Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

লাল ফিতাকে একটু নাড়া দিতে হবে-গৌতম ঘোষ

কলকাতার অন্বেষা গৌতম ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছে।
বাংলাদেশ-ভারতের চলচ্চিত্র এবং সাংস্কৃতিক ঐক্য নিয়ে এ লেখাটি
আনন্দ আলো’র পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো

-সম্পাদক

অন্বেষা: আপনি বিগত তিন দশক ধরে দুই বাংলার প্রযোজক, অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং কলাকুশলীদের নিয়ে একের পর এক সফল চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে গেছেন দুই দেশের দর্শকদের। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘মনের মানুষ’, ও ‘শঙ্খচিল’ – আপনার এই তিনটি ছবির পটভূমি বাংলাদেশ। ‘শঙ্খচিল’ ছাড়া ‘মনের মানুষ’ ও ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ দুটো ছবিতেই দেশ-ভাগের আগেকার অখণ্ড বাংলার কথা বলা হয়েছে। ‘শঙ্খচিল’ অবশ্য সমকালীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। ওপার বাংলার মানুষের জীবন সংগ্রামকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরাই কি আপনার ছবির মূল উদ্দেশ্য ছিল?
গৌতম ঘোষ: আমি বাংলাদেশের সঙ্গে তিনটে যৌথ প্রযোজনা করেছি। ৯০-এর দশকে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ২০০৯-১০ এ ‘মনের মানুষ’ এবং ২০১৫ এ ‘শঙ্খচিল’। এই তিনটে যৌথ প্রযোজনার মূলত প্রথম দুটোর প্রেক্ষাপট এবং অবস্থান তৎকালীন পূর্ববঙ্গ- এখনকার বাংলাদেশ। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে মোটামুটি আমরা ধরার চেষ্টা করেছিলাম ত্রিশ দশকের শেষ এবং চল্লিশের গোড়ার কথা। চিত্রনাট্যে তার খানিকটা আভাস আছে যে পশ্চিমে যুদ্ধ বেঁধেছে। আর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র যে সময়কাল তখন অখণ্ড বাংলাদেশ। তার আগে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়ে গেছে কিন্তু আবার ১৯১১ সালে দুই বাংলা একত্রিত হয়েছে।
বাংলার ভৌগোলিক পরিবর্তন কিন্তু বহুবার হয়েছে। সে পরিবর্তন আমরা দেখি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে হয়েছে। তবে সব থেকে বড় আঘাত বোধহয় ’৪৭ সালের বাংলা ভাগ। যাই হোক, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র যে প্রেক্ষাপট সেখানেও অখণ্ড বাংলা এবং সেখানে নদী… সে নদীর মধ্যে কোনও বাধা নেই, কোনও বেড়া নেই, কোনও ভৌগোলিক বিভাজন নেই। পদ্মা, মেঘনা এবং অসংখ্য শাখা নদী-উপনদী। পদ্মাই ওই ছবির নায়ক বা নায়িকা। তাকে ঘিরে মানুষের জীবন, মূলত জেলে পাড়ার জীবন। তাদের প্রেম, ভালোবাসা, নানান রকমের অনুভূতি এবং তার সঙ্গে স্বপ্ন-ময়না দ্বীপের স্বপ্ন, কুবেরের নিজের পরিবারের স্বপ্ন, আরও অসংখ্য মানুষজনের স্বপ্ন। পদ্মার দুই ধারের যে পরিমণ্ডল, মানব সমাজ, সেখানে বাস করে মূলত বাঙালি। সেই বাঙালির মধ্যে কারও ধর্ম হয়তো ইসলা, কারও হয়তো হিন্দু। কিন্তু তারা সকলেই একই গ্রামের বাসিন্দা। হয়তো দুটো পাড়া থাকতে পারে… হয়তো মুসলিম পাড়া আলাদা, হিন্দু পাড়া আলাদা কিন্তু সবসময় সকলের মধ্যে যাতায়াত রয়েছে, রয়েছে মেলামেশা। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’Ñ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি তৈরি হয়েছিল। আমরা দেখেছি বহু চরিত্রÑ হিন্দু মুসলমান সকলের মধ্যে একটা মিলমিশ রয়েছে। একে অপরের দুঃখে হাত বাড়িয়ে দেয়। সে এক অন্য জগৎ ছিল, পরবর্তীকালে তার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ করে আমি দারুণ আনন্দ পেয়েছিলাম। দুই বাংলার শিল্পী কলাকুশলীরা এক সাথে আমরা পদ্মায় ঝাঁপ দিয়েছিলাম। বিভিন্ন ঋতুতে আমাদের শুটিং হয়েছিলÑ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত। এভাবেই ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র একটা বড় অংশের শুটিং বাংলাদেশে হয়েছিল। আর অন্য একটা অংশের শুটিং হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে।
SHonkha-Chill২০০৯-২০১০ সালে আমরা ‘মনের মানুষ’ করি। ‘মনের মানুষ’-এর প্রেক্ষাপট হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর পঙ্গ দেশ। সেটা ছিল বৃহত্তর বঙ্গদেশ। আর ছিল লালন ফকিরের মতো একজন অসাধারণ মানুষ, যিনি আমাদের অন্য একটা জীবনের সন্ধান দিয়েছিলেন, গ্রাম বাংলায় একটা বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। অন্নদাশংকর রায়ের ভাষায়Ñ রামমোহন রায় যে রকম শহরের মানুষের মধ্যে একটা নব চেতনার আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন, লালন ফকিরও গ্রাম বাংলায় ঠিক সেরকমই একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। লালনের প্রেক্ষাপট ছিল উনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশ এবং কুষ্টিয়াতেই তাঁর আশ্রম ছিল। এর প্রেক্ষাপট মূলত কুষ্টিয়া পাবনা জুড়ে এবং এটাই আমার ছবির পটভূমি ছিল। সেখানে আমরা দেখিয়েছি যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বজরায় বসে বয়স্ক লালন ফকিরের আলাপ, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের কথোপকথন এবং গভীর দর্শন নিয়ে ভাবনা চিন্তা। এর প্রেক্ষিতটা ছিল সে সময়ের যখন ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ছিল শিলাইদহ, পাতিসর- এই সমস্ত অঞ্চলে। এই ছবিতেও আমাদের শুটিংটা হয়েছিল দুই বাংলায়। একটা বড় অংশের শুটিং করেছিলাম আমরা বাংলাদেশে। কিন্তু লালনের আশ্রম আমরা তৈরি করেছিলাম পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে। কারণ হচ্ছে কুষ্টিয়ায় যেখানে লালনের আশ্রম ছিল সে অঞ্চলের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেছে, নগরায়ন হয়ে গেছে। ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপট তৈরি করতে উত্তরবঙ্গে একটা জঙ্গলের কাছে, নদীর ধারে আশ্রম তৈরি করতে হয়েছিল। এই ছবিতেও আমাদের দুই বাংলায় লোকেশন ছিল এবং দুই বাংলার শিল্পী ও কলাকুশলীরা একসাথে কাজ কিেছল। এখানেও প্রেক্ষাপট কিন্তু বৃহৎ বঙ্গ।

