর বাসীর অনেক সুবিধা হয়েছে। আগে ঢাকায় আসতে সময় লাগত প্রায় ৩ ঘণ্টা। এখন নাকি ঢাকা-শরিয়ৎপুর সোয়া ঘণ্টায় আসা যায়। এজন্য মজিদ মিয়ার খুশির সীমা নাই। যাকে কাছে পায় তাকেই অহংকার করে বলে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় আমরা শরিয়ৎপুর বাসী বেজায় খুশি। ভোরে শরিয়ৎপুর থেকে রওয়না দিয়ে ঢাকায় নাস্তা করব। তারপর অফিস… কী আনন্দ? কী আনন্দ।
এই আনন্দটা দেখানোর জন্যই আগের দিন থেকেই সোবহান সাহেবকে তাড়া দিচ্ছিল মজিদ মিয়া। স্যার, আমরা কিন্তু ভোরে ভোরে রওয়না দিব। ধরেন গিয়া ফজরের নামাজের পর ঢাকা থাইক্যা রওয়না দিলাম। সময়টা ধরেন সকাল ৬টা। সকাল ৯টার মধ্যে বরিশালে পৌছে যাব ইনশাআল্লাহ। বরিশালে গিয়া নাস্তা করব। সোবহান সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই ছেলে বলে কি? ভোরে বরিশালের উদ্দেশে রওয়না দিয়ে সকালের নাস্তা বরিশালে খাওয়া কি আদৌ সম্ভব? সে কথা মজিদ মিয়াকে বলতেই অহংকারের সাথে জবাব দেয়Ñ স্যার সেই দিন আর নাই। দিন বদলায়া গেছে। শেখের বেটি অসাধ্য সাধন করেছেন। পদ্মার বুকে সেতু বানাইছেন। মাত্র ৬ মিনিটে পদ্মার এপার থেকে ওপরে যাওয়া যায়। আমি স্যার প্রত্যেকদিন ফজরের নামাজে বসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করি। আল্লাহ যেন তাঁকে আরও অনেকদিন অনেক বছর বাঁচাইয়া রাখেন। এই দ্যাশের জন্য তাকে খুব দরকার। কি বলেন স্যার ঠিক বলছি না?
মজিদ মিয়া ঠিকই বলেছে। আজকে এই যে পদ্মা সেতু নিয়ে দেশে-বিদেশে এত প্রশংসা হচ্ছে তার একক কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক যেদিন ঘোষনা দিল যে তারা পদ্মা সেতুতে অর্থ সহায়তা দিবে না সেদিন সবাই ধরে নিয়েছিল পদ্মা সেতু আর হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা হাল ছাড়েননি। দূর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, লাগবে না কারও টাকা। আমরা আমাদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাব। শেখ হাসিনার কথা শুনে সেদিন অনেকেই মুখ টিপে হেসেছিল। এও কি সম্ভব? এত বড় পদ্মা সেতু বাংলাদেশ নিজের টাকায় বানাতে পারবে? অসম্ভব।
কিন্তু এই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন শেখ হাসিনা। যে কথা বলেছিলেন সে কথা রেখেছেন। যা ছিল স্বপ্নেরও বাইরে। তাই এখন বর্তমান। বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মায় দাঁড়িয়ে গেছে গর্বের পদ্মা সেতু। এটাই এখন বাস্তবতা। সোবহান সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাবেন। একটা খোলা চিঠি লিখবেন। আরেকটি উদ্যোগের কথা ভাবছেন তিনি। সারাদেশে এক যোগে প্রধানমন্ত্রীকে প্লাকার্ড দেখিয়ে ধন্যবাদ জানানো যায় কিনা তাই নিয়ে ভাবছেন। একটি নির্ধারিত দিনে এক মিনিটের জন্য দেশের যে যেখানেই থাকবেন প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়াবেন। প্লাকার্ডে লেখা থাকবে দেশবাসীকে পদ্মা সেতু উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী। এই উদ্যোগের জন্য হোম ওয়ার্ক দরকার। বরিশালে গিয়ে হোমওয়ার্কটা সারবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন সোবহান সাহেব।
