Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

রাণী ও রাজাদের নিয়ে বিব্রত শোবিজ অঙ্গন

সোহেল হায়দার

তিনি একজন সাধারন গৃহিনী। সংসার সামলাতেই তার দিন কাটে। যে টুকু অবসর পান সিনেমা দেখেন হয় কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে না হয় ইউটিউবে। সিনেমা হলে বসে বড় পর্দায় সিনেমা দেখাই তার অন্যতম আনন্দ। কিন্তু কবে, কোন দিন সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছেন সেটা এখন আর মনে নেই। তাছাড়া সিনেমা হলই তো এখন আর নাই। সব জায়গায় সিনেমা হল ভেঙ্গে মার্কেট হচ্ছে। অথচ কারও কোনো রিয়্যাকশন নাই। যেন এই দেশে সিনেমার কোনো দরকার নাই। আনন্দ আলোর ঠিকানায় তিনি একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে সম্পাদক বরাবরে একটি প্রশ্ন তুলে ধরেছেন।
নাটক, সিনেমা, মডেলিং যারা করেন তারা তো আমাদের কাছে আইডল। একজন অভিনেতা অথবা অভিনেত্রী ভালো অভিনয়ের জন্য বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছেন, বড় কোনো পুরস্কার পেয়েছেন, তাকে নিয়ে মিডিয়ায় হই চই শুরু হয়েছে… এই ধরনের আনন্দ সংবাদ পেতে চাই আমি। আমার দেশের একজন মডেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। তাকে নিয়ে মিডিয়ার মানুষ দারুণ ব্যস্ত। এমন পরিবেশই তো আমার প্রত্যাশা। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে কি দেখছি? নায়িকার বাসায় মাদকের হাট দেখা যাচ্ছে। তথাকথিত মডেল পরিচয় ধারীরা নানা ধরনের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। অথচ দোষ হচ্ছে শিল্পীদের। সব চেয়ে আশঙ্কাজনক হল যারাই গ্রেফতার হচ্ছেন তারাই মেয়ে অর্থাৎ নারী। তাদেরকে ‘রাতের রাণী’ বলা হচ্ছে। এখানেই আমার প্রশ্ন এক হাতে কী তালি বাজে? রাতের রাণীদের কথা বলা হচ্ছে। রানী থাকলে তো রাজাও থাকার কথা! রাজাদের কথা কেন বলা হচ্ছে না? নাকি রাজাদের কথা বলতে মানা? আশাকরি আনন্দ আলো এ নিয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে…
ভদ্রমহিলা যথার্থ প্রশ্ন করেছেন। দেশের শিল্পী সমাজ অর্থাৎ বিভিন্ন স্তরের মেধাবী মানুষদের সাফল্য ও দৃষ্টান্তের কথাই আনন্দ আলো প্রকাশ করে। তারকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ভালো কাজের প্রশংসা করার জন্যই আনন্দ আলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেখানে কোনো জনপ্রিয় তারকার অন্ধকার জীবন নিয়ে যখন হইচই শুরু হয় তখনই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হই আমরা। পরীমনি, একজন জনপ্রিয় চিত্র নায়িকা। রাজধানীর একটি ক্লাবে গভীর রাতে তিনি হাজির হয়েছিলেন। এরপর তিনি অভিযোগ তুললেন ওই ক্লাবের একজন সদস্য ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে। গভীর রাতে নিজের বাসায় পরিচিত সাংবাদিকদের ডেকে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন আহমেদ তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে এবং তার প্রাণ নাশেরও চেষ্টা করেছে। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি জানালেন, “আমি যদি মারা যাই তাহলে ধরে নিবেন আমার মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে।” পরীমনির এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাৎক্ষনিকভাবে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন আহমেদকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কিন্তু পরের দিনই পরীমনিকে নিয়ে মিডিয়া নতুন বিব্রতকর সচিত্র সংবাদ প্রকাশ হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে রাজধানীর একটি ক্লাবে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে ঢুকেছেন পরীমনি। ক্লাবে ঢুকে মদ চেয়েছিলেন। মদ না পেয়ে ক্লাবে ভাঙ্গচূর করেছেন। দেশের মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে পরীমনির এই আচরণ ব্যাপক আলোচিত হয়ে ওঠে। ফলে পরীমনি সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারনা শক্তিশালী হতে শুরু করে। এর মধ্যে