Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আসাদুজ্জামান নূরের সাথে একটি দুপুর

আমীরুল ইসলাম

কর্মব্যস্ত বেইলি রোডের মাঝামাঝি নিরিবিলি নওরতন কলোনী। বিশাল শান্ত এক পুকুরের পশ্চিমে সেই ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকেন আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক মহীরুহ। তার নাম আসাদুজ্জামান নূর। বহু পরিচয়ে তিনি ঋদ্ধ। তিনি বিখ্যাত অভিনেতা। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকার। শ্রেষ্ঠ মঞ্চ অভিনেতা। সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব। জনদরদী সংসদ সদস্য। সাবেক মন্ত্রী। ইতিহাসের জলন্ত সাক্ষী। তার দিকে তাকিয়ে আমাদের বিস্ময়ের সীমা নেই। সেই বিস্ময়মাখা শ্রদ্ধা নিয়ে একদিন তার ফ্ল্যাটে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ এলো। কবিতা আবৃত্তির রেকর্ডিং করব। সেই উপলক্ষে তার সঙ্গে আলাপচারিতা। প্রযোজক ইফতেখার মুনিম মহা উত্তেজিত। আসাদুজ্জামান নূরের আবৃত্তি প্রত্যক্ষ করা এক বিরল অভিজ্ঞতা।
ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেই আমি যুগপৎ বিস্মিত ও স্তম্ভিত। এ কি কোনো ঘুমন্ত রাজপ্রসাদে প্রবেশ করলাম? ইমরান পরশ হতচকিত। মুনিম শুধু বলল, আমরা কি কোনো মিউজিয়ামে প্রবেশ করেছি?
বিভ্রম কাটতে কিছুটা সময় কাটল। বিশাল দুটি হলঘর। সুপ্রশস্ত দেয়ালের চারপাশে দেশসেরা চিত্রশিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম। আর চারপাশে কাঠের পাটাতনে সজ্জিত দুর্মূল্য সব মনোহর এন্টিক দ্রব্যাদি। কয়েকটা পুরনো দিনের স্টাইলের সোফাসেট। একজন পোষা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনজন কাজের ছেলে সদা প্রস্তুত। তারাই এই জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। ঝাড়মোছ চলে সারাদিন ধরে। বিশাল এক লাইব্রেরি আছে দুই হলঘরের মধ্যখানে। খুব গুরুত্বপূর্ণ বই তিনি সংগ্রহ করে থাকেন।
আসাদুজ্জামান নূর একজন সার্থক সংগ্রাহক। বই পেইন্টিং ও পুরনো জিনিশের বিপুল সংগ্রহশালা তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন। আমরা ক্যামেরা লাইট ঠিক করতে লাগলাম। নিঃশব্দ বাড়ি। জনমানুষের সাড়া শব্দ নেই। মধ্য দুপুরে আজানের ধ্বনি শুনতে পেলাম একবার। কিন্তু অকারণ শব্দের কোনো বাড়াবাড়ি নেই। বৈদ্যুতিক পাখাগুলোও ঘুরছে রুচি সম্পন্নভাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নূর ভাই এলেন। পরনে ট্রাউজার ও এক রঙের পাঞ্জাবি। খুব সাধারণ। করোনা সংকটে বাসায় বন্দি আছেন। আলস্য এবং হাতাশা দুটোই তাকে গ্রাস করেছে। তার নির্বাচনী এলাকাতেও অনেকদিন যান না। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা নাই অনেকদিন।
আমরা তাকে দেখেই শ্রদ্ধায় আনন্দে খুশি হয়ে উঠলাম। চিত্রকলা নিয়ে আমার নানা ধরনের শিশুতোষ প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলেন সহাস্যে। তারপর দেয়াল ঘুরে ঘুরে তিনি অতি আনন্দের সঙ্গে আমাদের পেইন্টিং দেখাতে লাগলেন। আমরাও উচ্ছ্সিত। উদ্বেলিত। এমন আনন্দ জীবনে খুব বেশি পাওয়া যায় না।
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কোনো কোনো ছবির তিনি ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন। মুর্তজা বশিরের দেয়াল সিরিজের একটা ছবি। মধ্য পঞ্চাশে আঁকা। জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমদ, কাজী আবদুল বাসেত, এস এম সুলতান, দেবদাস চক্রবর্তী, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কালিদাস কর্মকার, আমিনুল ইসলাম, মুস্তাফা মনোয়ার, আবদুশ শাকুর শাহ, সমরজিৎ রায় চৌধুরী কে নেই তার সংগ্রহশালায়।