এরপর ২০১৫ সালে আমি যে ছবিটা যৌথ প্রযোজনায় করি সেটার নাম ‘শঙ্খচিল’। একটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই ছবি নির্মিত হয় এবং তার চিত্রনাট্যও লেখা হয়। আসলে একবার ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ-এবং ‘বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড’-এর নানা রকম যে অনুষ্ঠান হয় তার একটাতে প্রধান অতিথি হিসেবে আমি আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেখানে দু’দিন ছিলামও এবং তখন আমি প্রত্যক্ষ করি এক সময় ভাগ হয়ে যাওয়া ভারতের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বর্ডার, পরবর্তীকালে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তরেখা। এই সীমান্ত খুব পরিকল্পনা না করে জধফপষরভভ সাহেব দিল্লীতে বসে করে ফেলেছিলেন। এরকম একটা ভৌগোলিক সীমান্ত বোধহয় পৃথিবীর কোথাও নেই। সেখানে দু’পারের মানুষজন একই ভাষায় কথা বলে, একই সংস্কৃতি এবং একই ঐতিহাসিক ব্যাকগ্রাউন্ড তাঁদের। যেহেতু দুটো দেশ, তাই তাদের অনেক রকমের সমস্যার মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাতে হয়। সেই সীমান্তের অনেক গল্প রয়েছে এবং সে গল্পগুলো বেশিরভাগই সত্য ঘটনা। এরকম একটি পরিবারের সত্য ঘটনা অবলম্বনে আমি তৈরী করেছিলাম ‘শঙ্খচিল’। এইবারেরও প্রেক্ষাপট ছিল দুই বাংলা। ইছামতির মাঝ বরাবর হচ্ছে সীমান্ত। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ওদিকে টাউন-শ্রীপুর, এদিকে টাকি। একটা সময় তো দুটোই একই জায়গা ছিল, একই বসতি ছিল মানুষজনের, দু’দেশের নাগরিকই এখানকার মানুষজন। ফলে এখানে শুটিং করতে গিয়ে অন্য ধরনের উপলব্ধি হয়। বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড এবং বিএসএফ-তাদের মধ্যেও নানান রকমের সমস্যা রয়েছে। কোনও বিএসএফ এর কর্মী হয়তো সুদূর রাজস্থান থেকে এসেছে, ফলে বাংলা ভাষা জানে না… তাদের অনেক সমস্যা হয়। আবার বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-এর কর্মীদেরও নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। কারণ এই বর্ডারটার পাহারা দেওয়া খুব কঠিন। শুধু কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে তো আর বর্ডার তৈরি করা যায় না। এখানকার মানুষজন তো যুগ যুগ ধরে নিজেদের মধ্যে যাতায়াত করে এসেছে। ফলে এখনও তাদের মধ্যে যাতায়াত আছে… মাঝে মাঝে তারা ধরা পড়ে, আবার কখনও পড়েনা। এটা একটা অন্য বাস্তব অবস্থা। আমি তার সম্মুখীন হই। আমার চিত্রনাট্য এবং এই ছবির বিষয়বস্তু ‘মনের মানুষ’ বা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে একেবারেই আলাদা। ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশ, তারপর তিরিশ দশকের বঙ্গদেশ, ভাগ হয়ে যাওয়া বঙ্গদেশ এবং এখন বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত নিয়ে কাজ করা এটা আমার কাছে একটা পরিক্রমা। আমাদের জাতি একই ভাষায় কথা বলে, একই সাংষ্কৃতিক প্রেক্ষাপট অথচ আমরা ভাগ হয়ে গেছি। এখন আমাদের ‘এবার-বাংলা’ বা ‘ওপার বাংলা’ বলতে হয়। কিন্তু মনের দিক থেকে হয়তো আমরা ভাগ হইনি… সেই কারণেই আমি ছবিগুলো তৈরি করেছি এবং আরও ছবি হয়তো তৈরি করব। এটা বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত সমস্যা দেখানোর জন্য নয়, এই দুই দেশের মানুষ যে একই মানুষ, একই ভাষায় কথা বলে, সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার জন্য আমি যৌথ প্রযোজনায় ছবিগুলো তৈরি করেছি।
অন্বেষা: দেশভাগের যন্ত্রণা কি আপনার ছবি করার অন্যতম তাগিদ? নাকি দুই বাংলার জীবন বৈচিত্র আর তার সাংস্কৃতিক ইতিহাসই আপনার মূল প্রেরণা?
