Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

জাতির জনকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের প্রকৃতির প্রতিটি কনায় কনায় মিশে আছেন, থাকবেন যতদিন এ বিশ্বব্রক্ষান্ড অস্তিত্ব নিয়ে থাকবে। টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মেছিলেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে সপরিবারের শাহাদত বরণ করেন তিনি। টুঙ্গীপাড়ায় তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধু সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স। আগস্ট, আমাদের জাতীয় জীবনে শোকের মাস। এ শোকের মাসে শাহ সিমেন্ট ‘নির্মাণে আমি’তে বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সটি নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক।
কোনো উপমাই তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়, কোনো বিশেষনই বিশেষায়িত করে তাঁকে চিহ্নিত করা তা দুঃসাধ্য। তবুও আমরা চেষ্টা করি প্রাণের আবেগে, চেষ্টা করি হৃদয়ের তাড়নায়, সেই তাড়না একজন বাঙালি হিসেবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে যাকে আমরা প্রাণ ভরে ডাকি, তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাকে ছাড়া প্রিয় মার্তৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত কিনা সন্দেহ। তার পুরো জীবনই ঘটনা বহুল। বঙ্গবন্ধুকে জানা মানেই যেন বাংলাদেশের ইতিহাসের পুরোটাই জেনে ফেলা।
আজ থেকে ১০০ বছর পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন টুঙ্গিপাড়ায় ছোট্ট গ্রামটিতে জন্মগ্রহণ করেন তখন এই স্থানটি ছিল ব্রিটিশ ভারতের অর্ন্তভূক্ত। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ফরিদপুর জেলার অর্ন্তভূক্ত হয় টুঙ্গিপাড়া। তবে স্থানটি ছিল গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভূক্ত। ১৯৭৪ সালে টুঙ্গিপাড়া প্রথম থানার মধ্যে স্থান পায়। সেদিনের সেই ছোট্ট গ্রামটি আজ হয়ে উঠেছে শুধু মাত্র দেশেরই নয়, একটি আন্তর্জাতিক দর্শনীয় স্থান।
রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে মাওয়া ঘাট হয়ে টুঙ্গিপাড়া পৌঁছাতে সর্বোচ্চ সাড়ে চার ঘণ্টা থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। সড়ক পথের দূরত্ব ১৮২ কিলোমিটার। তবে এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় স্বপ্নের পদ্মাসেতু নির্মাণ সমাপ্ত হলে রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে টুঙ্গিপাড়া যেতে তিন ঘণ্টা থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। এর কারণ এই পথেই নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা মাওয়া এক্সপ্রেস ওয়ে।
নারিকেল-সুপারির বনবীথির ছায়া ঘেরা মধুমতি নদীর তীর ঘেঁষা সবুজ-শ্যামল গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে এই টুঙ্গিপাড়া নির্জন নিরিবিলি উপজেলা শহর এখন। এখানে চারদিকে গাছ গাছালি ভরা বিল। যেন ছবির মতো সাজানো গোছানো এই টুঙ্গিপাড়া।
এখানকার শ্যামল ছায়াতেই দূরুত্বপনায় কেটে গেছে বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা। মধুমতির জলে গায়ের ছেলেদের সঙ্গে সাঁতার কাটা, দৌড়-ঝাঁপ, দলবেঁধে হাডুডু, ফুটবল খেলায় তিনি ছিলেন দশ্যি বালকদের নেতা। তখন কে জানতো এই দশ্যি বালকদের নেতা হবেন বাঙালির জাতির পিতা। কিন্তু বাস্তবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতাই হয়েছেন তিনি। শেখ মুজিব বাঙালির জাতির পিতা হলেও নিজ গ্রামের কাছে তিনি সব সময়ই আদরের খোকা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু একজন সাধারন মানুষের মতো জীবন যাপন করতেন। ঢাকা থেকে যখন গ্রামের বাড়িতে যেতেন, মিশে যেতেন গ্রামের প্রকৃতি ও গ্রামীন খেলাধুলার সাথে। বঙ্গবন্ধু বেড়ে ওঠেন টুঙ্গিপাড়ার গ্রামীন জীবন প্রবাহের মধ্যে। বাড়ির পেছনেই বয়ে যাওয়া খালের পাড়ে হিজল গাছের ছায়াতলে তিনি গ্রামের লোকজনদের সাথে বসে আড্ডা দিতেন। তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতেন।
দাঁড়াও পথিক বর যথার্থ বাঙালি
যদি তুমি হও
ক্ষনিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধিস্থলে…
এটি কবি সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাহমুদের ৩৩ লাইনের কবিতার অংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সের এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে পাথরের খোদাই করা এই কবিতাটি। প্রশস্ত পথের দুই পাশে রয়েছে ফুলের বাগান ও কৃত্রিম পাহাড়। এসবের মাঝেই পাঠাগার ও জাদুঘর। পথ ধরে একটু সামনে এগোলেই বঙ্গবন্ধুর সমাধি। এ সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গিপাড়ায়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ সমাধিসৌধ এর নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের তত্ত্বাবধানে সেনা বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সহযোগিতায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এ সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণ করে। ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা এবং পরামর্শে এই সমাধি সৌধের ডিজাইন করেন নকশা প্রতিষ্ঠান ‘ভিত্তি’র প্রখ্যাত স্থপতি এহসান খান, স্থপতি ইকবাল হাবিব ও ইসতিয়াক জহির তিতাস। এটি ২০০১ সালে ‘আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদীর পাড়ে ৩৮ দশমিক ৩০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স।
লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো মার্বেল পাথর দিয়ে গ্রিক স্থাপত্যশিল্পের আদলে নির্মিত সৌধের কারুকার্যে ফুটে উঠেছে বেদনার ছায়া। কমপ্লেক্সের সামনের দু পাশের উদ্যান পেরোনোর পরই বঙ্গবন্ধুর কবর। পাশেই রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের কবর। এই তিন কবর নিয়ে গড়ে উঠেছে গোলাকার গম্বুজ বিশিষ্ট মূল সমাধি সৌধ। সমাধি সৌধের ওপরের দেয়ালে জাফরি কাটা। সব সময় আলো ছায়ার মায়াবী পরিবেশ বিরাজ করে সেখানে। ওপরে থাকা কারুকাজ করা কাচের ভেতর দিয়েও আলো ছড়িয়ে পড়ে সমাধিতে। চারদিকে কালো, মাঝখানে ধপধপে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে পরম যত্নে ঢাকা বঙ্গবন্ধুর কবর। এই কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি পাঠাগার ও জাদুঘর। স্থাপত্য নকশা অনুযায়ী জাদুঘরটি দুই ভাগে বিভক্ত- কোর্ট স্পিরিচুয়াল ও পাবলিক কোর্ট।
সমাধি সৌধ এর পাশেই বঙ্গবন্ধুর পৈত্বিক বাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে আছে তাঁর বেড়ে ওঠার নানান স্মৃতি দিয়ে। সময়ের বিবর্তনে বদলেছে বাড়ির রং। কিন্তু বদলায়নি বাড়িটির আদল। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে জাতির পিতার ব্যবহারের নানান সামগ্রী। দেয়ালে থাকা ছবি গুলো আপনাকে নিয়ে যাবে ১৯৭৫ সালের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক আর রাজনৈতিক জীবনের নানা ঘটনায়। বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ এর পাশেই বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পুরুষ যারা আছেন তাদের বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে মুঘল আমলে। এই বাড়িটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে টুঙ্গি পাড়ায় শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেছিলেন শেখ বোরহান উদ্দিন আহমেদ। ১৮০০ শতকে নির্মিত এই বাড়িটির আদল ঠিক রেখে দু দফায় বাড়িটি সংস্কার করা হয়। এই আদি বাড়িটির ঠিক উল্টো পাশে রয়েছে শান বাঁধানো পুকুর। পুকুরের পাশে রয়েছে খেলার মাঠ। সেখানে খেলতেন আমাদের বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সের মধ্য রয়েছে পাঠাগার, গবেষণা কেন্দ্র, প্রদর্শনী কেন্দ্র, মসজিদ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া, উম্মুক্তমঞ্চ, বকুল তলা চত্বর, স্যুভেনির কর্ণার, মনোরম ফুলের বাগান ও কৃত্রিম পাহাড়। বঙ্গবন্ধু সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা জাদুঘরের নীচতলায় ডান দিকে রয়েছে পাঠাগার। পাঠাগারে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বই সহ প্রায় আট হাজার বই রয়েছে। রয়েছে গবেষণা কেন্দ্র, প্রদর্শনী কেন্দ্র, উম্মুক্ত মঞ্চ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া, বকুল তলা চত্বর ও স্যুভেনির কর্নার। সিঁড়ি দিয়ে জাদুঘরের দোতলায় উঠতেই বা দিকে চোখে পড়বে বিশ্ব নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর সৌজন্য সাক্ষাৎকারের দূর্লভ ছবি।
একটু সামনে এগোলেই প্রথমেই নজরে পড়বে ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেয়া এতিহাসিক ভাষণের সেই স্মরণীয় ছবি। প্রদর্শনী কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী, জীবনের নানা পর্যায়ে আলোকচিত্র ছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা শিল্পকর্ম। এ ছাড়াও মুক্তি সংগ্রামের নানা পর্যায়ে দেশ ও বিদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র। যে কফিনে করে ১৬ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর মরদেহ আনা হয়েছিল টুঙ্গিপাড়ায় সেটিও আছে এই জাদুঘরে। ২০০১ সালে এই জাদুঘর উম্মুক্ত হওয়ার পর থেকেই এখানে এই কফিনটি রাখা হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত এই কফিনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল বাড়িতে। সেটিও সংরক্ষণ করা হয়েছে সযত্নে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে আবেগে আপ্লুত হন। শ্রদ্ধা জানান বঙ্গবন্ধুকে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পযর্ন্ত সমাধিসৌধ খোলা থাকে। পাঠাগার খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পযন্ত।
বঙ্গবন্ধু সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স এর পাশেই টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে শেখ রাসেল শিশু পার্ক। সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স শুধু নয় এর আশপাশের এলাকায় আরও অনেক কিছুই দেখার রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদি পৈতৃক বাড়ি, ছেলে বেলার খেলার মাঠ, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বালিশা আম গাছ, শেখ বাড়ি জামে মসজিদ ইত্যাদি। আছে হিজল তলা ঘাট, যেখানে বঙ্গবন্ধু ছোটবেলায় গোসল করতেন। দেখা মিলবে শেখ পরিবারের এতিহ্যবাহী একটি বড় ও একটি ছোট আকারের পুকুরের।
আগস্ট, আমাদের জাতীয় জীবনে শোকের মাস। ১৯৭৫ সালের এই মাসেই আমরা হারিয়েছি মহান স্বাধীনতার স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে নির্মম, নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়। বিদেশে থাকায় ভাগ্য গুণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর আদরের দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ’৭১ এর পরাজিত শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নস্যাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সেটা পারেনি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা সবার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় স্বগৌরবে এগিয়ে যাচ্ছে। শোকের এই মাসে জাতির জনকের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।