Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ফ্লপ মাস্টারই হয়ে উঠলেন বাংলা সিনেমার মহানায়ক

অনিকেত রায়

অনেকেই হয়তো জানেন না বাংলা সিনেমার মহানায়ক উত্তম কুমারকে তাঁর অভিনয় জীবনের প্রথম ভাগে ‘ফ্লপ মাস্টার’ হিসেবে ডাকা হতো। কারণ অভিনয়ের প্রথম দিকে তাঁর অভিনীত ৭টি সিনেমাই ফ্লপ হয়। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম ‘দৃষ্টিদান’। বক্স অফিসে ছবিটি মুখ থুবড়ে পড়ে। তারপর পর্যায়ক্রমে তাঁর অভিনীত ৭টি ছবির ভাগ্যে ‘ফ্লপ’ শব্দটি যোগ হয়। আর তাই উত্তম কুমারকে অনেকেই ফ্লপ মাস্টার হিসেবে ডাকতে শুরু করেন। তাই বলে দমে যাননি উত্তর কুমার। অধ্যবসায় আর কর্তব্যনিষ্ঠা এবং অভিনয়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসাই উত্তম কুমারকে শেষ পর্যন্ত মহানায়কের খ্যাতি এনে দেয়।

‘বসু পরিবার’ নামের সিনেমাটিই তাঁর অভিনয় ভাগ্য বদলে দিতে শুরু করে। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ নামের সিনেমাটি তাকে এনে দেয় তারকাখ্যাতি। উত্তম-সূচিত্রা জুটির প্রথম হিট ছবি এটি। এরপর তো শুধুই সাফল্যের গল্প । নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে উঠলেন বাঙ্গালীর প্রিয় অভিনেতা উত্তম কুমার। ১৯২৬ সালে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৮০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ৫৪ বছরের জীবনে দুই শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। যার মধ্যে অধিকাংশ সিনেমাই সুপার ডুপার হিট হয়েছিল।

উত্তম কুমারের অভিনয় সৌকর্য বিখ্যাত চিত্র পরিচালকদের আগ্রহ কেড়ে নেয়। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের অধিকাংশ সিনেমার নায়ক ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সত্যজিত রায় তাঁর সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ‘নায়ক’ এর নায়ক হিসেবে উত্তম কুমারকেই খুঁজে নিয়েছিলেন। ‘নায়ক’ উত্তম কুমার অভিনীত ১১০ তম সিনেমা। এই সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর বিশ্বখ্যাত অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর উত্তমকুমারের অভিনয়ের ভূয়শী প্রশংসা করেছিলেন। উত্তম কুমারের সাথে দেখা করার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেছিলেন।

অভিনয় ছাড়াও একাধিক ছবির প্রয়োজক ছিলেন উত্তম কুমার। সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক হিসেবেও ভূমিকা রেখেছেন একাধিক ছবিতে। ‘অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি’, ‘চিড়িয়াখানা’ সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতি স্বরুপ ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন।

৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬ উত্তম কুমার জন্মেছিলেন। পারিবারিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। পরিবারের আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে কেরানীর চাকরিও নিয়েছিলেন। কিন্তু অভিনয়ের ইচ্ছেটা তাকে সারাক্ষণ একটা তাড়ার মধ্যে রাখতো। আহেরিটোলায় ‘সুহৃদ সমাজ’ নামে একটি গ্রুপে যোগ দেন তিনি। নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করতে থাকেন। থিয়েটারে অভিনয় করতে করতেই একদিন সিনেমায় অভিনয়ের ডাক পান। প্রথম ছবি দৃষ্টিদান। ভালো ব্যবসা করেনি। তবে দৃষ্টিদানই উত্তম কুমারের অভিনয় জীবনের প্রেরণা হয়ে ওঠে। দুই শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেন মহানায়ক উত্তম কুমার। উত্তম-সূচিত্রা জুটি বাংলা সিনেমার অমূল্য সম্পদ। মূলত উত্তম সূচিত্রা জুটিই উত্তম এবং সূচিত্রাকে বাংলা সিনেমায় কিংবদন্তী তূল্য করে তোলে। তবে উত্তম কুমার অভিনীত ‘নায়ক’ ছবিটি নানা কারণে ব্যাপক আলোচিত।

সত্যজিত রায়ের সিনেমা মানেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতি অনিবার্য। কিন্তু ‘নায়ক’ সিনেমায় সৌমিত্রকে নেননি সত্যজিৎ রায়। নিয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। নির্মাণ কাল ১৯৬৬। ৫৫ বছর আগের সিনেমা ‘নায়ক’। উত্তম কুমার তখন প্রতিষ্ঠিত নায়ক বাংলা সিনেমায়। তাঁর এই অবস্থানকেই কাজে লাগিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। সিনেমার একজন প্রতিষ্ঠিত নায়ককে দিয়েই তিনি প্রকাশ করেছেন অন্য একজন নায়ককে। পাশাপাশি একজন জনপ্রিয় তারকার ভেতর জগৎকেও তুলে ধরেছেন।

নায়কের নাম অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিতে দিল্লী যাবেন। আকাশ পথের টিকেট মেলেনি। তাই যাচ্ছেন রেলগাড়িতে। রেলগাড়িতেই পরিচয় হয় অদিতি সেনগুপ্ত নামে একজন নারী সাংবাদিকের সাথে। অদিতি আধুনিক নারী। মেয়েদের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ওই পত্রিকার জন্য নায়ক অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। শুরু হয় সিনেমার মূল গল্প।

ধারনা করা হয়, উত্তম কুমারের আিভনয় জীবনের ছায়া অবলম্বনে ‘নায়ক’ এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ব্যক্তিগত জীবনে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে সিনেমায় নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন উত্তম কুমার। কিন্তু অভিনয়ের জার্নিটা মোটেই সহজ ছিল না। ফ্লপ ছবির নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠার বাস্তব গল্পেরই প্রতিচ্ছবি সত্যজিৎ রায়ের আলোচিত সিনেমা নায়ক-এ উঠে এসেছে। ১৯৬৬ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ডের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্ম এবং শ্রেষ্ঠ কাহিনী ও চিত্রনাট্য বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে নায়ক।