গৌতম ঘোষ: আসলে আমার যেটা মনে হয় যে আমার ছবি করার তাগিদ হচ্ছে দুটো কারণে। একটা হচ্ছে অবশ্যই দেশভাগÑ কারণ আমার দেশ হচ্ছে ফরিদপুর, আমার মায়ের দেশ বিক্রমপুর, পদ্মার এপার-ওপার, অথচ আমি জন্মেছি ১৯৫০ সালে কলকাতায়। মনে আছে ছোটবেলায় আমি মাকে জিজ্ঞেস করতাম যে স্কুলের বন্ধুরা ছুটির সময়- সেটা পুজোর ছুটি হোক, ঈদের ছুটি হোক, ক্রিস্টমাসের ছুটি হোক- তারা দেশের বাড়িতে যায়, আমরা কেন যাই না? মা বলেছিলেন, দেখ তোদের দেশের বাড়ি একটা আছে কিন্তু ওখানে এখন যাওয়া যায় না। ফলে এটাও একটা আমার কাছে যন্ত্রণা অথচ আমার ঠাকুমার মুখে পদ্মার গল্প অনেক শুনেছি।
ফলে সেটা মনের মধ্যে কাজ তো করতই ছোটবেলা থেকে। কবে একদিন যেতে পারব আমার নিজের দেশে, পদ্মা দেখতে পাব, মেঘনা দেখতে পাব এবং সেখানে নৌকো চড়ে ঘুরে বেড়াব… এসব স্বপ্ন তো ছিলই। তারপর কত রকমের পূর্ববঙ্গের খাবারের গল্প শুনেছিÑ নানা ধরনের রসনা তৃপ্তির পদ, সে সবগুলো খুব আমাকে অ্যাটাক্ট করত। আমার মনে আছে আমাদের বহু আত্মীয় স্বজন যাঁরা রেফিউজি কলোনিতে, বিজয়গড়ের দিকে থাকতেন, তাঁদের বাড়িতে গেলে সেই বিক্রমপুরের বিশেষ মিষ্টি বা নাড়ু খেতে খুব ভালো লাগত। আসলে আমার ছোটবেলার থেকেই মনের মধ্যে এই কৌতুহলটা ছিল কেমন দেকতে আমার দেশটা? কেমন সেখানকার মানুষজন? এটা একটা অবশ্যই কারণ। আর তা তাছাড়া বড় হয়ে বুজতে পেরেছি যে আমাদের সাংস্কৃতিক যোগাযোগটা কোথায়, কেন দেশটা ভেঙে গেল? কেন বার বার বাংলার ভৌগোলিক মানচিত্র পাল্টে গেছে? আমাদের দুর্ভাগ্য যে বহু ঝড় ঝঞ্ঝা, মহামারী, মন্বস্তর, উদ্বাস্তু সমস্যা, দেশভাগ, রক্তপাত এগুলো আমাদের মধ্যে দিয়ে গেছে, আমরা বাঙলিরা দেখেছি। অথচ আমাদের একটা দারুণ সাংষ্কৃতিক প্রেক্ষাপট আছে। আমাদের একটা বিরাট সংগীতের ভান্ডার রয়েছেÑ নানা জায়গাকার আঞ্চলিক সংগীত, তার সঙ্গে শাস্ত্রীয় সংগীত। রবীন্দ্রনাথও তো অনেক কিছুর সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে একটা বিরাট বাংলার ঐতিহ্রকে জানার ইচ্ছেও আমার প্রবল ছিল বলে আমি বার বার ছুটে গেছি। কখনও পদ্মার পারে, কখনও সুরমা নদীর পারে, সিলেটের ওখানে, কখনও বা দক্ষিণবঙ্গে, খুলনা হয়ে সুন্দরবনের দিকে… নানান জায়গায় এবং বিভিন্ন ধরনের মানুষজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ রিলিজ হয়েছিল খুব সুন্দর করে। তখন আমরা বিভিন্ন সেন্টারে ঘুরে বেড়িয়েছি… চট্টগ্রাম পর্যন্ত গেছি দেখতে যে বিভিন্ন জেলার মানুষ কীভাবে আমাদের ছবি নিচ্ছেন। ফলে সেটাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা। একটা তো ছিল ছোটবেলার থেকে নিজের দেশকে জানার ইচ্ছে এবং এই বিরাট বৃহৎ বঙ্গকে দেখা, সেই সব মানুষজনকে দেখা যারা মুলত বাংলা ভাষায় কথা বলে। হয়তো অনেক ফরধষবপঃ রয়েছে, কিন্তু এই বাংলা ভাষাভাষী মানুষজন যাঁরা দুই বৃহৎ নদীর অববাহিকাতে বাস করেন- একদিন থেকে ব্রহ্মপত্র, মেঘনা আর আরেকদিকে গঙ্গা, পদ্মা এবং একটা বিরাট বদ্বীপ যেটা গিয়ে বঙ্গোপসাগরে মেলে। এই ভুখন্ডকে জানার প্রবল ইচ্ছে আমাকে বার বার এদিক ওদিক ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে।
অন্বেষা: ‘অন্বেষা’ পত্রিকার এবারের সংখ্যার বিষয় দুই বাংলার সাংস্কৃতির মেলবন্ধন। এই ব্যাপারে দুই বাংলার চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যৌথ প্রযোজনার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার অভিমত কী?