ব্যসায়ী নাসির উদ্দিন আহমেদ জেল থেকে ছাড়া পান। পরীমনি নাকি তার সাথে দেখা করে সমঝোতার চেষ্টা চালান- এমন খবরও প্রকাশ ও প্রচার হয়। পরিস্থিতি দেখে ধারনা করা হচ্ছিল ‘ঝামেলা’ বোধকরি মিটে গেল। কিন্তু হঠাৎ করেই পিয়াসা ও মৌ নামে তথাকথিত মডেল পরিচয় ধারী দু’জন নারী গ্রেফতার হওয়ার পর আমাদের শোবিজ নিয়ে নেতিবাচক ধারনা ছড়াতে শুরু করে। পিয়াসা ও মৌয়ের ব্যাপারে অভিযোগ তোলা হয়Ñ তারা রাতের রানী। অভিজাত হোটেলে জমজমাট পার্টির আয়োজন করে উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানান। পার্টিতে অতিথিরা এলে সুকৌশলে আমন্ত্রিত তাদেরকে যৌনতার ফাঁদে ফেরে তার ভিডিও করেন এবং পরিবর্তিতে এই ভিডিও পাঠিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন। অস্ত্র ব্যবসার সাথেও তাদের অনেকে নাকি জড়িত। পিয়াসা ও মৌকে গ্রেফতার করার পর থেকে উড়ো খবর বাতাসে আসছিল। তা হলো নায়িকা পরীমনিও গ্রেফতার হতে পারেন। কারণ পিয়াসা ও মৌয়ের কর্মকান্ডের সঙ্গে নাকি পরীমনিরও যোগসূত্র আছে।
হঠাৎ একদিন দুপুরে নায়িকা পরীমনি ফেসবুক লাইভ-এ হাজির হন। তার বাসায় কে বা কারা হামলা করেছে বলে খবর ছড়িয়ে দিয়ে তারা পাশে দাঁড়ানোর জন্য ভক্তদের প্রতি অনুরোধ জানান। মুহূর্তে পরীমনির বনানীর বাসার সামনে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়। কিন্তু তারা পরীমনিকে সহায়তা করার জন্য নয় ঘটনা দেখার জন্য ভীড় করে। নাটকীয় এক ঘটনার মাধ্যমে পরীমনিকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। পরীর বাসায় অবৈধ মদ ও নেশা দ্রব্য পাওয়া যায়। এই নিয়ে চলছে নানা মুখ রোচক আলোচনা। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি থেকে পলীমনিকে আপাতত নিস্ক্রীয় রাখা হয়েছে। অর্থাৎ তার সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারন সম্পাদক জায়েদ খান অভিন্ন সুরে বলেছেন, কোনো শিল্পীর অনৈতিক কর্মকান্ডের দায়ভার শিল্পী সমিতি বহন করবে না। জায়েদ খান প্রচার মাধ্যমে বলেছেন, পরীমনি কখনই শিল্পী সমিতিকে গুরুত্ব দেয়নি। কাজেই আমরা তার ব্যাপারে আর কোনো আগ্রহ দেখাতে চাই না।
শুধু শিল্প সমিতি নয় গোটা চলচ্চিত্র পরিবার পরীমনির ব্যাপারে নিশ্চুপ। দায়িত্ববানরা কেউ কোনো কথা বলতে নারাজ। তবে পরীমনি সহ অন্যান্যদের গ্রেফতারের ঘটনায় আমাদের শোবিজ অঙ্গনে দারুণ একটা নেতিবাচক ধারনার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নারী প্রতিনিধিদের ব্যাপারে অনেক অশোভন মন্তব্য ও তথ্য ছড়াচ্ছে কিছু অনলাইন মিডিয়া। শোবিজ মানেই একটা অন্ধকার জগৎ এমনটাই প্রচার ও প্রকাশে তৎপর হয়ে উঠেছে একটি মহল। তবে আশার কথা বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী, নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ সহ আরও অনেকে চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজ নিজ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আনন্দ আলোর পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল।
চিত্রনায়িকা পরীমণির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি আবেদন জানিয়েছেন প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। সোমবার আবেদনটি তিনি গণমাধ্যমে পাঠান। আবেদনে লন্ডন প্রবাসী প্রবীণ এই সাংবাদিক লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এটি তার একার আবেদন নয়। দেশে প্রশাসন, একটি বিত্তশালী গোষ্ঠী এবং মিডিয়া গোষ্ঠী মিলে ২৮ বছরের এক তরুণীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার যে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে সে সম্পর্কে সচেতন নাগরিক সমাজের আবেদন।
