Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্থপতি এবং স্থাপত্য গড়ার কারিগর মারুফ হোসেন

দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পে যারা দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মারুফ হোসেন। ২০০৩ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৪ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘আর্কডেন কনসালটেন্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই ফার্মের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মারুফ হোসেন। ২০০৭ সালে তিনি মনবুশো স্কলারশীপ দিয়ে জাপানের গিফু ইউনিভার্সিটি থেকে এনভরনমেন্টাল সিস্টেম এর ওপর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। দেশে এসে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে এই স্থপতি একই ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থাপত্য চর্চা করে যাচ্ছেন নিয়মিত। ইতোমধ্যে তিনি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন করেছেন এবং জাতীয় পর্যায়ে একাধিক পুরস্কার অর্জন করেন। এবার আনন্দ আলোর ঈদ সংখ্যায় শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে তাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
স্থাপত্য শুধু একটা বিল্ডিং নয়, এর পরিসর মানুষর চিন্তা, ভাবনা ও বেড়ে ওঠাকে প্রভাবিত করে। একটা সুন্দর স্থাপত্য একজন সুন্দর, মননশীল ও চিন্তাশীল মানুষ তৈরী করে। স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রের মেধা ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন ঘটে। একটি সুন্দর স্থাপত্য, সুন্দর স্থান ও সুন্দর পরিবেশ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সবার কাম্য বলে মনে করি। এ কথাগুলো বললেন স্থপতি মারুফ হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি যশোর শহরে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা যশোরে। মারুফের বাবার নাম আনোয়ার উল্লাহ। তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা সালিমা খাতুন গৃহিণী। আট ভাই বোনর মধ্যে চতুর্থ মারুফ। স্কুল জীবন থেকে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্কুলে পড়াকালীন মারুফের ছবি আঁকা আঁকির প্রতি ছিল প্রচন্ড নেশা। কবিতা আবৃত্তি ছিল তার পছন্দের বিষয়।
ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল আর্কিটেক্ট হওয়ার। তিনি হয়েছেনও সফল একজন আর্কিটেক্ট। যশোর জেলা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। ২০০৩ সালে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৪ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘আর্কডেন কনসালটেন্ট’ নামের একটি ফার্ম। এর পরপরই তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান জাপানে। ২০০৭ সালে মারুফ হোসেন জাপান সরকারের মনবুশো স্কলারশীপ দিয়ে গিফু ইউনিভার্সিটি থেকে এনভরনমেন্টাল সিস্টেম এর ওপর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এরপর দেশে ফিরে এসে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে। বর্তমানে তিনি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের তিনি স্থাপত্যের নানান বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি আধুনিক স্থাপত্য চর্চা করে যাচ্ছেন নিয়মিত। এই স্থপতি স্পেনের মাদ্রিদ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট আরবান গভারনেন্স এর ওপর পিএইচডি করছেন। ইতোমধ্যে তিনি দেশের নামকরা হোটেল, ফ্যাক্টরী বিল্ডিং, কমার্শিয়াল বিল্ডিংসহ অসংখ্য বিল্ডিংয়ের ডিজাইন করেছেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহে রুমডো ইনস্টিটিউট, মিরপুর-১৩ তে সাইক গ্রুপের হেড অফিস, সিলেটে হোটেল ক্রিষ্টাল রোজ, উত্তরায় টোকিও হেভেন, মিরপুর-১০ এ সিসটেক অ্যাপার্টমেন্ট, সিলেটে হোটেল নিভানা, হোটেল লা ভিস্তা, মৌলবী বাজারে ডা: আহাদস আবাসিক ভবন, বরিশালে বেঙ্গল বিস্কুটের ফ্যাক্টরী বিল্ডিং, উত্তরায় টোকিও স্কয়ার আবাসিক ভবন, ইঞ্জিনিয়ার ফয়েজ আবাসিক ভবন, সিলেটে হোটেল হলি ইন, বসুন্ধরায় ইঞ্জিনিয়ার মাহবুব আবাসিক ভবন সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন করেছেন। বর্তমানে তিনি বেশ কয়েকটি নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন। ২০০৮ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম তাহসিনা আফরিন। তিনি পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একজন কুটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ দম্পতি এক সন্তানের জনক-জননী। ছেলের নাম শেহ্জাদ।