গৌতম ঘোষ: ‘অন্বেষা’ পত্রিকাকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা, তাঁরা দুই বাংলার সাংষ্কৃতিক মিলন নিয়ে একটা কাজ করছেন।
যৌথ প্রযোজনার ভবিষ্যৎ…। আমার মনে হয় যৌথ প্রযোজনা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে তার নীতিমালা, কীভাবে কী হবে দুই দেশের মধ্যে, এই নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা বলেছি এর অনেক সংশোধন হওয়া উচিত, তার কারণ অর্থনৈতিক পরিবেশ বদলে গেছে। কিছু কিছু সংশোধন অবশ্য হয়েছে। এখন নিয়মটা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের প্রযোজক বাংলাদেশি টাকার লগ্নি করবেন আর পশ্চিমবঙ্গের প্রযোজক ভারতীয় টাকায় লগ্নি করবেন। ছবি শেষ হলে যে ব্যবসা হবে, তাতে বাংলাদেশের ব্যবসা বাংলাদেশের প্রযোজকের, পশ্চিবঙ্গের ব্যবসা পশ্চিমবঙ্গের প্রযোজকের বা ভারতের প্রযোজকের। আর বিদেশেÑ যেমন আমার ছবির ক্ষেত্রেই হয়েছে, যে সমস্ত জায়গায় ছবি বিক্রি হবে সেটা ইনভেস্টমেন্ট অনুযায়ী শেয়ার হয়ে যাবে দুই দেশের মধ্যে কারণ বিদেশ থেকে টাকা আসবে যধৎফ পঁৎৎবহপু তে। এই মোটামুটি একটা নীতিমালা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন চলছি।
কিন্তু এর সমস্যা আছে। আমাকে তিনটি ছবি করতে গিয়ে ভাবতে হয়েছে আমি কতটা শুটিং বাংলাদেশে করব, কতটা পশ্চিমবঙ্গে করব। এটাতে শৈল্পিক স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়। অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে আমি করবার চেষ্টা করেছিÑ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তেও, যাতে বাংলাদেশের একটা লগ্নির অংশ হয়। পশ্চিমবঙ্গে শুটিং হলে ভারতীয় প্রযোজকদের একটা লগ্নি হয়। এইভাবে তিনটে ছবিতেই ভাগ ভাগ করে লোকেশন রাখা হয়েছে। পোস্ট প্রোডাকশন এর কাজও অনেকটা ভারতেই হয়েছে, কিন্তু সেই সময় অন্যভাবে বাংলাদেশের প্রযোজক সেটা পুষিয়ে দিয়েছেন। এটা একটা খুব কঠিন ব্যাপার। তার কারণ ভারতীয় মুদ্রা ও বাংলাদেশি মুদ্রার মধ্যে অফিসিয়াল কোনও ট্রানজিকশন নেই। ঁহফবৎযধহফ তো চলেই, হুন্ডি চলে, সবকিছুই চলে। ফলে আমার যেটা মনে হয়… আমি অনেকবার বাংলাদেশের মন্ত্রী মহলে বলেছি, ভারতের মন্ত্রী মহলে বলেছি বা আমলাদের বলেছি, যে অন্যান্য প্রোডাক্ট এ যে আদান প্রদান হয়, ষবঃঃবৎ ড়ভ পৎবফরঃ ড়ঢ়বহ করা হয়, সেটা যধৎফ পঁৎৎবহপু তেই। ঠিক সেই রকমই আমাদের যৌথ প্রযোজনাকে টিকিয়ে রাখতে হলে, ভালো করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, যধৎফ পঁৎৎবহপু তে একটা ভঁহফ তৈরি করা দরকার। সেখানে ইনভেস্ট করবেন শুধুমাত্র ভারতের বা বাংলাদেশের প্রযোজকই নয়, সেখানে একজন ইংল্যান্ড থেকে ইনভেস্ট করতে পারেন, অষ্ট্রেলিয়া থেকে ইনভেস্ট করতে পারেন, ইউরোপ থেকে ইনভেস্ট করতে পারেন। হয়তো আমার একটা কোনও বিষয় মনে হয়েছে, আমি পুরোটাই সিলেটে শুটিং করব বা কোনও একজন পরিচালকের মনে হয়েছে এই বিষয়টা আমাদের পশ্চিমবঙ্গে পুরুলিয়া জেলায় শুটিং করব। হ্যাঁ, করা যেতে পারে। কোনও অসুবিধে