মকবুল ফিদা হুসেন, বিজন চৌধুরী, যোগেন চৌধুরী। শাহাবুদ্দিনের আঁকা রবীন্দ্রনাথ। তরুণ শিল্পী কিরীটি রঞ্জন বিশ্বাসের আঁকা বঙ্গবন্ধু। কাইয়ুম চৌধুরীর স্ত্রী তাহেরা চৌধুরীর পেইন্টিং, কনক চাঁপা, খালিদ মাহমুদ মাহমুদ মিঠু সবারই একাধিক চিত্রকলা আছে নূর ভাইয়ের কাছে।
বিস্ময়কর এক জগতে আমরা প্রবেশ করলাম। গৃহসজ্জায় কোথাও রং ও রুচির বাড়াবাড়ি নেই। মুখোশের তিনি একজন বড় সংগ্রাহক। নানা দেশ থেকে কাপড় কাঠ, ও ধাতব নির্মিত মুখোশ তিনি ঘর জুড়ে সাজিয়ে রেখেছেন।
আসাদুজ্জামান নূর নিচুস্বরে একটা ড্রইং দেখিয়ে বললেন, এটা এস এম সুলতানের আঁকা। আমাদের অফিসে আমার টেবিলে বসে এঁকে দিয়েছিলেন। প্রতিটা ছবি সংগ্রহের পেছনে আছে বহু গল্প। বললেন, ছবি সংগ্রাহক হচ্ছেন মতি ভাই। প্রথম আলোর মতিউর রহমান। হাসনাত ভাইয়ের কাছেও অনেক ছবি আছে। এই যে প্রয়াত হলেন আবুল হাসনাত।
আবৃত্তির রেকর্ড করলেন খুব স্বল্প সময়ে। তারিক সুজাতের লেখা বঙ্গবন্ধু বিষয়ক একটা কবিতা। অসাধারণ দৃপ্ত কণ্ঠে, ঋজু ভঙ্গিতে পাঠ করলেন। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে আছি। রবীন্দ্রনাথের দুটো কবিতা আবৃত্তি করলেন। হাসতে হাসতে বললেন, বন্যা এমন দুটো কবিতা পড়তে অনুরোধ করেছে যে দুটো অতি কঠিন কবিতা। আবৃত্তির জন্য নয়। দার্শনিক কবিতা।
আমি জানালাম, আগে পরে বন্যাদির গান যাবে। তখন মানিয়ে যাবে বৃক্ষ বন্দনা কবিতাটি।
দেখা যাক চেষ্টা করি। কোন উচ্চস্তরের আবৃত্তি করলেন নূর ভাই তা নিয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কণ্ঠধ্বনির সুর মাধুর্য ছড়িয়ে পড়ল ড্রইংরুম জুড়ে।
তারপর চা খেতে খেতে সামান্য আড্ডা। আমরা তাকে ঘিরে বসলাম। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে নাগরিক গড়ে ওঠার গল্প শোনালেন। ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’ নাটকটি নূর ভাই অনুবাদ করেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে জিয়া হায়দার, রশিদ হায়দার, আতাউর রহমান, আলী যাকেরের কথাও শোনা হলো।
এক পর্যায়ে নূর ভাই বললেন, আমার বাবা-মা দুজনেই শিক্ষক। চল্লিশ দশকে তারা বিএ পাশ করেছেন। কমিটমেন্টের কারণে তারা শিক্ষক হয়েছিলেন। জীবনে যা কিছু করেছি-বাবা মায়ের আদর্শ মেনে চলেছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বঙ্গবন্ধু এসব ব্যাপারে কোনো আপোষ নাই। মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টাই আমাদের ব্রত।
নূর ভাই বললেন, শিক্ষা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত আছি বলে কত মহৎ মানুষের সঙ্গে একজীবনে দেখা হলো। কত বড় বড় মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। একদা বাম রাজনীতি করতাম। গ্রুপ থিয়েটার করতাম। সৌভাগ্য আমার- শওকত ওসমান, কামরুল হাসান, কবি শামসুর রাহমান, প্রভু খালেদ চৌধুরী, ছায়ানট প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক, আবদুল আহাদ, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিতকুমার গুহ, ড. আনিসুজ্জামান, সোহরাব হোসেন, কলিম শরাফি, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মুনির চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা। থোকা থোকা অনেক নাম। অনেক স্মৃতি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ত্যাগী নেতার বড় অভাব। এইসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে খুব পীড়িত হয়ে পড়েন তিনি। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রচণ্ড হতাশ নূর ভাই। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তার শিক্ষকদের কথা তিনি কখনো ভোলেননি। বললেন, কিছুদিন আগে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে এক বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম। বললাম, আগেকার শিক্ষকেরা ছিলেন দরিদ্র। তাদের জামার কলার হলুদ হয়ে যেত ময়লা জমে। এক সপ্তাহ তারা একই জামা পরতেন। ছাত্রদের প্রকৃত শিক্ষা দিতেন। যেন তারা ধনী হয়ে যেতে পারে। আজকাল শিক্ষকেরা ধনী। ছাত্রদের তারা দরিদ্র শিক্ষা দেন। শিক্ষা ব্যবস্থার এই নৈরাজ্য কিছুতেই মানতে পারেন না শিক্ষকপুত্র আসাদুজ্জামান নূর। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্স ঢুকে পড়েছে। সমাজের সর্বস্তরে এখন পচন। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতে হবে।
নূর ভাই খুব গম্ভীরভাবে বললেন, দুএকটা বিখ্যাত মানুষের গল্প শোনো-
লেখক-সাংবাদিক সত্যেন সেন। শাদা পায়জামা ও পকেটঅলা হাওয়াই শার্ট- একই রকম পোশাক পরে সারাজীবন কাটিয়েছেন। খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তখন তার ‘অভিশপ্ত নগরী’ বইটা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বিশটা কপি নূর ভাইকে দিয়ে বললেন বিক্রি করে টাকাটা দিয়ে যাস। বই বিক্রি হলো। টাকাও পেলেন নূর ভাই। কিন্তু সেই টাকা আর ফেরত দেয়া হলো না। একদিন সত্যেন সেনের সাথে দেখা। তিনি বিস্মিত হাস্যে বললেন, কী রে- তোরও অভাব। আমারও অভাব। অভাব নাহলে কি টাকাটা চাই? বুঝেছি তুই খেয়ে ফেলেছিস? অসুবিধা নাই। নূর ভাই বললেন, এমনই সরল সাধারণ ও মাটির মানুষ ছিলেন তারা। রণেশ দাশগুপ্তের একটা গল্প শোনালেন। তাঁতি বাজারের দিকে ভাঙা এক পোড়োবাড়িতে ছোট্ট এক ঘরে তিনি থাকতেন। কোনোমতে একজন শোয়া যায়। সন্তোষ গুপ্ত রসিকতা করে বলতেন, আমি ঘুমালে তো আমার ঠ্যাং দরজার বাইরে রাখতে হবে। কারণ সন্তোষ গুপ্ত ছিলেন লম্বা মানুষ। রণেশ দাশগুপ্ত তখন সংবাদে চাকরি করেন। নিয়মিত মাসোহারা পান। কিন্তু এমন ভাঙা ঘরে তিনি থাকতেন কেন? প্রশ্ন করতেই রণেশ দাশগুপ্ত বলেছিলেন, আমি ছেড়ে দিলে এই ঘর আর ভাড়া হবে না। ওদের আয় বন্ধ হয়ে যাবে। সামান্য হলেও ভাড়াটা যেন ওরা নিয়মিত পায় তাই আমার থাকা।
গল্পটা শুনে আমরা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম নূর ভাইয়ের মুখের দিকে। নূর ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, করোনা সংকটে এই গৃহবন্দী থাকা আর ভালো লাগে না। কবে যে এর সমাধান হবে? তোমরা ভালো থেকো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেশ করলেন, সাগর কেমন আছে? অপারেশন কবে? ইত্যাদি।
জানতে চাইলেন,
সায়ীদ ভাইয়ের শরীর কেমন? আল মনসুর এখন কোথায় থাকে? তারপর নাট্য জগতের কতজনের কথা টুকটাক করে বলতে লাগলেন। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, সেলিম আল দীন, হাবিবুল হাসান, রশীদ হায়দার, হুমাূন ফরিদী। প্রত্যেকের কথা বললেন। সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তখন দুপুরের সূর্য হেলে পড়েছে। আমরা বিদায় নিলাম। আসাদুজ্জামান নূর শান্ত ও গম্ভীরভাবে বললেন, আজকের আবৃত্তি ভালো হলো না। আরেক দিন করে দেব। আমরা বাকরুদ্ধ! এতবড় শিল্পীর এই বিনয় দেখে আমরা চুপ মেরে গেলাম। সুদূর আমেরিকা থেকে তখন ফরিদুর রেজা সাগরের টেলিফোন। কুশল বিনিময়। নূর ভাই খুশি হলেন সাগর ভাইয়ের টেলিফোন পেয়ে।
আমাদের বিদায় দিতে দরজা পর্যন্ত এলেন। বললেন, ভালো থেকো। সবাই সবার জন্য কল্যাণ কামনা করো।

লেখক : বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক