Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

গানে গানে ফেরদৌস আরা

মোহাম্মদ তারেক

বয়সটা দুই রকম। একটা অঙ্কের। আরেকটা মনের বয়স পথিবীকে দেখার বয়স। পৃথিবীকে ভালোবাসার ব্যাপার। মনের বয়সটাই আসল। এমনটাই মনে করেন খ্যাতিমান নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস আরা। সম্প্রুতি চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান রাজু আলীমের প্রযোজনায় ফ্রেস প্রিমিয়ামটি ‘তারকা কথন’ এর লাইভ অনুষ্ঠানে নিজের জীবনের নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন। সবার সঙ্গে জন্মদিনের মুহূর্তটুকু উদযাপন করেছেন। টেলিফোনে কথা বলেছেন বন্ধু-বান্ধব, ভক্ত আর স্বজনদের সাথে। ফ্রেস প্রিমিয়ামটি তারকা কথন এর বিশেষ অনুষ্ঠানে জন্মদিন প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস আরা বলেন, যখন সকাল শুরু হয়, তখনও বলি সকালটা বড়ই সুন্দর। আর প্রার্থণা দিয়ে আমি যখন গান শুরু করি তখন স্রষ্টা যেন সবাইকে ভালো রাখে, সুস্থ রাখে এবং সুন্দর একটা দিন শুরু হোক। ঠিক আজকের দিনটিও শুভ হোক আর অশুভ হোক শুভ জন্মদিন বলেই তো কথা। অক্টোবর মাসটাও আমার কাছে খুবই প্রিয়। এই অক্টোবর মাসেই কিন্তু চ্যানেল আইয়ের জন্মদিন।
১২ অক্টোবর ছিল বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস আরার জন্মদিন। এই দিনটিতে এই গুণী শিল্পীকে নিয়ে জন্মদিন উদযাপন করেছে তারকা কথনের সদস্যরা, তার প্রিয় যন্ত্র শিল্পীরা এবং চ্যানেল আই পরিবার। চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ফ্রেস প্রিমিয়াম টি তারকা কথন আয়োজন করেছিল এক বিশেষ অনুষ্ঠান। ফেরদৌস আরা বলেন, অবশ্যই মানুষের নিজস্ব একটি উৎসবের দিন থাকতেই পারে। আমার জন্মদিনকে ঘিরে আজ চ্যানেল আই তারকা কথনের এই বিশেষ পর্ব আমাকে সত্যিই অভিভূত করেছে। ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁর অঞ্চল ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া। আর সেখানেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে বেশ পরিচিত এ এইচ এম আব্দুল হাই। তার চতুর্থ কন্যার জন্মের সংবাদ শুনে কন্যাকে দেখতে আসেন খাঁ সাহেব। সংগীত শিল্পী বাবার কন্যা পৃথিবীর আলোতে দৃষ্টি মেলেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সরোদ বাদক, সংগীতজ্ঞ মহাপুরুষের আশীর্বাদে পুষ্ট হলেন সেদিন। সেই ছোট কন্যা শিশুটি যেন সুরের ফুল বাগিচায় বসন্ত হয়েই এসেছিল। হ্যাঁ, সুর সংগীতের ফুল বাগিচাই বটে। বাসায় রাতভর সংগীতের রেওয়াজ। প্রকৌশলী বাবার গলার সুর। ধর্মভীরু মায়ের অনুচ্চ গলার সুর। বড় বোন হুরে জান্নাত, মেজ বোন নূরে জান্নাত, সেজ বোন জান্নাত আরা, সুর সাধনায়, আহরণে নিবেদিত সুর শিক্ষিকা। আর ছোট বোনটি তিনি ফেরদৌস আরা। আজ অবধি বাংলা গান বিশেষত নজরুল সংগীতের জগতে চিরবসন্ত হয়ে বিরাজ করছেন খাঁ সাহেবের আশীর্বাদ পুষ্ট, নজরুলের গানের পাখি ফেরদৌস আরা।
জন্মদিন প্রসঙ্গে ফেরদৌস আরা বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। তবে আমার জন্মস্থান ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায়। আর এখানে জন্ম নিয়ে আমি অনেক গর্ববোধ করি। কারণ আমাদের এ উপমহাদেশের গুণী শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁরও জন্ম এখানে। আমার ছোটবেলা এখানেই কেটেছে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন বিধায় আমরা অনেক জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার জন্ম মিশনারি হাসপাতালে। সেই হাসপাতালে চারজন খ্রিস্টান নার্স ছিল। তারা সবাই তাদের নাম আমাকে দিতে চেয়েছিল। পরে বাবাই আমার নাম রাখেন। এবারের জন্মদিনের শুরু আয়োজনটা কেমন ছিল? এই