ড্রাইভার মজিদ মিয়ার কথা অনুযায়ী ভোরেই বরিশালের উদ্দেশে রওয়না দিলেন সোবহান সাহেব। ঢাকায় যাত্রাবাড়ি এলাকার ফ্লাইওভার পেরিয়ে গাড়ি যতই সামনের দিকে যাচ্ছে ততই বিস্মিত হচ্ছেন সোবহান সাহেব। এত সুন্দর রাস্তা কি বাংলাদেশের? যেন সুইজারল্যান্ড। সুইজারল্যান্ড যাবার সুযোগ হয়নি। ছবিতে সুইজারল্যান্ড দেখেছেন। অতি সুন্দর দেশ। ছবির মতো সাজানো রাস্তা। মজিদ মিয়া কথা বলেই যাচ্ছে। ‘স্যার এই যে রাস্তাটা দেখতেছেন এই খানে আগে ছিল পানি আর পানি। আর এখন দেখেন কি ফকফকা। এই রাস্তায় যখন নামি তখন গর্বে বুকটা ফুইল্যা যায়। এত সুন্দর রাস্তা কি আমাদের? পদ্মা সেতুতে চলেন স্যার দেখবেন আমাগো দ্যাশটা কেমন বদলায়া গেছে।
পদ্মা সেতুর মাওয়া অংশের টোল প্লাজায় এসে গাড়ি থামলো। মজিদ মিয়া ঠিকই বলেছে। পদ্মা সেতু সব কিছু বদলে দিয়েছে। আধুনিক টোল প্লাজা তার প্রমাণ। একজন মহিলা কর্মী যানবাহনের টোল নিচ্ছে। তাকে দেখে আরও খুশি হলেন সোবহান সাহেব। মনে মনে বললেন, মাগো তোমাকে শুভেচ্ছা। আমাদের মেয়েরা এভাবেই এগিয়ে যাবে। তুমি তাদের শ্রেষ্ঠ অনুপ্রেরনা।
গাড়ির টোল দেওয়া শেষ। সোবহান সাহেবের খুব ইচ্ছে করছে গাড়ি থেকে নেমে পদ্মা সেতুকে একটু ছুঁয়ে দেখবেন। এটি তো একটা সেতুমাত্র নয়। বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক। অপমানের জবাব। একবার পদ্মা সেতুকে ছুঁয়ে দেখতে চান। মজিদ মিয়াকে বলতেই সে না না করে উঠলোÑ স্যার সেতুর উপর গাড়ি থামানো যাবে না। কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে। একটা নিয়ম কানুন থাকা জরুরি স্যার। দেখলেন না সেতু চালু হওয়ার দিন কত ঝামেলাই না হইল। একজন সেতুর নাট বল্টু খুইল্যা টিকটক ভিডিও বানাইল। মটর সাইকেল এক্সিডেন্ট কইর‌্যা দুইজন মারা গেল। কেউ একজন পদ্মা সেতুতে পেশাব করলো। এরা কি স্যার মানুষের জাত? সব গুলারে ধইর‌্যা চাবকানো উচিৎ। আরে বদমাইশের দল তোরা কি মানুষ? পদ্মা সেতু দ্যাশটারে এতটা সম্মানের জায়গায় দাঁড় করাইছে এইটা কি বুঝোস আহাম্মকের দল।
মজিদ মিয়া খিচতি আউরিয়ে চলেছে। গাড়ি চলছে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে। নিজেকে যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সোবহান সাহেবের। পদ্মার উপর ব্রীজ হয়েছে। সেই ব্রীজ পার হচ্ছেন সোবহান সাহেব। ৬ ঘণ্টার ঝামেলা ৬ মিনিটেই শেষ। এতো জাদুকেও হার মানানো। গাড়ি থেকে নামতে ইচ্ছে করছে। যে যা বলে বলুক পদ্মা সেতুর রোলিং ছুঁয়ে দেখবেন সোবহান সাহেব। ডাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। ড্রাইভার গাই গুই শুরু করে দিল। কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে স্যার। এটা ঠিক হবে না।
সোবহান সাহেব নিজেও বুঝতে পারছেন কাজটা ঠিক হবে না। কিন্তু মন তো মানছে না। হঠাৎ দেখলেন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা গাড়ি নিয়ে সেতু এলাকায় টহল দিচ্ছেন। তার কাছে অনুমতি নেওয়ার কথা ভাবলেন সোবহান সাহেব। কিন্তু সেতুর ওপর গাড়ি থামাতে গিয়েই বাঁধলো বিপত্তি।
ওই কর্মকর্তা গাড়ি নিয়ে দ্রুত সোবহান সাহেবের সামনে এলেন। ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি থামানো যাবে না। সামনে যান।
সোবহান নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, স্যার আমি একটিবার সেতুটার রেলিং ছুঁয়ে দেখব। গাড়ি থেকে নামবো আর উঠবো। এটুকুই সময়।
কর্মকর্তা দয়াপরবশ হয়ে অনুমতি দিলেন। গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে গিয়ে পদ্মা সেতুর রেলিং ধরে দাঁড়ালেন সোবহান সাহেব। উপরে আকাশ। নীচে প্রমত্ত পদ্মা। তার ওপর দাঁড়িয়ে আছেন সোবহান সাহেব।
মনে মনে প্রশ্ন করলেনÑ কেমন আছো পদ্মা?
