Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

সুস্থ ভবনের রূপকার অধ্যাপক আশিক জোয়ার্দ্দার

মোহাম্মদ তারেক

অধ্যাপক ডঃ মোঃ আশিকুর রহমান জোয়ার্দ্দার একজন চৌকস স্থপতি, শিক্ষাবিদ ও গবেষক। জন্ম ১৯৭৯ সাল। খুলনা ও কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে পড়া শেষে ১৯৯১ সালে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং এর প্রতি আগ্রহ জন্মায় এবং আর্কিটেক্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ১৯৯৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িংএ তার ব্যাচের মধ্যে একমাত্র ছাত্র হিসেবে একশোতে একশো পান। এরপর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় স্থাপত্য বিভাগে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং প্রথম হয়েই (ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট) গোল্ড মেডেলসহ ২০০৫ সালের জুন মাসে স্থাপত্যে ব্যাচেলর ডিগ্রী  স¤পন্ন করেন। পরের মাসে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ২০০৭ সালে বুয়েট থেকে প্রাকৃতিক আলোর উপর মাষ্টার্স ও ২০১১ সাালে ইংল্যান্ডের লাফবারো বিশ^বিদ্যালয় থেকে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা শেষ করেন।

পিএইচডি’র ছাত্র থাকা অবস্থায় লাফবারো বিশ^বিদ্যালয়ের অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। পিএইচডির ফল প্রকাশের পূর্বেই বিশ^বিদ্যালয়ের হেলথ এন্ড কেয়ার ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন সেন্টারে সিনিয়র গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১২ সালে যখন গবেষকের পদ ছেড়ে বুয়েটে ফিরে আসেন তখন গবেষক হিসেবে ইংল্যান্ডে তার এক মাসের যে বেতন ছিলো তা ছিলো তৎকালীন বুয়েটে তার এক বছরের বেতনের থেকে বেশী। বিদেশের উচ্চ বেতন ও সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেশে ফিরে আসার পেছনে মুল কারণ ছিলো, তিনি মনে করেন, বিদেশ থেকে অর্জিত তার জ্ঞান দেশের প্রয়োজন। সময় এসেছে এই জ্ঞান দেশের মাটিতে প্রয়োগ করার। তিনি ২০১৭ সালে বুয়েটের পূর্ণ অধ্যাপক হিসেবে পদন্নোতি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ২০১৭ সালে আই এল ও এর অর্থায়নে আমেরিকার মেরীল্যান্ড বিশ^বিদ্যালয় থেকে ফায়ার সেফটির উপর, জাপান সরকারের অর্থায়নে কিউসু বিশ^বিদ্যালয় থেকে ডিজাষ্টার ম্যানেজমেন্ট (ভূমিকম্প) এর উপর এবং ২০১৯ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর অর্থায়নে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এনার্জি ইফিসিয়েন্সি ও গ্রীণ বিল্ডিং এর উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণে অংশগ্রহন করেন। বর্তমানে তিনি বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের গ্রীন আর্কিটেকচার সেল (গ্রেস) এর কার্যনিবাহী পরিষদের চেয়ারম্যান ও সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৯ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিত ও সিডনি বিশ^বিদ্যালয়ের সাথে যৌথ গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড হেলথ এওয়ার্ড লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই এল ও, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জি আই জেড (জার্মানি) সহ বেশ কিছু স্বনামধন্য দেশী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের প্রধান হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।

স্থপতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ শতাধিক ভবনের ডিজাইন ও এসেসমেন্টের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের আলেকজান্ড্রা হাউস (ওল্ড হোম) ও বাংলাদেশে ইউনিফরম  ডিজাইন অব সোনালী ব্যাংক। ইতিমধ্যে তার অধীনে পোষ্ট গ্রাজুয়েট লেভেলের ডজন খানেক রিসার্চ ও আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলের শতাধিক রিসার্চ/ প্রজেক্ট স¤পন্ন হয়েছে। তিনি তার কাজের উপর দেশে ও বিদেশে এবং অনলাইন প্লাটফর্মে আড়াইশোর অধিক গবেষণা পত্র উপস্থাপনা করেছেন।

সুস্থ ভবন বলতে আমরা কি বুঝব? এ প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ড. মো: আশিকুর রহমান জোয়ার্দ্দার বলেন, একজন সুস্থ মানুষ বলতে আমরা যা বুঝি সেখান থেকেই আমরা একটা সুস্থ ভবনের সংজ্ঞা দাঁড় করাতে পারি। এই ধারনার উপর আমি ২০০৫ সাল থেকে কাজ করে আসছি। সর্বপ্রথম প্রয়োগ করি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার এর ফাইনাল থিসিস প্রজেক্টের উপর। একটি উদাহরণ দেই। সঠিকভাবে ভবনের দেয়াল, ছাদ এবং অভ্যন্তরীন ডিজাইনের মাধ্যমে ভবনের ভিতর পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো বাতাস চলাচল নিশ্চিত করে ভিতরের তাপমাত্রা আরামদায়ক রাখা সম্ভব। এখন যদি ভুল ডিজাইনের কারণে ভবনের ভিতরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। ভবনের বাসিন্দারা অসুস্থ হয়ে যায়। এর কারনে যদি সার্বক্ষনিক এসি চালিয়ে রাখতে হয় (স্যালাইনের মত)। এর জন্য প্রতি মাসে যদি বাড়তি অর্থ গুনতে হয়। তবে সেই ভবনটিকে আমি বলবো অসুস্থ। এখানে শুধু ভবনটি বাহ্যিকভাবে সুন্দর দেখতে হলে হবে না। একটি বাহ্যিকভাবে রূপবান ব্যক্তিও অসুস্থ হতে পারে। তখন তার বাহ্যিক রূপ গৌন হয়ে যায়। এক কথায় পরিবেশের ক্ষতি না করে  সাশ্রয়ী ভাবে ভবনের যারা বাসিন্দা তাদের সুস্থতা, আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা গেলেই আমরা ভবনটিকে সুস্থ ভবন হিসেবে সফল বলতে পারবো।

