Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্থাপত্যে ফের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন কাশেফ মাহবুব

কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। বাংলাদেশের খ্যাতিমান একজন স্থপতি। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরেই স্থাপত্যশিল্পে নিজের স্বতন্ত্র ধারা বজায় রেখেছেন। ১৯৯৫ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অজন করেন। ২০০৬ সালে তিনি সিডনির গ্লেন সুমারকাট এ মাস্টারক্লাস এ অংশগ্রহণ করেন। মেরিনা তাবাসসুমকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন আরবানা নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। ২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আরবানার কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাধীনভাবে স্থাপত্যচর্চা করে যাচ্ছেন। ২০১৬ সালে কাশেফ মাহবুব চৌধুরী তার ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার প্রকল্পের জন্য বিশ্বখ্যাত আগা খান অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী হন। ২০১০ সালে কাশেফ চট্টগ্রামের চাদগাঁও মসজিদের জন্য মনোনীত হন। ২০১২ সালে পেয়েছেন আর্কিটেকচারাল রিভিউ অ্যাওয়ার্ড। সম্প্রতি দ্য রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট ২০২১ আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স এ বিজয়ী হন। এবার শাহ সিমেন্ট ‘নির্মাণে আমি’তে খ্যাতিমান এ স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছে মোহাম্মদ তারেক।

রাজধানী ঢাকার নাগরিক কোলাহলের ভেতরে অবস্থিত ধানমন্ডি লেক যেন এক মুঠো প্রকৃতির স্পন্দন। সবুজ গাছ আর জলের অপূর্ব মিতালী। এই ধানমন্ডি লেকের পাড়েই সবুজে ঘেরা চমৎকার একটি অফিস আরবানা। সেই অফিসটিতে বসে একমনে কাজ করে চলেছেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। দেশের ঐতিহ্য, দেশজ উপকরণ আর যে জায়গায় প্রকল্পটি হবে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়ে ভাবনা থেকে শুরু হয়েছে পরিকল্পনা। তারপর চলেছে প্রজেক্টের মডেল বানিয়ে কাটাকুটি। অসংখ্য স্ট্যাডি মডেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ‘আরবানা’র অফিসে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে পাস করে বেরিয়ে নিজের হাতে গড়ে তোলেন ‘আরবানা’ নামের এই প্রতিষ্ঠানটি। সহকর্মীদের সঙ্গে ভীষণ আন্তরিক তিনি। এ কারণে সহকর্মীরা সবাই নিজের প্রতিষ্ঠানের মতোই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন অফিসে নতুন কেউ যোগ দিলে মজার একটা নিয়ম পালন করতে হয় তাকে। নিজের হাতে রান্না বান্না করে খাওয়াতে হয় সবাইকে। মেধাবী স্থপতি কাশেফ নিজেও রান্না করতে ভালোবাসেন। কাজের ফাঁকে মাঝে মধ্যে নিজেই করেন দারুন সব মজাদার রান্না বান্না। হয়তো তাই এই ব্যতিক্রমী নিয়ম। এ ছাড়া সারাক্ষণ শুধু কাজ আর কাজ। ব্যস্ততা তাকে দেয় না কোনো অবসর। ব্যস্ততা শুধু স্থাপত্য ভাবনা নিয়েই। চিন্তার গভীরে গেলে বাহ্যিক সব কিছু ভুলে যান। ভাবনায় ধরা দেয় একের পর এক অনিন্দ্য স্থাপত্য শৈলী। আবাসিক ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং অফিস কমপ্লেক্স, স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র সহ বিচিত্র ধরনের কাজ করেছেন তিনি। বরাবরই ছিল তার মৌলিক কিছু করার প্রয়াস। আর তাই তো সমাদৃত হয়েছেন বহুবার। ২০১৬ সালে গাইবান্ধায় অবস্থিত সৌন্দর্য মন্ডিত ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার স্থাপত্যের জন্য কাশেফ মাহবুব চৌধুরী জিতে নিয়ে ছিলেন বিশ্ব খ্যাত ‘আগা খান’ পুরস্কার। সবুজ বাংলার এই অপূর্ব স্থাপনা দিয়ে কাশেফ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বয়ে এনেছিলেন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে অকুণ্ঠ প্রশংসা আর বিরল সম্মান। তার সাথে ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদ স্থাপত্যের জন্য স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমও আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে আরেক খ্যাতিমান স্থপতি সাইফ উল হক স্থানীয় সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে সাশ্রয়ী, স্থিতিশীল ও পরিবেশ বান্ধব এক স্থাপনা ‘আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট’ নির্মাণ করে আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার পান।
আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার স্থাপত্যের দুনিয়ায় অত্যন্ত সম্মানজনক। এমন কি এর আগেও স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী আগা খান পুরস্কারের মনোনয়নও পেয়েছিলেন দুবার। ২০০৪ সালে স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমের সঙ্গে যৌথ ভাবে করা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘরের জন্য। ২০১০ সালে চট্টগ্রামের নিভৃত গ্রামে করা চাঁদগাঁওয়ে নির্মিত একটি মসজিদের জন্য মনোয়ন পান কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। ভারতের সারা জাগানো জে কে সিমেন্ট অ্যাওয়ার্ড এবং সারা বিশ্বে খ্যাত ‘আগাখান’ অ্যাওয়ার্ড বাংলাদেশে এসেছে একাধিকবার। দেশের মেধাবী স্থপতিদের হাত ধরে তাদের সৃষ্ট স্থাপত্যের গুণগত মানের জন্য। স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে স্থাপত্যের চর্চা এবং বিকাশ, দেশের ও গুণী স্থপতিদের কাজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দারুণ ভাবে স্বীকৃত। তাদের মেধার স্বীকৃতিতে যে অর্জন তা দেশেল ভাবমূর্তিকে অধিকতর উজ্জল করে তুলছে।

সম্প্রতি এমন একটি অ্যাওয়ার্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুনরায় বাংলাদেশের সুনাম উজ্জল করে তুললো। করোনা মহামারীর এ দুর্যোগের মাঝেও কিছু আনন্দের সংবাদ আসে। আর সেই আনন্দের সংবাদটি নিয়ে এলো সাতক্ষীরার শ্যাম নগরের দৃষ্টিনন্দন ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের স্থাপনাটি। এ দেশের স্থাপত্যের গুণগত মানের কথা আরেকটিবার বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিল। সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাটি নকশা করা জন্য ধন্যবাদ স্থপতি কাশেফ মহাবুব চৌধুরী, তার ডিজাইন টিমের সদস্য ও স্বনামধন্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ‘আরবানা’কে।
নদীমাতৃক দেশে দেশীয় সংস্কৃতি ও জলবায়ুকে বিবেচনায় রেখে সাতক্ষীরার শ্যাম নগরে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল’ ডিজাইন এর মাধ্যমে আর আই বি এ (জওইঅ) ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সিলেন্স ২০২১ অর্জন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মুখ আবারও উজ্জল করল কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।
স্থাপত্যের ক্ষেত্রে স্বীকৃতি কাশেফের পক্ষে নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি দ্য রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট (জওইঅ) ২০২১ আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স এর জন্য বিজয়ীদের নাম ঘোষনা করা হয়েছে। ১১টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের ১৬টি সৌন্দর্যমন্ডিত প্রকল্প তাদের নকশার উৎকর্ষতার জন্য এবং স্থাপত্যের উচ্চাকাক্সক্ষার উদাহরণ এবং অর্থপূর্ণ সামাজিক প্রভাব প্রদান করার যোগ্যতার জন্য নির্বাচিত হয়। আরআইবিএ ইন্টারন্যাশাল অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স প্রতি দুই বছর পর পর এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এ পুরস্কারের লক্ষ্য হল বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অণুপ্রেরণামূলক প্রকল্প গুলোকে স্বীকৃতি দেয়া। বিজয়ী প্রতিটি প্রকল্প পুরস্কারের নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় অত্যন্ত কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আরআইবিএ এ পুরস্কার গুলো যে কোনো জায়গার জন্য, যে কোনো স্থপতিদের জন্য উম্মুক্ত ছিল। শুধু মাত্র যুক্তরাজ্য বাদে। কারণ এটি আরআইবিএ স্টালিং পুরস্কার নির্ধারিত হয়। আরআইবিএ সভাপতি অ্যালান জোন্স জানান, আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান স্থপতিদের ডিজাইন করা বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী, চিত্তাকর্ষক এবং প্রভাবশালী স্থাপত্য উদযাপন করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।