প্রশ্নের জবাবে ফেরদৌস আরা বলেন, রাতে একটু ভিন্ন আয়োজন ছিল সেটা পরিবারের সঙ্গে। আমার স্কুল সুর-সপ্তকের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে। আগের দিন রাতে আমার ক্লান্ত লাগছিল, আমি শুয়ে পড়েছিলাম। এমন সময় আমার কাছের কয়েকজন যারা আমার সাথে কাজ করছে তারা আমাকে বলছে, আপা ঘুমাবেন না প্লিজ। আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে। তবুও আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঠিক রাত ১২টা ০১ মিনিটে আমার হাজবেন্ড, ছেলে এসে আমাকে বলছে, হ্যাপী বার্থডে টু ইউ। সাথে সাথে আমার কাছের সবাই মিলে জন্মদিনের উইশ করতে শুরু করল। সবচেয়ে বড় সাইপ্রাইজ দিয়েছে কানাডা থেকে ওরা আমার মেয়েকে কানেক্ট করেছে। সে নানান রকমের প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে আমাকে জন্মদিনের উইশ করেছে। আরও বেশি ভালো লেগেছে আমার কিছু আনকমন ছবি। আমি কোন ক্লাসে কী বলেছিলাম, কাকে কী প্রাইজ দিয়ে ছিলাম, সেই সব দিয়ে আমার সুরসপ্তকের ছেলে মেয়েরা জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিয়েছে।
জন্মদিনের কোনো স্মরনীয় ঘটনা? তিনি বলেন, সেবার আমি কানডায় ছিলাম ছেলে মেয়েদের সঙ্গে। আমার জন্মদিনের আগের দিন অর্থাৎ রাত ১২টা বাজার আগে ওরা বায়না ধরলো আমাকে নিয়ে বাইরে যাবে। ছেলে মেয়েদের আবদার রাখতে আমাকে বাইরে বের হতে হলো। বিদেশের রাস্তায় দেখা যায় গভীর রাত পর্যন্ত স্ট্রিট শিল্পীরা গান গেয়ে বেড়াচ্ছে। আমিও দেখলাম তারা গাইছে। একটু পরে দেখি আমার নাম নিয়ে গাইছে ওরা। আমি তো অবাক। আমার নাম ওদের গানে। তারপর খেয়াল করলাম, তারা আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তারপর একটা রেস্টুরেন্টে বসতেই দেখি একদল ছেলে-মেয়ে হইহুল্লোর করে ঢুকে পড়ছে। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর দেখি ওরাও এসেছে আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে আনন্দ উদযাপন করতে। আর এ গুলোর সব আয়োজন ছিল আমার ছেলে-মেয়ের। একজন মা হিসেবে এটা আমার অনেক বড় পাওয়া।
গানের সাথে আপনার সখ্যতা তৈরি হলো কীভাবে?
ফেরেদৌস আরা বলেন, গানে আমার হাতে খড়ি বাবা এএইচএম আব্দুল হাই এর কাছেই। তিনি পিডাব্লিউডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন কলকাতায়। সেখানে তিনি অনেক বড় সঙ্গীতজ্ঞদের সংস্পর্শে আসেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন। তিনি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের অন্যতম একজন ছিলেন। আমার চাচা ছিলেন একজন নামকরা লেখক, কথাসাহিত্যিক। আমাদের পরিবারে লেখালেখির ব্যাপারটা ছিল। গান ছিল সহজাত প্রকৃতির। সবাই গাইতে পারত। বাবার কাছেই আমাদের চার বোনের গানে হাতে খড়ি।
আমরা তখন চট্টগ্রামে থাকতাম। আমি প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। সে সময় গান শেখার জন্য আমার বড় তিন বোন সঙ্গীত পরিষদে যেতেন। আমি যেতাম খেলতে। কিন্তু খেলাটাকে পণ্ড করে আমি জানালার গ্রিল ধরে তাদের নাচ দেখতাম ও গান শুনতাম। এরপর থেকে আস্তে আস্তে গান শেখা শুরু হলো। ওস্তাদরা যা যা গান শেখাতেন সব মুখস্থ করে ফেলতাম। স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম হতাম। এরপর চলে এলাম রাজশাহী। রাজশাহীর অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অসম্ভব সঙ্গীতের পরিবেশ আমাকে আজও মুগ্ধ করে। আমার বড় আপুদের সহযোগিতায় আমি নানা রকম খেলাধুলা, নাচ ও গানে অংশ গ্রহণ করতাম। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম হতাম। আমি অনেক দুষ্ট ছিলাম এ জন্য আপুরা গান শিখতেন। আর আমাকে বেশির ভাগ সময়ই নাচে ব্যস্ত রাখতেন। নাচে আমি সব সময়ই প্রথম হতাম। এভাবেই বড় হওয়া। তবে যতদূর মনে পড়ে। একবার ওস্তাদ সালামত আলী, নাজাকত আলী বাংলাদেশে এলেন। আর সে সময় কোনো শিল্পী আসলেই বাবার সাথে দেখা করতেন। কারণ বাবা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের হর্তা-কর্তা ছিলেন। সব বড় অনুষ্ঠান সেখানে হতো। রাজশাহীর ক্লাসিক্যাল গানে ওস্তাদ আব্দুল জব্বারের কাছে বড় আপুরা সহ গান শিখতাম। আর আমি প্রায় সময় গান না শিখে পারিয়ে যেতাম। আমাকে একদিন ওস্তাদজি প্রশ্ন করলেন, তুমি কেন গান গাও না? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আপনি আমাকে যে সব গান শেখান, আমার একদম ভালো লাগে না। আমি বাচ্চাদের গান শিখতে চাই না। তারপরে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কী ধরনের গান তুমি শিখবে? আমি সঙ্গে সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা শিরোনামের একটি গান শুনিয়ে দিলাম। শোনার পর উনি আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, মা আমি তো বুঝতে পারিনি তুমি এতো ভালো গান করো। আমি ভয়ভীতি ছাড়াই আবার বললাম, আমি বড় আপু, এমনকি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে ভালো গাই। তখন তিনি আমাকে বললেন, তোমার পছন্দের গান শিখাবো, কী শিখতে চাও? তখন আমি বললাম, ‘রাগাশ্রী’ গান শিখব। অথচ ঐ সময় ওসব গান তেমন বুঝতাম না। এরপর ওস্তাদ আমাকে গান করতে দিলেন। আমি শিখলাম। এক সপ্তাহ পরেই ওস্তাদ সালামত আলী, নাজাকাত আলী রাজশাহী আসলেন। বাবার সাথে দেখা করতে আমাদের বাসায় উঠলেন। সেদিন সারারাত ক্লাসিক গান হলো। রাতে আমি সারা রাত জেগে থেকে না খেয়ে একটানা গান শুনলাম। ভোরে উঠেই গান শেষে ওস্তাদ নাজাকাত আলী জড়িয়ে ধরে বললেন, এটা কার মেয়ে? সারা রাত এই মেয়েটা গান শুনেছে। তখন আমার বাবা বললেন, এটা আমার মেয়ে, ভারী দুষ্টু কোনো কথা শুনে না। ও আধুনিক গান করে, গান করতে চায় না। তখন তিনি বললেন, না ওর আচরণ বলছে ও প্রচন্ড গান প্রেমী, ভীষণ গান পিয়াসী। পুরো অনুষ্ঠানে আপনার মেয়ে সন্ধ্যা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত দু’চোখের পলক ফেলেনি। আমাকে প্রশ্ন করল, তুমি গান করো? আমিও তখন ভয়ভীতি ছাড়াই উত্তর দিলাম, হ্যা, গান করি। তিনি বললেন, তাহলে তুমি একটা গান শোনোও। আমি ইয়া মুহাম্মদ গানটিই তাদের শুনালাম। খালি গলায় আমার করা গানটি শোনার পর তারা দু’জনেই মাথা হাত দিয়ে অনেক দোয়া করলেন। আমার বাবাকে বললেন, তুমি ভুল করোনা। ও দুষ্টু হলেও ওর ভিতরে যে গানের প্রতিভা আছে সেটাকে জাগাও। ওর সুরেলা একটা গলা আছে। ওকে এখন থেকে গ্রুমিং করাও। আমাদের দোয়া রইল, ও অনেক বড় শিল্পী হবে।
আপনি নজরুল সঙ্গীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন কী ভাবে?
ফেরদৌস আরা বলেন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি আমার একটা টান ছিল। কারণ ভোর হলেই দেখতাম বাবা ওস্তাদ বর গোলাম আলী খাঁ সাহেবের ক্ল্যাসিক্যাল গান শুনছেন কিংবা আমির খাঁর গান বাজাতেন। এই যে শোনা একটি পরিবার থেকে, যদি এই রকম একটি ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে তাহলে যে কোনো শিল্পী বিখ্যাত না হলেও তার কণ্ঠে অন্তত সুর থাকবে। আমার বাবার বাড়ি ছিল এলিফ্যান্ট রোডে। সেখানে গ্যারেজের উপরে দুইটি রুম ছিল, সেখানে আমরা প্র্যাকটিস করতাম। এখানে দেখা যেত, পড়াশুনা শেষ করে রাত ১২টার পর ঐ রুমে গিয়ে সব ভাই বোনেরা যন্ত্র, নিয়ে বসে গান শুরু করতাম। সুরে বাঁধা পরিবার ছিল। বাবার করা অনেক গান রেকর্ড করে রেখেছি। আর আমার চাচা প্রয়াত বিশিষ্ট লেখক, সাহিত্যিক ও সঙ্গীত বিশারদ আব্দুস শাকুর তিনিও প্রায় বাসায় আসতেন। আর তার নিজের গাওয়া বেশ কিছু রেকর্ড করা গানও রয়েছে।