Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ক্রীড়া ও সংস্কৃতির জন্য অপার ভালোবাসা ছিল তাঁর

শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে। একজন মুক্তিযোদ্ধা। ক্রীড়া সংগঠক এবং সংস্কৃতি কর্মী। একটি দেশের প্রেসিডেন্ডের ছেলে তিনি। অথচ ছিল না কোনো অহংকার। সাধারন মানুষের মতো চলাফেরা করতেন। অথচ স্বাধীনতা বিরোধী চক্র তার বিরুদ্ধে নানা সময়ে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস কখনও চাপা থাকে না। দেশের মানুষের কাছে মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া সংগঠক ও নাট্যকর্মী শেখ কামালের আলোকিত জীবন এখন অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে।
রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৪৯ সালের ১৪ই অক্টোবর বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেফতার হন, শেখ কামাল তখন দু’মাস দশ দিন বয়সের ছোট্ট শিশু। তিনি ১৯৫২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন কারাগার থেকে মুক্তি পান, তখন শেখ কামাল অল্প অল্প কথা বলতে শিখেছেন মাত্র। কিন্তু বাবাকে সেভাবে দেখেননি এবং চিনতেও পারেন না। এমনি এক সময় বড় বোন শেখ হাসিনাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন, ‘হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?’
শেখ কামাল ১১২-সেগুনবাগিচায় অবস্থিত ডন্স কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ১৯৫৬ সালে কেজি-১ শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেই স্কুলে কেজি-১ থেকে কেজি-৩ এবং স্ট্যান্ডার্ড-১ থেকে স্ট্যান্ডার্ড-৩ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়নের পর ডাবল প্রোমোশন নিয়ে ১৯৬১ সালে বিএএফ শাহীন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় তিনি শাহীন স্কুলের তিতুমীর হাউজ-এর ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেখানে তার শিষ্টাচার এবং উদার-নৈতিক-মানবিক গুণাবলীর জন্য হাউজের প্রায় সকলেই তার সমর্থক বনে গিয়েছিলেন। শেখ মুজিব জেলের বাইরে থাকলে তিনি নিজেই শেখ কামালকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। অন্যথায় কামাল স্কুটারে করে নিজেই স্কুলে চলে যেতেন। তিনি এই স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাশ করেন এবং পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৬৯ সালে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৪ সালে স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষায় অসুস্থাবস্থায় অবতীর্ণ হয়েও তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শেখ কামাল প্রত্যেকটা ক্লাস এমনকি টিউটোরিয়াল ক্লাসেও অংশগ্রহণ করতেন। তার হাতের লেখাও ছিল অত্যন্ত সুন্দর। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং ১৪ই আগস্ট কোর্স সমাপনী মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। শাহাদত বরণের পর ১৯৭৬ সালের ২৯শে জানুয়ারি স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল বেড়িয়েছিল। এ পরীক্ষাতেও তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন, তবে তার শিক্ষকগণের অনেকেই মনে করেন, কামালকে তার প্রাপ্য নম্বর থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, তা না হলে তিনি আরও ভালো ফলাফল করতেন।
৭ই মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের সকলকে নিয়ে খাবার খেতে খেতে বলেছিলেন, ‘আমার যা বলার ছিলো আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোন মুহুর্তে গ্রেফতার বা হত্যা করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দু’বেলা আমার সঙ্গে একত্রে খাবে।’ একই নিয়মে ২৫শে মার্চ দুপুর পর্যন্ত চলে। ২৫শে মার্চ অপরাহ্ন ৯টার দিকে রাতের খাবার শেষে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন শেখ কামাল। পরদিন ভোরে ৩২ নম্বরের বাড়িতে আবার ফিরে এসে মা এবং ভাইদের সঙ্গে তিনি দেখা করেন। ২৬শে মার্চ পুনরায় পাকিস্তানি সেনারা ৩২ নম্বরের বাসা আক্রমণ করে। তখন পাশের বাসার ডা: সামাদ সাহেব তার বড় ছেলেকে পাঠিয়ে বেগম মুজিব, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেলকে তার বাসায় নিয়ে যান। শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য বেড়িয়ে পড়েন। বাসা ছাড়ার পর তিনি কিছুদিন ধানমন্ডিতে একটি সুইস পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করেন। পরে ছদ্মবেশ ধারণ করে অনেক কষ্টে এপ্রিলের মাঝামাঝি গোপালগঞ্জে পৌঁছান। শেখ কামাল তার ফুফাতো ভাই ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরীসহ কাশিয়ানির ব্যাসপুরে আশ্রয় নেন এবং নিরাপত্তার কারণে কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করেন। পরে ওড়াকান্দির ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে শেখ কামাল এবং ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরী ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার চাপতা বাজার থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে রাজাকারদের চোখ এড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ইছামতি নদী পাড়ি দিয়ে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার দেবহাটা-হাসনাবাদ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পৌঁছান।
পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছানোর পর শেখ কামালকে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে দেখা করে ঢাকার পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। মিসেস গান্ধী শেখ কামালকে দিল্লীতে নিরাপদে থাকতে বলেন এবং লেখাপড়া শুরু করার কথা বলেন। কিন্তু শেখ কামাল মিসেস গান্ধীকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন যে, দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে তিনি যুদ্ধে যোগদান করতে চান। মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হতে পারে এমন আশংকা থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিফৌজকে সংগঠিত করে মুক্তিবাহিনী গঠন করে এবং এ বাহিনীকে বর্ধিত করে। মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর থেকে অত্যন্ত চৌকস এবং মেধাবী তরুণ, যুবক ও পেশাজীবীদের মধ্য থেকে ৬১ জনকে জেন্টলম্যান ক্যাডেট (জিসিএস) হিসেবে নির্বাচিত করে ভারতের অফিসার ট্রেনিং উইংয়ে (ওটিডব্লিউ) ন্যস্ত করে বর্তমান উত্তরাখন্ড প্রদেশের দেরাদুনে হিমালয় পর্বতের সন্নিকটে মূর্তি ক্যাম্পে প্রেরণ করে।
শেখ কামাল ছিলেন সেই ৬১ জন সৌভাগ্যবান তরুণদের একজন, যারা ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট ওয়ার কোর্স’ সমাপন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। প্রথম যুদ্ধ প্রশিক্ষণ কোর্সটি ’৭১ সালের জুনের শেষে শুরু হয় এবং একই বছর ৯ই অক্টোবর অংশগ্রহণকারী সদস্যদের ‘পাসিং আউট’ হয়। অত্যন্ত বৈরী পরিবেশে ১৬ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কোর্সটি চলমান অবস্থায় শেখ কামাল কখনোই অসুস্থবোধ করেননি। তার শারীরিক ফিটনেস এবং পারফর্মেন্স ছিল সবার উপরে। তিনি সেই প্রশিক্ষণ কোর্সে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর দু’ভাই ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল যুদ্ধফ্রন্ট থেকে ধানমন্ডির ১৮নং সড়কের বাসায় ফিরে আসেন। তখন তাদের পরনে ছিল সামরিক পোশাক। প্রায় সাড়ে ন’মাস পরে পরিবারের সবাই একত্রিত হওয়ার খুশিতে তখন সকলের চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে ওঠে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর সকল মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ২ বছরের সিনিয়রিটি দেয়ার কারণে শেখ কামালকেও ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। কিছুদিন সেনাবাহিনীতে চাকুরি করার পর তিনি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। শেখ কামাল তার জীবদ্দশায় মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেননি।
শেখ কামাল ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠক। খেলাধুলায় রয়েছে তার সবচেয়ে বড় আবদান। টুঙ্গীপাড়া থেকে ঢাকায় আসার পর শৈশবে সেগুনবাগিচা নর্থ-সাউথ রোড ও বিজয় নগরের মাঝের মাঠটিতে খেলাধুলা করতেন। তিনি ১৯৬৭-৬৮ এর দিকে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ায় একটি মাঠে খেলতেন। তিনি ধানমন্ডি মাঠেও খেলাধুলা করতেন। অত্র এলাকায় তখন শিশু ও তরুণদের জন্য কোন ক্লাব ছিলনা। এক্ষেত্রে তিনিই প্রথম উদ্যোগী হন। প্রথমে তিনি আবাহনী সমাজ-কল্যাণ সংস্থা গড়ে তোলেন, পরে মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে ১৯৭২ সালে ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’ প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা উত্তর পরিস্থিতিতে তরুণ সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতেই তিনি এই মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি জার্মানির মিউনিখে ‘সামার অলিম্পিক’ দেখতে যান। ১৯৭৩ সালে জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত ১০ম বিশ্ব যুব সম্মেলনে যোগদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ থেকে ৭৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে গিয়েছিলেন।