বড় বড় শহরে মাস্টার প্লানস এবং অবকাঠামো পরিকল্পনা, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, হাসপাতাল এবং স্মৃতিসৌধ থেকে শুরু করে বেসরকারী আবাসস্থল পর্যন্ত ১১টি দেশের ১৬টি নতুন প্রকল্প ২০২১ আরআইবিএ আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন।
তার মধ্যে বাংলাদেশের সাতক্ষীরার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল স্থাপনাটি বিজয়ীদের মধ্যে অন্যতম। কৃতিমান স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী যে স্থাপনাটির জন্য আরআইবিএ ইন্টারন্যাশাল অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সিলেন্স ২০২১ এর জন্য বিজয়ী হয়েছেন। সেটির অবস্থান সবুজে ঘেরা ছিমছাম সাতক্ষীরার শ্যামনগরে। নাম ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। ৪৬ হাজার ৯০০ বর্গফুট আয়োতন জুড়ে এ হাসাপাতালটি। হাসপাতালের মূল গেট দিয়ে ঢুকতেই মন কারে স্নিগ্ধ পরিবেশ আর দৃষ্টিনন্দন নির্মাণ শৈলী। জলবায়ু পরিবর্তন এবং লবণাক্ত প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলীয় মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় পরিবর্তন আনতে গড়ে তোলা হয়েছে এ হাসপাতালটি। পরিবেশ বান্ধব এবং আলো-বাতাসের বিষয়টি মাথায় রেখে এর ডিজাইন করা হয়। এর ব্যবহৃত সব উপকরণই স্থানীয় ইটের গাঁথুনি দিয়ে হাসপাতালটি একাধিক ব্লকে বিভক্ত। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে। যা তার রোগীদের প্রকৃতির সাথে সংযুক্ত করে এবং মাইক্রো-জলবায়ু শীতল করণে সাহায্য করে। প্রান্তিক মানুষের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌছে দিয়ে ২০১৩ সালে স্থানীয়দের দান করা জমিতে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু করে। জরুরি সেবার জন্য ইনডোর আউটডোর সার্ভিস, অত্যাধুনিক সুপার সব, অপারেশন থিয়েটার, ল্যাব আর ফার্মাসি সহ ৮০ শয্যার হাসপাতালটিতে রয়েছে নানান-সুযোগ সুবিধা। মাত্র ১০০ টাকায় মিলছে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ। কর্তৃপক্ষ জানান, জলবায়ূ পরিবর্তন জনিত দুর্যোগের পর উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের লক্ষেই এই উদ্যোগ।

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন কাশেফ চৌধুরী। স্থপতি উত্তম কুমার সাহার নন্দন লিমিটেড নামের একটি ফার্মে যোগ দেন তিনি। সেখানে তিনি বছর খানেক চাকরি করার পর আরেক স্থপতিকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘আরবানা’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। ২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ‘আরবানা’র একক কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে অবলম্বন করে কাশেফের স্থাপত্য শৈলীর দর্শন গড়ে উঠেছে। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে কেরানীগঞ্জের লাল মসজিদ, গাইবান্ধায় ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার, কক্সবাজারে উখিয়া স্কুল, গুলশানের গুলশান সোসাইটি মসজিদ, ইএইচএল প্রিমিয়াম কনডমি নিয়ামস অ্যাপার্টমেন্ট, চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও মসজিদ ইত্যাদি। এছাড়াও মেরিনার সঙ্গে যৌথ ভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘর ইত্যাদি । কাশেফ মাহবুব চৌধুরী এক সময় স্থির চিত্রের অনরাগী ছিলেন। বেশ কয়েকটি একক প্রদর্শনী করেছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে অ্যারাউন্ড ঢাকা (২০০৪) প্লট নাম্বার ফিফটি সিক্স (২০০৯) ও দি নাইট অব ফিফটিন নভেম্বর (২০১১) উল্লেখযোগ্য।