তিনি লিখেছেন, “পরীমণিকে গ্রেপ্তারের জন্য দু’চার জন র‌্যাব কিংবা পুলিশ সদস্য গেলেই হতো, সেখানে যে আয়োজন করা হয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল কোনো ভয়ংকর ডাকাতকে গ্রেপ্তারের জন্য এই যুদ্ধযাত্রা। গ্রেপ্তারের পর থেকেই পরীমণির বিরুদ্ধে একটার পর একটা স্ক্যান্ডাল ছড়ানো হচ্ছে। এটা বোঝাই যায়, কোনো একটি মহল থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এগুলো করা হচ্ছে। অর্থাৎ বিচারের আগেই বিচার। চয়নিকা চৌধুরীর মতো একজন বিখ্যাত নাট্যকারকে অহেতুক রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে তার চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলো ক্ষমতার বাড়াবাড়ি। এগুলো চলতে দিলে দেশের নাগরিকদের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে।’”
আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, বোট ক্লাবের ঘটনার পরে আসামিরা যে সহজেই জামিন পেল তার রহস্য কী? এই শক্তিশালী মহলটি প্রশাসনের একাংশকে বশ করে যে এই ঘটনাগুলো সাজিয়েছে তা বুঝতে কি কষ্ট হওয়ার কথা? তারপর মিডিয়ায় প্রচার। এই প্রচারগুলো যে সত্য নয় তা সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিনের বিবৃতিতে জানা গেছে। সাড়ে তিন কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে পরীমণির বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালানো হয়েছে আরেফিন সাহেবের বিবৃতিতে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
পরীমণির ব্যক্তিগত সম্পর্ক ঘিরে প্রচারণার কথা উল্লেখ করে এই প্রথিতযশা সাংবাদিক লিখেছেন, পরীমণি নায়িকা। তার নানাবিধ পুরুষের সঙ্গেই সম্পর্ক থাকতে পারে। সেটা কি অপরাধ? সবিনয় জিজ্ঞাসা, আদালতে বিচার হওয়ার আগে দেশের চলচ্চিত্র জগতের সম্ভাবনাময় তরুণীর জীবন যেভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হলো তার দায়িত্ব কে নেবে? আদালতের বিচারে পরীমণি যদি দোষী সাব্যস্ত হয় এবং শাস্তি পায় তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু একজন তরুণীকে যেভাবে আটক করে হেনস্থা করা হচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে অপ্রমাণিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তা শুধু নারী সমাজের অপমান নয়, মানবতার অপমান। আমাদের নাগরিক স্বাধীনতার ওপর একটি ভয়ংকর থাবা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়ে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলেই নারীদের ক্ষমতায়ন শুরু হয়েছে। সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সবিনয় আবেদন, পরীমনির ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ করুন। তাকে বিচারের হাত থেকে রক্ষা করতে বলি না। তাকে হায়েনা গোষ্ঠীর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। পরীমণির সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তা যে দেশের আর একজন নাগরিকের ওপর করা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কাছে আবেদন জানাই, তারা পরীমণির ওপর এই হেনস্থার প্রতিবাদ করুন। দয়া করে চুপ থাকবেন না। পরীমনির ওপর অত্যাচারের নিন্দা জানান। মিডিয়ার কাছে অনুরোধ, তারা যেন অত্যাচারিতের পক্ষে দাঁড়ান। অত্যাচারী গোষ্ঠীর পক্ষে না যান।
বিনোদন জগতের চলমান অস্থির ঘটনার প্রেক্ষিতে নাট্যজন মামুনুর রশীদ ও মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল দেশের একটি শীর্ষ দৈনিক পত্রিকায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
মামুনুর রশীদ বলেছেন, বিনোদন অঙ্গনের কেউ আটক হওয়া এটাই প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার এমন প্রসঙ্গ সামনে এসেছে। পত্রপত্রিকায় অনেক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় লাইভে সেসব দেখানো হয়েছে। মানুষের কৌতূহল মেটাতে গিয়ে সেসব ঘটনার অনেক ধরনের ডালপালা গজিয়েছে।
মডেল তিন্নি হত্যার ঘটনায় অভিনয়শিল্পীদের অনেককেই নিয়মিত পুলিশের বিশেষ শাখায় ধরনা দিতে হতো। তখন ছিল বিএনপির সময়। শেষ পর্যন্ত উচ্চ মহলের হস্তক্ষেপে সেটি বন্ধ হয়েছিল। এরপরও দু-একজন নামকরা অভিনেত্রীকে নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আমরা বলেছি, এগুলোর ট্রায়াল হোক, মিডিয়া ট্রায়াল যেন না হয়। অতীতে যাঁরা আটক হয়েছিলেন, পরে বিচারে তাঁদের কিছু বের হয়ে আসেনি।