শুধু ফুটবল নয়, আবাহনী ক্রীড়াচক্রের অধীন তিনি হকি, ক্রিকেট এবং টেবিল টেনিস দলও গঠন করেন। ক্রীড়াঙ্গণের সর্বক্ষেত্রেই তার দল জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। আন্তঃবিশ্ব বিদ্যালয় বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় তার দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এক সময় খেলোয়াড়দেরকে আধুনিক পোশাক এবং ক্রীড়াসামগ্রী সরবরাহ করাই তার নেশায় পরিণত হয়। তিনি খেলাধুলায় উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য স্বাধীন দেশে প্রথম বিদেশী কোচ ব্রিটিশ নাগরিক মি. বিল হার্টকে নিয়োগ করেন। তার গৃহীত নানা উদ্যোগের ফলে এই ক্লাবের খ্যাতি সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তিনি আবাহনী ক্রীড়াচক্রের জেলাশাখা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি খেলাধুলার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। খেলোয়াড়দের স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি তিনি তাদের জন্য অবসর ভাতা প্রদানেরও উদ্যোগ গ্রহণ করেন। খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট হতে ১০ লাখ টাকার অনুদান নিয়ে ‘খেলোয়াড় কল্যাণ তহবিল’ গঠন করেন।

রাজনৈতিক কর্মকান্ড
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শেখ কামালের নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ৬-দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১১-দফা এবং অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ’৬৬-এর ৬-দফা আন্দোলনের সময় যখন বঙ্গবন্ধুকে খান সেনাদের হাতে গ্রেফতার হতে হয়েছিল, তখন জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর গোপন নির্দেশনা অনুযায়ী শেখ কামাল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৎকালীন ঢাকা শহরের ৪৪টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছিলেন। শেখ কামালের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কর্মীরা ১৯৬৮ সালে ঢাকা কলেজে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সম্মেলনের প্রধান অতিথি তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে কালো পতাকা প্রদর্শন করেছিল। ১৯৬৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকা কলেজের নর্থ হোস্টেলের সামনে একটি শহিদ মিনার প্রস্তুত করেন। সেখানে সকল ছাত্ররা মিলে খুব সকালে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন এবং প্রভাত ফেরিতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০-এর অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শেখ কামাল গোপন অস্ত্র-প্রশিক্ষণের নেতৃত্ব দিতেন। শেখ কামাল তার বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৯৭০-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সূত্রাপুর-কোতোয়ালিতে আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রতিনিয়তই নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। যার ফলে মুসলিম লীগের খাজা খায়রুদ্দিনকে হারিয়ে বঙ্গবন্ধু বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। শেখ কামাল ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য। সদ্য স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অস্থিতিশীল করবার উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়। সে সময় শেখ কামালের সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার কারণে তিনি ছাত্রলীগকে পুনর্গঠিত করতে সমর্থ হন এবং সংগঠনকে আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী করেন।

নিপুণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