উত্তর এলো- তোমরা যেমন রেখেছো।
তোমার কি মন খারাপ?
না। একটুও না। মন খারাপ হবে কেন? তবে একটা অভিমান আছে।
অভিমান? কি?
এই যে আমি একটা নদী আমার বুক চিড়ে তোমাদেরকে একটা ব্রীজ উপহার দিলাম। তোমরা কি নদীর প্রতি যথার্থ সম্মান দিচ্ছ?
সোবহান সাহেব একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, তোমার কথা ঠিক। নদী যেন ঠিক সম্মান পাচ্ছেনা।
পদ্মা বলল, শোন, তোমরা মানুষেরা যদি বাঁচতে চাও তাহলে নদীকে সম্মান করে চলো। তোমাদের সুখের জন্য আমি পদ্মা আমার বুক চিড়ে সেতু উপহার দিলাম। আর তোমরা মানুষেরা আমাকে কিছুই দিবে না তাতো হয় না। নদী দুষণ বন্ধ করো। পলিথিন ফেলে ফেলে নদীর বুক নষ্ট করে দিচ্ছ তোমরা। নদী দখল করে বসত ভিটা, মার্কেট বানাচ্ছ। একবারও কি মনে ভয় জাগে না। নদী না থাকলে তোমাদের মানুষের কি হবে? বাঁচতে পারবে কী?
এক নাগাড়ে অভিমান করেই চলেছে পদ্মা। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা বার-বার তাগাদা দিচ্ছেন সোবহান সাহেবকে। স্যার আর সময় দেওয়া যাবে না। গাড়িতে উঠুন, প্লিজ।
গাড়িতে ওঠার আগে পদ্মা ব্রীজের রেলিং ছুঁয়ে চুমু খেলেন সোবহান সাহেব। মনে হল প্রমত্ত পদ্মা একটু হলেও খুশি হয়েছে। বলছে, নদীর যত্ন নিও। তাহলেই নদীও মানুষের যত্ন নিবে। যত্নে যত্নে রত্ন মেলে কথাটা মনে রেখ…

মাসরুর শাকিল। চ্যানেল আই এর তুখোড় রিপোর্টার। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাভার করতে ঐ যে পদ্মা পারে এসেছেন আর ফিরে যাননি। রিপোর্টিং এর পাশাপাশি ক্যামেরা চালাতেও সিদ্ধহস্ত তিনি। পদ্মা পারেই দিন কাটছে তার। কারণ পদ্মা সেতুকে নিয়ে তার বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি। ঘোরটা হল পদ্মার মতো খরস্রোতা নদীতে এতবড় আন্তর্জাতিক মানের একটা সেতু বাংলাদেশ বানাল কি করে? পদ্মা সেতুকে ঘিরে প্রতিদিন বাংলাদেশের ছোট বড় পরিবর্তন দেখতে পারছেন মাসরুর। ৬ ঘণ্টার ঝামেলা ৬ মিনিটেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এটাই মানুষের কাছে চরম বিস্ময়। দক্ষিনাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষ এবার ঈদ করবে অন্যভাবে। এই ঈদে পদ্মা সেতুই হবে তাদের শ্রেষ্ঠ আনন্দ। ঢাকা থেকে বাস যোগে খুলনার দিকে যাচ্ছিলেন একটি পরিবার। তাদের মুখোমুখি হলেন মাসরুর।
ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছেন?
হ্যা।
অন্য বছরের তুলনায় এবার কি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছেন?