সম্প্রতি যা ঘটেছে, তাতে অনেক বিষয় দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু যেটা দৃশ্যমান হয়নি, সেসব পরিণত হয়েছে গুজবে। নানা রকম কাঁচা-কথা, নানা রকম কুৎসা সমাজের বিভিন্ন স্তরে মুখরোচক আলোচনা হিসেবে বাজার সরগরম করেছে। সম্প্রতি যাঁরা আটক হয়েছেন, এঁদের মধ্যে একমাত্র পরীমনি সবার পরিচিত। সে কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছে এবং নানা কারণে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়া অন্যদের মধ্যে যাঁদের মডেল বলা হচ্ছে; তাঁদের কেউ চেনেন কি না জানি না, আমরা চিনি না। তাঁদের সঙ্গে পরীমনিকে মিলিয়ে ফেলা যাবে না।
একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জনপ্রিয়তার একটা জায়গায় পৌঁছাতে হয়। পরীমনিকে সেই সংগ্রাম করতে হয়নি বললেই চলে। নানা কারণে সমাজের অনেক ক্ষমতাবান লোকের সঙ্গে তার পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে। ফলে দেখা গেছে, তার মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে আইন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। যে কারণে সে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নাম করছিল, এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছেও বিচার চাইছিল। গণমাধ্যম তার বিষয়টি লুফে নিয়েছে। দর্শকেরা অত্যন্ত আগ্রহভরে তার ঘরে নানা রকম বিদেশি মদ দেখেছে। প্রচলিত আইনে মদ যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে তার বাড়িতে কীভাবে মদের পাহাড় গড়ে উঠল, তার আদ্যোপান্ত কিছুই বোঝা যায় না।
আমাদের সমাজে নারীদের চরিত্র হনন খুব সহজ। একটি স্থিরচিত্রই একজন নারীর চরিত্র হননের জন্য যথেষ্ট। আজকের ইলেকট্রনিক মিডিয়া এসব সংবাদ প্রচারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। সেটার মধ্য দিয়ে এই নারীদের একধরনের বিচারও হয়ে যায়। দেশে এ-সংক্রান্ত কিছু আইন আছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেই। যা আছে সবক্ষেত্রে সেসব মানা হয় না। বিষয়টিকে এমন ফলাও করে প্রচার না করে আইনের পথে অগ্রসর হওয়া গেলে পরীমনি ও অন্যদের যে আপাত সম্ভ্রমহানি হলো, সেটা হতো না। তারপর বিচার-বিবেচনা, যুক্তি-তর্ক এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেটি প্রমাণ হতো, সেটি প্রকাশ করাই যথার্থ হতো বলে বিবেচনা করি। আইনের প্রয়োগ যথার্থভাবে হলে আমরা এ রকম অনেক সংকট থেকে রক্ষা পেতে পারি।
সুলতানা কামাল বলেছেন, মানবাধিকারকর্মী হিসেবে এবং সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের আকাক্সক্ষা থাকে, একটি গণতান্ত্রিক সমাজে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন হবে। দুটির জন্যই আমাদের আইনকানুন ও সাংবিধানিক নির্দেশনা রয়েছে, সুশাসনের নীতিমালা রয়েছে। আর সে জন্যই রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে।
আমাদের সংবিধানে বলা আছে, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক মর্যাদা ও সম্মান আছে।
নাগিরকের সেই সম্মান ও মর্যাদা রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হবে। একটি কথা আমরা সব সময় বলি, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এটা শুধু যিনি অভিযুক্ত বা অপরাধী তাঁর ক্ষেত্রেই খাটে তা নয়, যিনি বা যাঁরা আইন প্রয়োগ করছেন, তাঁদের জন্যও প্রযোজ্য। সেই নিরিখে যদি বিচার করি, তাহ৯লে এখন পরীমনিসহ একাধিক নারীর সঙ্গে যেসব আচরণ হচ্ছে, তাতে আমাদের বিব্রত বোধ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা এই আস্থা রাখলাম, যাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আছেন, তাঁরা সৎ উদ্দেশ্যে সমাজে এবং দেশে অপরাধ কমানোর এসব কাজ করছেন। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তাঁরা এসব কাজ করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এগুলো কী এমনই ঘটনা যে ওয়ারেন্ট (পরোয়ানা) ছাড়াই এভাবে গ্রেপ্তার করতে হবে?
