Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

শোবিজের সাম্প্রতিক ঘটনায় যা বললেন মামুনুর রশীদ ও সুলতানা কামাল

বিনোদন জগতের চলমান অস্থির ঘটনার প্রেক্ষিতে নাট্যজন মামুনুর রশীদ ও মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল দেশের একটি শীর্ষ দৈনিক পত্রিকায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
মামুনুর রশীদ বলেছেন, বিনোদন অঙ্গনের কেউ আটক হওয়া এটাই প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার এমন প্রসঙ্গ সামনে এসেছে। পত্রপত্রিকায় অনেক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় লাইভে সেসব দেখানো হয়েছে। মানুষের কৌতূহল মেটাতে গিয়ে সেসব ঘটনার অনেক ধরনের ডালপালা গজিয়েছে।
মডেল তিন্নি হত্যার ঘটনায় অভিনয়শিল্পীদের অনেককেই নিয়মিত পুলিশের বিশেষ শাখায় ধরনা দিতে হতো। তখন ছিল বিএনপির সময়। শেষ পর্যন্ত উচ্চ মহলের হস্তক্ষেপে সেটি বন্ধ হয়েছিল। এরপরও দু-একজন নামকরা অভিনেত্রীকে নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আমরা বলেছি, এগুলোর ট্রায়াল হোক, মিডিয়া ট্রায়াল যেন না হয়। অতীতে যাঁরা আটক হয়েছিলেন, পরে বিচারে তাঁদের কিছু বের হয়ে আসেনি।
সম্প্রতি যা ঘটেছে, তাতে অনেক বিষয় দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু যেটা দৃশ্যমান হয়নি, সেসব পরিণত হয়েছে গুজবে। নানা রকম কাঁচা-কথা, নানা রকম কুৎসা সমাজের বিভিন্ন স্তরে মুখরোচক আলোচনা হিসেবে বাজার সরগরম করেছে। সম্প্রতি যাঁরা আটক হয়েছেন, এঁদের মধ্যে একমাত্র পরীমনি সবার পরিচিত। সে কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছে এবং নানা কারণে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়া অন্যদের মধ্যে যাঁদের মডেল বলা হচ্ছে; তাঁদের কেউ চেনেন কি না জানি না, আমরা চিনি না। তাঁদের সঙ্গে পরীমনিকে মিলিয়ে ফেলা যাবে না।
একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জনপ্রিয়তার একটা জায়গায় পৌঁছাতে হয়। পরীমনিকে সেই সংগ্রাম করতে হয়নি বললেই চলে। নানা কারণে সমাজের অনেক ক্ষমতাবান লোকের সঙ্গে তার পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে। ফলে দেখা গেছে, তার মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে আইন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। যে কারণে সে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নাম করছিল, এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছেও বিচার চাইছিল। গণমাধ্যম তার বিষয়টি লুফে নিয়েছে। দর্শকেরা অত্যন্ত আগ্রহভরে তার ঘরে নানা রকম বিদেশি মদ দেখেছে। প্রচলিত আইনে মদ যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে তার বাড়িতে কীভাবে মদের পাহাড় গড়ে উঠল, তার আদ্যোপান্ত কিছুই বোঝা যায় না।
আমাদের সমাজে নারীদের চরিত্র হনন খুব সহজ। একটি স্থিরচিত্রই একজন নারীর চরিত্র হননের জন্য যথেষ্ট। আজকের ইলেকট্রনিক মিডিয়া এসব সংবাদ প্রচারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। সেটার মধ্য দিয়ে এই নারীদের একধরনের বিচারও হয়ে যায়। দেশে এ-সংক্রান্ত কিছু আইন আছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেই। যা আছে সবক্ষেত্রে সেসব মানা হয় না। বিষয়টিকে এমন ফলাও করে প্রচার না করে আইনের পথে অগ্রসর হওয়া গেলে পরীমনি ও অন্যদের যে আপাত সম্ভ্রমহানি হলো, সেটা হতো না। তারপর বিচার-বিবেচনা, যুক্তি-তর্ক এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেটি প্রমাণ হতো, সেটি প্রকাশ করাই যথার্থ হতো বলে বিবেচনা করি। আইনের প্রয়োগ যথার্থভাবে হলে আমরা এ রকম অনেক সংকট থেকে রক্ষা পেতে পারি।
সুলতানা কামাল বলেছেন, মানবাধিকারকর্মী হিসেবে এবং সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের আকাক্সক্ষা থাকে, একটি গণতান্ত্রিক সমাজে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন হবে। দুটির জন্যই আমাদের আইনকানুন ও সাংবিধানিক নির্দেশনা রয়েছে, সুশাসনের নীতিমালা রয়েছে। আর সে জন্যই রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে।
আমাদের সংবিধানে বলা আছে, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক মর্যাদা ও সম্মান আছে।
নাগিরকের সেই সম্মান ও মর্যাদা রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হবে। একটি কথা আমরা সব সময় বলি, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এটা শুধু যিনি অভিযুক্ত বা অপরাধী তাঁর ক্ষেত্রেই খাটে তা নয়, যিনি বা যাঁরা আইন প্রয়োগ করছেন, তাঁদের জন্যও প্রযোজ্য। সেই নিরিখে যদি বিচার করি, তাহ৯লে এখন পরীমনিসহ একাধিক নারীর সঙ্গে যেসব আচরণ হচ্ছে, তাতে আমাদের বিব্রত বোধ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা এই আস্থা রাখলাম, যাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আছেন, তাঁরা সৎ উদ্দেশ্যে সমাজে এবং দেশে অপরাধ কমানোর এসব কাজ করছেন। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তাঁরা এসব কাজ করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এগুলো কী এমনই ঘটনা যে ওয়ারেন্ট (পরোয়ানা) ছাড়াই এভাবে গ্রেপ্তার করতে হবে?
মানবাধিকার ও আইনের শর্ত অনুযায়ী, আইন প্রয়োগের কিছু মাপকাঠি থাকে। শুধু অভিযাগের ভিত্তিতে জনসমক্ষে এনে পরিচয় তুলে ধরায় একধরনের ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করা হচ্ছে। এভাবে জনতার আদালতে তাঁদের দাঁড় করানো কতটুকু সমীচীন? মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব আচরণে যথেষ্ট আপত্তিকর কারণ আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিচার বিভাগের মাধ্যমে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ তাদের ‘আসামি’ হিসেবেও অভিহিত করা যাবে না। কিন্তু তেমন ভাষাও ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিচারের পর যদি দেখা যায়, তাঁরা অপরাধটা করেননি, তখন অভিযুক্ত ব্যক্তির সুনাম ও মানসিক স্বাস্থ্যের যে ক্ষতিটা হলো, সেই ক্ষতিপূরণ করার কি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে? এ ধরনের আচরণ রাষ্ট্র তার নাগরিকের সঙ্গে করতে পারে না। মাদকাসক্তির মতো অনাচার, মানুষকে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মানুষকে বিপদে রাখা এসবের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু আমাদের দাবিটা হলো, তারা এসব কিছু করবে আইনানুগ পদ্ধতিতে। তারা মানুষের অধিকার ও মর্যাদার শর্ত ভঙ্গ করবে না। আমাদের একটি বিষয় ভুললে চলবে না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিন্তু বিচারক নয়।
এখন যেসব মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, আমি আশা করছি তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন। তাঁরা অপরাধ করে থাকলে শাস্তি পাবেন। কথা হলো, এই অপরাধগুলো তো কেউ একা সংঘটিত করছেন না। যেসব বিবরণ আমরা পাচ্ছি সেখানে দেখা যাচ্ছে, আরও অনেক মানুষ জড়িত। এমনও মানুষ জড়িত আছেন, যাঁদের এ ধরনের ঘটনায় পৃষ্ঠপোষকতা করার আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষমতা আছে। যাঁদের সহযোগিতায় এসব অপরাধ হচ্ছে, নেপথ্যে থাকা তাঁদের একজনেরও তো হদিস আমরা পাচ্ছি না।
আমি নারী হিসেবে কাউকে রক্ষা করার জন্য বলছি না, কাউকে বাঁচানোর জন্য বরছি না। কিন্তু একটি কথা অনস্বীকার্য যে নারীরা অনেক সহজে এসব কাজে ব্যবহৃত হতে পারেন। সেসব ব্যবহারকারী ও পৃষ্ঠপোষকতা দানকারী কেন শাস্তির আওতায় আসছেন না। এসব পেছনের ব্যক্তিরা বলদর্পী, ক্ষমতাশালী। এঁরা অপরাজনীতি, কালোটাকার অর্থনীতি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁদের চিহ্নিত করা, বিচারের মুখোমুখি করা খুব দরকার। আশা করি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই দায়িত্ব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখবে।
কৃতজ্ঞতা: দৈনিক প্রথম আলো