স্থপতি মারুফ হোসেন বলেন, আমাদের স্থাপত্যের চিন্তাটা আসে প্রকৃতি, দেশীয় ঐতিহ্য, আধুনিকতা, সামাজিক স্থান এবং টেকসই, এ সব জিনিস গুলোকে কনসিডেরেশন করে। আমরা চাই, আমাদের যে স্থাপত্য হবে সেটা যেন ইনক্লুসিভ বা সামগ্রিকতা। যেখানে মানুষের ও প্রকৃতির সাথে স্থাপত্যের একটা সম্পর্ক হয়। আমরা সব সময় চেষ্টা করি, যখন কোনো আর্কিটেকচার ডিজাইন করি তখন আমরা সেখানকার স্থানীয় আবহাওয়াকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়। সেটা যেন সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক আলো-বাতাস পায় এবং সেখানে যেন মানুষের আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত হয়। আমাদের কাজে প্রধানত প্রাধান্যে দেই, একটা বিল্ডিং যে বসবাস করবে তার চাওয়াটা, তার স্বপ্নটা কী, সেটার ওপরে। একজন মানুষ তার সারাজীবনের স্বপ্ন স্থাপত্যের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়। আমরা চাই সেই মানুষটার স্বপ্নটাকে যেন তার মতো করে হয়। অবশ্যই আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে সামনে রেখে এটাকে বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি কাজে নজর দেন এই স্থপতি।
তরুণ স্থপতিরা যারা এই পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চায় তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?
এমন প্রশ্নের উত্তরে স্থপতি মারুফ হোসেন বলেন, একজন ভালো স্থপতি হতে গেলে তাকে অবশ্যই দেশীয় সংস্কৃতি, দেশীয় পরিবেশ, জলবায়ু বা ভূতাত্রিক যে বৈশিস্ট্য গুলো আছে সে গুলো খুব ভালো করে জানা। আমরা যে স্থাপত্য তৈরি করব সেটা আসলে এ দেশকে রিপ্রেজেন্ট করবে। আমরা যদি এমন কিছু করি যেটা আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করবে সেটা ুদূর প্রসারি একটা খারাপ প্রভাব থাকবে। এ জন্য অবশ্যই স্থপতি হওয়ার আগে আমাদেরকে দেশীয় চিন্তাটা ধারণ করতে হবে। দেশের সংস্কৃতি সামাজিক, রাজনৈতিক চিন্তাকে ধারণ করে তারপরে স্থপতি হওয়া বা স্থাপত্য চর্চা করা উচিত। একজন ভালো স্থপতি হতে গেলে অবশ্যই তার শিক্ষার এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। শুধু পড়ালেখা নয়, তার সামাজিক কিছু দায়িত্ব থাকে যে গুলোর জন্য তাকে প্রচুর কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকা উচিত। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সাথে। সাধারণ মানুষের সাথে জড়িত হলে মানুষ সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা জানা যায়। আরেকটা হচ্ছে তার প্রচুর ভ্রমণ করা উচিত। শুধুমাত্র দেশে নয়, বিদেশেও। আমরা যত বেশি দেখব তত বেশি আমাদের সৃজনশীলতার পরিসরটা বাড়বে। যত বেশি দেখার অভিজ্ঞতা হবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাও চেঞ্জ হবে, আরও উদার হবে। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা স্থাপত্য চিন্তাকে প্রভাবিত ও প্রসারিত করে এবং নতুন নতুন আরও সৃজনশীল স্থাপত্য তৈরিতে সাহায্য করে। একটা ভালো স্থাপত্য আসলে এমনই হয় যেখানে মানুষের চিন্তা ভাবনা, সৃজনশীলতা, সাথে সাথে তার দর্শন, তার অভিজ্ঞতা, তার কাজের বৈশিষ্ট্য গুলো এটা স্থাপত্যের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়। আমি মনে করি যে একজন ভালো স্থপতি তখনই হতে পারবে। যখন তার এই অভিজ্ঞতা, তার জ্ঞান এবং তার চিন্তা ভাবনা গুলো ঠিকমতো তার স্থাপত্যের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়। সুন্দর বসবাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে স্থাপত্যের দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য নিরলস ভাবে স্থাপত্য চর্চা করে যেতে চান তিনি।