নেই যদি একটা এরকম ধৎৎধহমবসবহঃ করা যায়। এটা এমন কিছু কঠিন নয়। লাল ফিতেকে একটু নাড়া দিতে হবে। তাহলেই এটা সম্ভব এবং এটাই কিন্তু বাস্তব। এটাই যদি করা যায় তাহলে যৌথ প্রযোজনা আরও বাড়বে। তার কারণ সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে যদি থিয়েট্রিক্যাল রিলিজ হয়, তবে থিয়েট্রিক্যাল রিলিজ এর টাকা এখানে শেয়ার করা যাবে। এখানকার থিয়েট্রিক্যাল রিলিজ-এর টাকা ওপার বাংলার শেয়ার করা যাবে। এই কতগুলো প্রাকটিক্যাল দিক নিয়ে আমি অনেকগুলো চিন্তা ভাবনা করেছি, আলোচনা করেছি, আরও অনেক প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে আমরা বহু মিটিংও করেছি। এখন দেখা যাক, যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। আমাদের ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রি একটা ক্রাইসিস-এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই ক্রাইসিসটা একটু কমলে এগুলো নিয়ে আবার উঠে পড়ে লাগতে হবে। তবে হ্যাঁ ওটিটি প্লাটফর্মে, যেখানে এখনও নিয়ম কানুন ঠিকমতো তৈরি হয়নি, সেখানেও কিন্তু দুই বাংলার প্রযোজনা করা যায়। তবে ওখানেও ইনভেস্টমেন্ট করতে হবে যধৎফ পঁৎৎবহপু তে কারণ এই দু’দেশের টাকার কোনও এক্সচেঞ্জ নেই। কিংবা আমাদের… এই যে ঝঅজঈ পড়ঁহঃৎরবং…. ঝঅজঈ -এর তো শুধু বড় বড় মিটিংই হয়, কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, তারপর আর কিছু হয় না। বহু বছর ধরে দেখছি। এই ঝঅজঈ পড়ঁহঃৎু গুলোর মধ্যে অন্তত একটা টাকার বা মুদ্রার এক্সচেঞ্জকে চালু করতে হবে। সেটা কেন আমরা করতে পারছি না বা আমি হয়তো জানি না সমস্ত ব্যাপারটা কী বা কোন লেভেলে হয় বা কোন লেভেলে হয় না। কিন্তু এইটা না করতে পারলে আমি কিন্তু যৌথ প্রযোজনা খুব ভালো করে করতে পারব না। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, যৌথ প্রযোজনার একটা বিরাট বাজার অপেক্ষা করছে সারা পৃথিবী জুড়ে। কারণ অসংখ্য বাঙালি ছড়িয়ে আছে বিশ্বের সমস্ত অঞ্চলে। সেই বাঙালিদের সত্তর ভাগ হচ্ছেন বাংলাদেশের বাঙালি। সেই বাজারটাকে আমরা ছুঁতে পারছি না। অথচ তামিল- তেলেগু কমিউনিটি আমাদের থেকে ছোট হয়েও তারা বিরাট ব্যবসা চালাচ্ছে সিনেমার ক্ষেত্রে। সেটা করছে আমেরিকা থেকে, ইউরোপ থেকে বা অন্যান্য জায়গা থেকে। এখানে বোধহয় আমরা বাঙালিরা কুয়োর ব্যাঙ। আমাদের এই ব্যবসার বুদ্ধি নেই বা সধৎশবঃরহম ধনরষরঃু নেই। এটা করতে পারলে বাংলা ছবি, একক বা দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনায় একটা বিরাট বাজার পেয়ে যাবে এবং তাতে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করার চেষ্টা করতে পারবে। কারণ বাজার যদি বড় হয়, ছবির রিটার্ন বা রেভিনিউ অনেক বাড়বে। আর আমি সেই দিনের অপেক্ষায় পড়ে রয়েছি। আমারও তো বয়স হচ্ছেÑ কিন্তু আমি বয়স নিয়ে ভাবি না। আরও হয়তো কিছুদিন দেখব, কিংবা আমরা যে চিন্তা ভাবনা করেছি সেই চিন্তা ভাবনা পরের প্রজন্ম বয়ে নিয়ে যাবে। এভাবেই আমি ভাবি, এভাবেই আমি স্বপ্ন দেখি।