Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

হার না মানা হার, দৃষ্টান্ত সাইফুল আলম মারুফ

অপু মাহফুজ
বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানে কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ২০০৬ সালের ৭ এপ্রিল জীবনে এক ক্রান্তিকাল নেমে এলো সেই স্বনামখ্যাত বহুজাতিক কর্পোরেটের জীবনে। একটা সড়ক দুর্ঘটনা। স্পাইনাল কর্ডে ইঞ্জুরি হয়ে দুটি পায়ের চলৎশক্তি হারালেন সাইফুল আলম মারুফ। ২১ দিন পর চেতনা ফেরার পর ডাক্তারের কথা ছিল আপনি আর কোনদিন দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। প্রতিরাতে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতেন ২৯ বছরের সেই তরুণ ঝলমলে কর্পোরেট। নিজের কঠিন মনোবল আর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমি দাঁড়াবোই। প্রচুর পরিমাণে ইন্টারনেটে পড়াশোনা করতে শুরু করলেন ইঞ্জিনিয়ার মারুফ। পার্মানেন্ট ফিজিওথেরাপিস্ট রেখে দিলেন।
সার্বক্ষণিক পরিবারের সদস্যদের নিবিড় পরিচর্যায় মারুফ হয়ে উঠলেন আত্মবিশ্বাসী। বিছানায় শুয়ে থেকে তিন মাসের মাথায় মারুফ ইটালির আলটিমারি কোম্পানির মেশিন অর্ডার করলেন বাংলাদেশের জন্য। ৩৫ লক্ষ টাকা প্রফিট এবং তখনই নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিক করে ফেললেন। ততদিনে চাকরি করতেন যে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। অনেক আত্মীয়-স্বজন ফিরে তাকাননি। উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার এবং কিছু করে ফেলার প্রবল ইচ্ছা ও অদম্য প্রাণশক্তি মারুফকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
ছয় মাস পর শিশুদের মতো দুই পায়ে ভর দিয়ে টুকটাক হাঁটা শুরু করলেন মারুফ। তিন মাসের মাথায় কুষ্টিয়ায় ফিরে চৌড়হাসে স্থায়ী হলেন। শ্রদ্ধেয় শ্বশুর জনাব আলহাজ্ব মুক্তার হোসেন এবং শ্বাশুড়ি মিসেস বদরুননাহার এর হাতে ইঞ্জিনিয়ার মারুফের শ্রদ্ধেয় মা মিসেস হাসিনা বানু পরম মমতায় তুলে দিলেন নিজের শারীরিক অসুস্থতার কারণে সন্তান মারুফের আশু সুস্থতার আশায় দুই পরিবারের মমতার বন্ধনে। স্ত্রী তানিয়া সুলতানা মায়া একটি পিলার হয়ে স্বামীর হাত ধরে দাঁড়ালেন আশায়, অনুপ্রেরণায়, ভালোবাসায়। কোন অর্থ প্রাপ্তি নয়, কোন বড় চাকুরি নয়। স্বামীর উঠে দাঁড়ানোর সময়টিতে সরকারী চাকুরীজীবী স্ত্রী একজন শিক্ষিকা অনুপ্রেরণা ও আশ্বাস এবং বিশ্বাসের কথা বললেন। বললেন, তুমি পারবেই। ট্রেনিং পার্ট ডান। দেখেছেন অফিসের প্রিয় মানুষজনকে দূরে চলে যেতে। আত্মীয়-স্বজন দূরে চলে যেতে, বন্ধুদের মুখ ঘুরিয়ে নিতে। শুধু একটি, বন্ধু গুগল। ইন্টারনেটেই কথা বলেছেন ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল আলম মারুফ।