সুস্থ ভবনের স্থাপত্য চর্চায় নবীন ও প্রবীন স্থপতিরা কিভাবে দিক নির্দেশনা পেতে পারে? এ প্রসঙ্গে আশিক জয়ার্দ্দার বলেন, বর্তমানে আমি একটি পদ্ধতি উদ্ভাবনের কাজ প্রায় শেষ করেছি। একজন মানুষকে যেমন কিছু ডায়গনস্টিক টেস্ট এর মাধ্যমে তার সুস্থতা বা অসুস্থতা নির্ণয় করা যায়। ঠিক তেমনি কনস্ট্রাকশনের পূর্বে বা পরে ভবনের  ডিজাইনের কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষার মাধ্যমে এর সুস্থতা নির্ণয় করা যাবে। এক্ষেত্রে আমি কম্পিউটার ভিত্তিক বিল্ডিং সিমুলেশন সফটওয়ার, বিল্ডিং ইনফরমেশন মডেলিং, অপটিমাইজেশন ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে সর্বাধুনিক জ্ঞানের সমন্বয়ে সম্পূর্ন নৈর্ব্যক্তিক ভাবে কিভাবে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে ভবনের সুস্থতা পরিমাপ করা সম্ভব সেটি বের করার চেষ্টা করেছি। ২০১৬ সাল থেকে বুয়েটের গ্রীন আর্কিটেকচার সেল (গ্রেস) এর মাধ্যমে আমরা প্রকাশনাসহ  ত্রিশটির বেশি ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স, সেমিনার এবং ট্রেনিং এর মাধ্যমে এই সকল বিষয়ে জ্ঞান চর্চার জন্য প্রফেশনালদের সাথে একটি সেতু বন্ধন সৃষ্টি করেছি। বর্তমানে পেন্ডামিকের কারনে আমরা আমাদের এই জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রটিকে অনলাইনে ট্রান্সফার করেছি। ই-লার্নিং সুবিধার মাধ্যমে আমরা এখন আরও বেশী সংখ্যক বা সঠিকভাবে বললে, আগ্রহী যে কারোর সাথে এখন জ্ঞান চর্চায় অংশগ্রহন করতে পারি এই অনলাইন প্লাটফর্মে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অধ্যাপক ড: মো: আশিকুর রহমান জোয়ার্দ্দার বলেন, আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা, বাংলাদেশের কনষ্ট্রাকশন ইন্ডাষ্ট্রিতে থ্রিডি প্রিন্টিং টেকনোলজির সমন্বয় ঘটানো। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, কাগজের উপর যেমন লেখা প্রিন্ট হয়, সেভাবে জমির উপর বড় আকারের মেশিনের মাধ্যমে ভবন তৈরী হয়ে যাবে। উন্নত বিশে^ এই টেকনোলজি ব্যবহার করে ইতিমধ্যে অনেক ঘরবাড়ি তৈরী হয়েছে। তারা ভবিষ্যতে ছোটখাটো শহর তৈরীর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এগুলির বেশীর ভাগই একতলা বা দুইতলা। আমাদের দেশের ঘনবসতি ও বাসস্থান চাহিদার ব্যাপারটা মাথায় রেখে আমি থ্রিডি প্রিন্টেড বহুতল ভবন নির্মাণে আগ্রহী। থ্রিডি প্রিন্টেড টেকনোলজি ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে নিখুঁতভাবে সুস্থ ভবন তৈরি করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। থ্রিডি প্রিন্টারের কালি (ম্যাটেরিয়াল) হিসাবে দেশীয় কাচাঁমাল যেমন, ড্রেজিং সয়েল, খড়, সাথে প্লাষ্টিক সামগ্রী বা এ জাতীয় ফেলে দেওয়া ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার হতে পারে। তবে এগুলি নিয়ে প্রচুর গবেষণা এবং পরীক্ষার প্রয়োজন আছে। শিক্ষকতা ও গবেষণাকার্যে আমার সময়ের সিংহভাগ ব্যায় হয়ে যাওয়ায় মাঠ পর্যায়ে স্থাপত্যচর্চা বা পরীক্ষা নিরীক্ষার যথেষ্ট আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তা করা হয়ে উঠছে না। তবে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আমার ধারনার উপর কাজ করতে চাইলে আমি প্রয়োজনীয় পরার্মশ ও সহায়তা দিতে আগ্রহী।