হ্যা। অনেক পার্থক্য। সময় কমে গেছে। আগে ঢাকা থেকে খুলনা যেতে সময় লাগত ৭ ঘণ্টা। এখন সময় লাগে ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টা। এবারের ঈদে এটাই আমাদের সেরা আনন্দ।
এজন্য কাকে ধন্যবাদ দিতে চান?
অবশ্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে?
একজন ভার্সিটি ছাত্রের সাথে কথা হল মাসরুরের। নাম আরিফ জাহান। ঈদের ছুটিতে শরিয়ৎপুর যাচ্ছেন। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফ জাহান বললেন, পদ্মা সেতু আমাদের মাঝে নতুন করে এগিয়ে চলার উদ্দীপনা দিচ্ছে। আমার ২৫ বছরের জীবনে ঈদে এত আনন্দ আর কখনও পাইনি। আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টার জার্নি এক ঘণ্টায় এসে দাঁড়িয়েছে এর চেয়ে আনন্দ আর কি হতে পারে। পদ্মা সেতুই এই ঈদে আমাদের সেরা আনন্দ।
খুলনার শাফায়েৎ হোসেন নামে একজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা হল মাসরুর শাকিলের। শাফায়েৎ খুব খুশি। বললেন, জীবনে এত আনন্দ আর কোনদিন পাইনি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সাথে সাথেই আমাদের এলাকা বদলে গেছে। এতদিন বলতে গেলে রাজধানীর সাথে আমরা অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়েই ছিলাম। পদ্মা সেতু সেই বিচ্ছিন্নতা দুর করেছে। এবারের ঈদে সেরা আনন্দ হল আমাদের গর্বের পদ্মা সেতু।

মাওয়া থেকে জাজিরা। তারপর জাজিরা থেকে ভাঙ্গায় পৌছে অবাক আরও অবাক হলেন সোবহান সাহেব। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিস্ময়কর এক পরিবর্তন এনেছে ভাঙ্গা এলাকা। সোবহান সাহেব মনে মনে বললেন, এটা কি বাংলাদেশ? ড্রাইভার যেন সোবহান সাহেবের মনের কথা বুঝতে পারল। বলল, স্যার এইটাতো বাংলাদেশের আরেক আবিস্কার। এইখানে স্যার নিয়ম না মানলে কোন কাজ হইব না। একবার যদি কোনো ড্রাইভার ভুল করে তাইলে খবর আছে। লুডু খেলার মতো সাপের মুখে পড়ে যেমন নীচে নামতে হয় তেমনই ভাঙ্গায় একবার ভুল করলেই অনেক ঝামেলা। এইখানে স্যার নিয়ম মানতেই হবে।
সোবহান সাহেব বেশ খুশি হলেন। ড্রাইভার মজিদ মিয়া যখন নিয়ম মানার কথা বলছে তখন একটা পরিবর্তন আশা করা যায়। হঠাৎ একজন টেলিভিশন রিপোর্টারের মুখোমুখি হলেন সোবহান সাহেব।
স্যার আমার নাম মাসরুর শাকিল। আমি চ্যানেল আই এর একজন রিপোর্টার। আপনার সাথে কি একটু কথা বলতে পারি?
সোবহান সাহেব খুশি হয়ে বললেন- অবশ্যই।
আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
বরিশালে ছেলের বাসায়।
আপনার ছেলে কি করেন?
একজন শিক্ষক। বরিশাল বিএম কলেজের…
এই যে বরিশাল যাচ্ছেন, এবার কি কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন?
হ্যা, অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।
সেটা কেমন?
৬ ঘণ্টার মামলা ৬ মিনিটে শেষ।
বুঝিয়ে বলবেন?
আগে পদ্মা পার হতে ফেরীর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। ৬/৭ ঘণ্টাও লেগে যেত কোনো কোনো সময়। এখন মাত্র ৬ মিনিটে পদ্মা পার হওয়া যা। এটা একটা বিরাট পরিবর্তন। আমি মনে করি এটিই এবার ঈদের শ্রেষ্ঠ উপহার।
আপনি এজন্য কাউকে ধন্যবাদ দিতে চান?
অবশ্যই। পদ্মা সেতুর রুপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। পাশাপাশি আমার একটি আর্জি আছে।
আর্জি? কি?
আপনার কি সময় আছে?
হ্যা আছে। আপনি বলেন?
আমাদের উচিৎ নদীর প্রতিও শ্রদ্ধা জানান।
সেটা কি ভাবে?