কুষ্টিয়া তিনটি খাতে অগ্রসর ছিল। চামড়া শিল্প, তামাক শিল্প এবং ম্যানুয়াল রাইস মিল। উদ্যোক্তা বেছে নিলেন দেশের ৪৫% মানুষের জীবিকার খাত সিএসএমইর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত কৃষি সেক্টরকে। রাইস মিলের জোনকে। লক্ষ্য একটাই ম্যানুয়াল রাইসমিলকে আধুনিক রাইস মিলে রুপান্তর করে উৎপাদন বৃদ্ধি, অর্থ সাশ্রয়, শ্রম সাশ্রয় ও প্রবৃদ্ধি আনবার।
২০১০ সাল। আমদানি নির্ভর এই খাতে নর্থসাউথের মোহনায় জিএসএম ইঞ্জিনিয়ারিং-গ্লোবাল সলিউশন মেশিনারি প্রতিষ্ঠা করলেন প্রকৌশলী সাইফুল আলম মারুফ। প্রথম প্রোডাক্ট পার বয়েলিং ড্রায়ার। ধানকে সরাসরি অটো মেশিনের মাধ্যমে সেদ্ধ এবং শুকানোর মেশিন। বিরাট চ্যালেঞ্জ এবং বিরাট সফলতা চলে এলো প্রথমেই। প্রথম ধাক্কায় প্রথম অর্ডার ডেলিভারি করবার পর আটটি, দশটি, ৩৫টি ফুল ইউনিট সেল হয়ে গেল। ইনস্টলেশন এবং আফটার সেলস সার্ভিস গ্লোবাল সলিউশন মেশিনারি তার পক্ষ থেকে উদ্যোক্তার কর্মযোগ শুরু হয়ে যায় পুরোদস্তুর। সকল সার্ভিসগুলো এক্সটেন্ড করলেন উদ্যোক্তা। নেটওয়ার্ক এক্সপ্যান্ডেড হল ৫০০ ছোট বড় রাইস মিলের সাথে।
কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালীতে ভেঞ্চার স্থাপনের সাথে সাথে এক বছরের মাথায় উদ্যোক্তা দাঁড়িয়ে চিন্তা করলেন যে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। সকল প্রকার আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুত, আমদানী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জিএসএম ইঞ্জিনিয়ারিং দুর্বার গতিতে কাজ করা শুরু করলো। জিএসএম ইঞ্জিনিয়ারিং সকল প্রকার আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুত আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম অর্জন করতে থাকলো।
জিএসএম বীজ বপন যন্ত্র, জিএসএম জিরো টিল ড্রিল, জিএসএম ট্রান্সপ্লান্টার, জিএসএম পাওয়ার টিলার চালিত রিপার সকল ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি পেতে শুরু করলেন তৎসংলগ্ন পুরো অঞ্চলের কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত মানুষ, উদ্যোক্তা কৃষি উদ্যোক্তা এবং সকলে। একটি সেক্টর এগিয়ে যায়। জিএসএম ধান/গম কাটার যন্ত্র, জিএসএম কম্বাইন হারভেস্টার, জিএসএম আলু লাগানো যন্ত্র, আলু তোলার যন্ত্র, আলু বাছাইকরণ যন্ত্র, খড়/ঘাস কাটার যন্ত্র, ধান/গম মাড়াই যন্ত্র, ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, ভুট্টার খোসা ছাড়ানো যন্ত্র, শস্য ঝাড়াই যন্ত্র, আম শোধন যন্ত্র, জিএসএম গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র, জিএসএম কম্পোস্ট সেপারেটর, জিএসএম মুরগি, হাঁস ও মাছের খাদ্য তৈরি যন্ত্র, জিএসএম মাছের ভাসমান খাদ্য তৈরির যন্ত্র, জিএসএম ধান/গম ভাঙ্গানো যন্ত্র, আটা তৈরি যন্ত্র, গাভীর দুধ দোহন যন্ত্র, পানিতে অক্সিজেন প্রবাহিত করার যন্ত্রের মত নানান যন্ত্র তৈরি করে অনেক সুনাম অর্জণ করল জিএসএম।
৬০০ স্কয়ার ফিটের জিএসএম ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফ্যাক্টরি তার নিজস্ব রোলিং এ তার একটি কারখানা থেকে রূপান্তরিত হল ৬০,০০০ স্কয়ার ফিট ফ্যাক্টরি ইউনিটে। আজ ৫টি ইউনিট। কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কে বটতৈল এলাকায় ইউনিট ওয়ান আজ রাইস মিলের এন্টায়ার সলিউশন্স। মেশিনারি প্রোডাকশনে মুখরিত এলাকার আলো বাতাস। ইউনিট টু-কৃষি যান্ত্রিকীকরণ মেশিনারিজ, প্রোডাকশন, মূল প্রোডাকশন ফ্যাক্টরি। ইউনিট ৩- স্টিল স্ট্রাকচার, বিল্ডিং এক্সটেরিয়র, স্টেয়ারকেস ইন্টেরিয়র, বাউন্ডারি ওয়াল জালিস, নেইমপ্লেট, লোগো, মেইনগেট, এলিভেটর এন্ড ডোর জালিস জালিস ডিজাইনে লক্ষ নকশার সক্ষমতা উদ্যোক্তার ইউনিট-৩। বিল্ডিংয়ের মেগা স্টিল স্ট্রাকচার থেকে শুরু করে নান্দনিক একটি ক্যালিওগ্রাফি ডিজাইনে সক্ষমতা অর্জন করে উদ্যোক্তা এবং উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠান জিএসএম।
ইউনিট ৪ এ ফার্মাসিউটিক্যালস র‍্যাক, বিগ সেটেলমেন্ট হসপিটাল বেড, মিট কিংবা ভেজিটেবল যেকোনো ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য যতবড় র‍্যাক কিংবা মেশিন প্রয়োজন সবকিছু উৎপাদন শুরু করে দেন উদ্যোক্তা তার প্রতিষ্ঠান নিয়ে। সজ্জাকরণের সকল পণ্য ইন্টেরিয়র এবং এক্সটেরিয়র সল্যুশনস ইন মেশিন।
ইউনিট ৫ পরিবেশবান্ধব কাঠের সাথে কাঠ সিজনিং ল, উড প্রসেস এন্ড বিউটিফিকেশন, অ্যাপার্টমেন্ট ও রিয়েল এস্টেট এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আজ ঢাকা, কুষ্টিয়া সদর দপ্তর ও ফ্যাক্টরি, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, ৪টি জেলায় উদ্যোক্তার অফিস। অফিস ও ফ্যাক্টরি সব মিলিয়ে আজ কর্মী সদস্য সংখ্যা ২০০ জন। উদ্যোক্তার সাথে সরাসরি পণ্য নিয়ে ব্যবসা করে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন প্রায় ৫০০ মানুষ।
শূন্য মূলধন। জীবনের ছন্দপতন। সকলের মুখ ফিরিয়ে নেয়া। তারপরও সকল কিছুকে হাসিমুখে জয় করে ফেলেছেন নিজের অসম্ভব প্রাণশক্তি দিয়ে। শূন্য মূলধন নিয়ে তৈরি করেছেন ৩৫ কোটি টাকা মূল্যমানের ব্যবসা। হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন উদ্যোক্তা। জীবনে সবচাইতে সুন্দর গলার হার কোনটি? সোনা-দানা, হীরকখণ্ড বসানো হার নয়? সেটি হল
“হার না মানা হার”। হার না মেনে নিজের জীবনকে, নিজের জীবনযুদ্ধকে জয় করেছেন, নিজের শারীরিক চ্যালেঞ্জকে জয় করেছেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন, এবং দাঁড় করিয়েছেন, নর্থ সাউথের মোহনা শিল্পনগরী কুষ্টিয়ায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের এক অসম্ভব ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে চলা একটি উদ্যোগের নাম জিএসএম ইঞ্জিনিয়ারিং।