মানবাধিকার ও আইনের শর্ত অনুযায়ী, আইন প্রয়োগের কিছু মাপকাঠি থাকে। শুধু অভিযাগের ভিত্তিতে জনসমক্ষে এনে পরিচয় তুলে ধরায় একধরনের ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করা হচ্ছে। এভাবে জনতার আদালতে তাঁদের দাঁড় করানো কতটুকু সমীচীন? মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব আচরণে যথেষ্ট আপত্তিকর কারণ আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিচার বিভাগের মাধ্যমে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ তাদের ‘আসামি’ হিসেবেও অভিহিত করা যাবে না। কিন্তু তেমন ভাষাও ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিচারের পর যদি দেখা যায়, তাঁরা অপরাধটা করেননি, তখন অভিযুক্ত ব্যক্তির সুনাম ও মানসিক স্বাস্থ্যের যে ক্ষতিটা হলো, সেই ক্ষতিপূরণ করার কি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে? এ ধরনের আচরণ রাষ্ট্র তার নাগরিকের সঙ্গে করতে পারে না। মাদকাসক্তির মতো অনাচার, মানুষকে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মানুষকে বিপদে রাখা এসবের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু আমাদের দাবিটা হলো, তারা এসব কিছু করবে আইনানুগ পদ্ধতিতে। তারা মানুষের অধিকার ও মর্যাদার শর্ত ভঙ্গ করবে না। আমাদের একটি বিষয় ভুললে চলবে না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিন্তু বিচারক নয়।
এখন যেসব মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, আমি আশা করছি তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন। তাঁরা অপরাধ করে থাকলে শাস্তি পাবেন। কথা হলো, এই অপরাধগুলো তো কেউ একা সংঘটিত করছেন না। যেসব বিবরণ আমরা পাচ্ছি সেখানে দেখা যাচ্ছে, আরও অনেক মানুষ জড়িত। এমনও মানুষ জড়িত আছেন, যাঁদের এ ধরনের ঘটনায় পৃষ্ঠপোষকতা করার আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষমতা আছে। যাঁদের সহযোগিতায় এসব অপরাধ হচ্ছে, নেপথ্যে থাকা তাঁদের একজনেরও তো হদিস আমরা পাচ্ছি না।
আমি নারী হিসেবে কাউকে রক্ষা করার জন্য বলছি না, কাউকে বাঁচানোর জন্য বরছি না। কিন্তু একটি কথা অনস্বীকার্য যে নারীরা অনেক সহজে এসব কাজে ব্যবহৃত হতে পারেন। সেসব ব্যবহারকারী ও পৃষ্ঠপোষকতা দানকারী কেন শাস্তির আওতায় আসছেন না। এসব পেছনের ব্যক্তিরা বলদর্পী, ক্ষমতাশালী। এঁরা অপরাজনীতি, কালোটাকার অর্থনীতি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁদের চিহ্নিত করা, বিচারের মুখোমুখি করা খুব দরকার। আশা করি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই দায়িত্ব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখবে।
কৃতজ্ঞতা: দৈনিক প্রথম আলো