সেটা নানা ভাবে হতে পারে। নদী দূষণ বন্ধ করে হতে পারে। নদী দখল করে বসত বাড়ি, মার্কেট না বানালেও নদীকে শ্রদ্ধা জানানো হবে। নদীর গতি পথ বন্ধ করা যাবে না। গতি পথ বন্ধ করলেই নদী ক্ষেপে যায়।
আপনি আসলে কি চান?
আমি দুটো জিনিস চাই। এক. পদ্মা সেতুর রুপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জাতি যেন আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানায়। দুই. আমরা যেন নদী রক্ষার শপথ গ্রহণ করি।

সোবহান সাহেবের আইডিয়াটা বেশ পছন্দ হয়েছে মাসরুর শাকিলের। নদী দূষণ বন্ধ ও নদী দখলের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার কথা ভাবলো সে। পদ্মায় আজ শেষ দিন। ঢাকায় ফিরতে হবে। পদ্মা সেতুর শেষ আপডেট নিতে এসেছে সে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের মুখে শুধু হাসি আর আনন্দ। মাসরুর যাকেই প্রশ্ন করেন সেই বলে পদ্মা সেতুই এবারের ঈদের শ্রেষ্ঠ আনন্দ। শাকিল নিজেও কনভিনসড। হ্যা, দক্ষিণবঙ্গের তো বটেই গোটা দেশের মানুষের জন্য এবারের ঈদের শ্রেষ্ঠ উপহার গর্বের পদ্মা সেতু।

ঢাকায় ফিরে এসেছেন মাসরুর শাকিল। পদ্মা সেতুর ওপর তিন পর্বের একটা সিরিজ রিপোর্ট তৈরি করেছেন। এডিট প্যানেলে শেষ পর্যায়ের ঘষামাজা চলছে। হঠাৎ তার মোবাইলে ফোন করলেন সোবহান সাহেব। সেদিন লোকটাকে পছন্দ হওয়ায় টেলিফোন নম্বর দিয়েছিল শাকিল।
সোবহান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন- শাকিল কেমন আছেন।
জ্বি ভালো। আপনি?
সৃষ্টিকর্তার রহমতে ভালোই আছি। আপনি কি ব্যস্ত?
না। কিছু বলবেন?
হ্যা। কিছু কথা ছিল।
বলেন।
আমরা বরিশাল থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সিদ্ধান্ত কি?
ঈদের দিন এক মিনিটের জন্য আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই।
কেন?
প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উপহার দিয়েছেন বলে এবারের ঈদ বেশ আনন্দের হয়ে উঠেছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে চাই।
সেটা কিভাবে?
ফেসবুকে এব্যাপারে ঘোষনা দিব। ঈদের দিন বেলা ৩টায় যে যেখানে আছেন প্লাকার্ড নিয়ে এক মিনিটের জন্য দাঁড়াবেন। ছবি তুলে নিজেদের ফেসবুক ওয়ালে তুলে দিবেন। এজন্য আপনার সহযোগিতা চাই। আপনাদের চ্যানেল আইতে যদি আগাম একটা সংবাদ প্রচার করা যেত।
মাসরুর খুশি হয়ে বলল, আপনার আইডিয়াটা চমৎকার। আমি চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষকে ব্যাপারটা জানাব। নিশ্চয়ই এব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত পাব।
ফোন কেটে দিতে যাচ্ছিলো মাসরুর। সোবহান সাহেব বললেন, প্লিজ ফোন রাখবেন না। আমার আরও কিছু কথা আছে।
বলুন।
নদীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও আমরা কিছু করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সেটা কেমন?
একই প্লাকার্ডে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ কথাটা লেখা থাকবে। পাশাপাশি থাকবে নদী বাঁচাও শীর্ষক আন্তরিক আহবান। কেমন হবে ব্যাপারটা?
মাসরুর খুশি হয়ে বললেন, খুউব ভালো। এগিয়ে যান। আছি আপনার সাথে।
ঈদের দিন গোটা দেশে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। বিকেল ৩টায় সারাদেশে রাস্তায়, বাসাবাড়ির সামনে প্লাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন দেশের কোটি কোটি মানুষ। প্লাকার্ডে লেখা পদ্মা সেতুর রুপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা। একই প্লাকার্ডে লেখা ‘নদী না বাঁচলে বাঁচবে না বাংলাদেশ। আসুন নদীর কথা শুনি নদীর কথা মানি…’।