শেখ কামাল ছিলেন সংস্কৃতি জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এ ক্ষেত্রে তার ছিল ত্রিমুখী প্রতিভা। তিনি একাধারে অভিনয় করতেন, গান গাইতেন এবং সেতার বাজাতেন। শেখ কামাল ছায়নটে সেতার শিখতেন, তার বড় বোন শেখ হাসিনা বেহালা শিখতেন, মেজ ভাই শেখ জামাল গিটার এবং ছোট বোন শেখ রেহানা নাচ ও গান শিখতেন। অভিনয়ের ক্ষেত্রে শেখ কামালের প্রতিভা ছিল অনন্য- এক কথায় পেশাদার অভিনেতাদের মত। তার সৃষ্টিশীল আঙ্গিক অভিনয়, ভরাট কণ্ঠস্বর এবং সেই সঙ্গে যেকোন স্বরের দোতনা সৃষ্টিতে পারদর্শীতা তাকে অপ্রতিদ্বন্দী করে তুলেছিল। তিনি নাট্যচক্রে নিয়মিত রিহার্সেল করতেন এবং সেখানে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করে সংস্কৃতিপ্রেমীদের মাঝে ব্যাপক সাঁড়া ফেলেছিলেন। তার অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ম. হামিদের নির্দেশনায় ম্যাক্সিম গোর্কির ‘দি ডেভিল’ অবলম্বনে ‘দানব’, বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’, আল মনসুরের লেখা ‘রোলার এবং নিহত এলএমজি’ এবং ‘আমি মন্ত্রী হব’ অন্যতম। তিনি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন। শেখ কামাল মেয়েদের খুবই সম্মান করতেন, একই সঙ্গে তিনি মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্নে ছিলেন আপোসহীন। রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত রিহার্সেল করার পর কখনো গাড়িতে করে আবার কখনো পায়ে হেঁটেই মেয়েদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে তবে নিজে বাড়ি ফিতেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ থেকে ১৯৭২ সালের এপ্রিলে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সংস্কৃতি বিনিময় মেলায় অংশগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি শহিদ মুনীর চৌধুরী অনুদিত জর্জ বার্নাড শ-এর লেখা ‘ণড়ঁ ঘবাবৎ ঈধহ ঞবষষ’ অবলম্বনে ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’ নাটকের মুখ্য চরিত্রেও অভিনয় করেন।
আন্তঃকলেজ সেতার প্রতিযোগিতায় পুরো পাকিস্তানে তিনি রানার্স-আপ এবং আন্তঃকলেজ সংগীত প্রতিযোগিতায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের পূর্বে তিনি ‘মৃদঙ্গ’ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ১৭ই জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি নাট্যচক্রের সহ-সভাপতি ছিলেন। সংগীত ক্ষেত্রে তিনি ‘ট্যালেন্ট শো’-এর প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘র‌্যাগ-ডে’তে রং মেখে উদ্যাপন করার পরিবর্তে র‌্যালি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ছবি প্রদর্শনী ইত্যাদি কর্মকান্ডের মাধ্যমে পালন করার প্রস্তাব করেছিলেন।

যাপিত জীবন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ব্যবহৃত টয়োটা-৬৮ মডেলের লাল গাড়ীটাই ছিল শেখ কামালের একমাত্র সৌখিন সম্পত্তি। তার অর্থ-বিত্ত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি কোন আকর্ষণ ছিলনা। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়কের স্ত্রী হবার পরও বেগম মুজিবের যেমন পোশাক পাল্টায়নি, গায়ে উঠেনি বিদেশী শিফন। ঠিক একইভাবে দেখা গেছে তাঁদের আদরের প্রথম সন্তান শেখ হাসিনাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যেতেন সাধারণ সূতি শাড়ি পরে। শেখ কামালকেও কখনো ইন করে শার্ট পড়ে ক্যাম্পাসে আসতে দেখা যায়নি। তিনি ওপেন ফুলহাতা টি-শার্ট এবং প্যান্ট পড়তেন, আর পায়ে সাধারণ স্যান্ডেল বা স্যান্ডেল-স্যু। কোনদিন তাকে স্যুট পরতে দেখা যায়নি। তিনি ছাত্রলীগ করতেন; কিন্তু কোনদিন নেতৃত্বের আসনে বসেননি।
শেখ কামাল ছিলেন দারুণ স্মার্ট, বিনয়ী এবং আদব-কায়দা সম্পন্ন তরুণ। বস্তুত: ‘ঝরসঢ়ষব খরারহম, ঐরময ঞযরহশরহম’- মূলমন্ত্রটি বঙ্গবন্ধু পরিবারে চর্চা হতো বলেই তাদের মধ্যে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবর্তে সব সময়ই দেশ ও জাতির স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রতিক্রিয়াশীল প্রতি-বিপ্লবীরা যেভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের কুৎসা রটিয়েছিল; ঠিক একইভাবে শেখ কামাল সম্পর্কেও যা-তা বানোয়াট কাহিনী প্রচার করেছিল। তৎকালীন জাসদের মুখপাত্র ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকা কিংবা ভাসানী ন্যাপের ‘হককথা’ এক্ষেত্রে জঘন্য ভূমিকা পালন করেছিল। ’৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনাব আবুল ফজল, যিনি সে সময়ের এক অনুষ্ঠানে শেখ কামাল-এর প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘শেখ কামাল ছিল আদর্শবান মানুষ। তাঁর কোন অহংকার ছিল না। অত্যন্ত বিনয়ী ও ভদ্র ছিল।’ এই মন্তব্যের কয়েক দিনের মধ্যেই জনাব আবুল ফজল জিয়ার উপদেষ্টা পদ থেকে অপসারিত হয়েছিলেন।