Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ফরাজি আলী ক্যানভাস মঞ্চের নায়ক : হাশেম খান

ফরাজিকে এখন আর্ট ইনষ্টিটিউটের কোনো ছাত্র চেনে না। চেনার কথাও নয়। ফরাজি নেই আজ প্রায় বারো বছর। তার আগে অর্থাৎ ঊনিশ শ ছেষট্টি সাল পর্যন্ত প্রতিদিন সব সময়ই তাকে দেখা গেছে আর্ট ইনষ্টিটিউট চত্বরে। আর্ট ইনষ্টিটিউটই ছিল তার জীবন  তার সব কিছু। বাংলাদেশের প্রথম সারির শিল্পী যাঁরা এবং আর্ট ইনষ্টিটিউটের জন্ম থেকে আঠারো বছর পর্যন্ত যারা ছাত্র ছিল  কেউ তাকে ভুলতে পারে না  ভুলে থাকা যায়ও না। মানুষ আঁকার প্রথম পাঠ ফরাজি আলীকে দিয়েই শুরু করতে হত। কারণ ফরাজি তখন আর্ট ইনষ্টিটিউটের মডেল।  আর্ট ইনষ্টিটিউট পরে কয়েক বছরের জন্যে নামকরণ হয়  আর্ট কলেজ। ফরাজি ইনষ্টিটিউট ও কলেজ দুপর্যায়েই জড়িত ছিল। জনসন রোডে ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের দুটি কামরা ভাড়া নিয়ে প্রথম শুরু আর্ট ইনষ্টিটিউটের। প্রায় সেই শুরু থেকেই ফরাজি জড়িয়ে পড়েছে শিল্পীদের সাথে ছবি আঁকার মডেল হিসেবে। অথচ এই অদ্ভুত ও সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আগের মুহ‚র্তে সে ভাবতে পারেনি সে মডেল হিসেবে আর্ট ইনষ্টিটিউটের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। ফরিদপুরে ছিল ফরাজি আলীর বাড়ি। অভাব অনটনের সংসার। জমিজমা সব বিক্রি করে কদিনেই খেয়েদেয়ে যখন সে কপর্দক শূন্য  তখন বউ, চার বছরের মেয়েকে ফেলে পালাল। ফরাজিরও আর দিন কাটে না। কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাল ঢাকায়। মেয়েকে রেখে এল বৃদ্ধ মা-বাবার কাছে।  দুদিন ধরে পেটে কিছু পড়েনি  কাজও পায়নি কিছু। পথে পথে ঘুরে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ফরাজি একটা বড়সড় বাড়ির বারান্দায় শরীরটাকে এলিয়ে দিল। ক্লান্তিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত তখন গভীর। হঠাৎ হৈচৈ হট্টগোলে জেগে গেল ফরাজি। তাকে ঘিরেই হৈচৈ।  ধর ধর  চোর চোর বেটাকে মার।  লাগা কয়েক ঘা   বেটা বাটপাড়  ফরাজি হতভম্ব। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েক ঘা পড়েছে। পিটিয়ে মেরেই ফেলত তাকে। বাঁচাল এসে বাড়ির দারোয়ান। দশাসই শরীর দারোয়ানের। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে হাঁকল  কেন মারছো লোকটাকে? এর তো অসুখ।  না, হানিফ মিয়া, তুমি জান না  ও বেটা চুরি করে পালাচ্ছিল। আমার দোকানের ঝাঁপ ভেঙে ফেলেছে, আমি টের পেতেই বেটা ছুটে এসে এখানে পালিয়েছে। ঘুমের ভান করছে এখন।  বেটা এক নম্বরের বাটপাড়  মারো শালারে   থামো! আবারো হাঁকল হানিফ মিয়া। বলল  আমি সন্ধ্যা থেকেই দেখছি এ লোক এখানে বারান্দায় শুয়ে আছে। আমি কয়েকবার ডেকেছি  সাড়া পাইনি, গায়ে হাত দিয়ে দেখি জ্বর, তাই আর লোকটাকে তাড়াইনি। কিন্তু পাড়ার লোকরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। যার দোকানের ঝাঁপ ভেঙেছে সে বলছে  আমি নিজের চোখে দেখেছি এই লোককে দৌড়ে পালাতে; একদম এই চেহারা  বেশভ‚ষা সবই ঠিক মিলে যাচ্ছে, আমার কোনো সন্দেহ নেই।  হানিফ মিয়া, তুমি একে থানায় দাও। দারোয়ান হানিফ মিয়া মুশকিলে পড়ল। এরা বলছে এ লোককেই পালাতে দেখেছে আর সে জানে সন্ধ্যে থেকেই লোকটা ঘুমাচ্ছে বারান্দায়  গায়েও জ্বর। চেহারা ছুরতে চোরও মনে হয় না। শেষে অনেক বাকবিতন্ডার পর ঠিক হলো  লোকটাকে থানায় দিয়ে কাজ নেই। সকালবেলা বড় সাহেব অফিসে আসবেন, তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে। তিনিই ঠিক করবেন একে থানায় দেবেন না কি করবেন। সকাল নটার দিকে বড় সাহেব এলেন। এই বড় সাহেব হলেন শিল্পী জয়নুল আবেদিন  আর্ট ইনষ্টিটিউটের অধ্যক্ষ। আর বাড়িটি হলো প্রথম আর্ট ইনষ্টিটিউট ভবন। নবাবপুরে ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনষ্টিটিউটের দুটি কামরা। অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিনকে ইনষ্টিটিউটের দারোয়ান বেয়ারা পিয়নরা বড় সাহেব বলে সম্বোধন করত। হানিফ মিয়া ফরাজিকে জয়নুল আবেদিনের সামনে নিয়ে এল। তারপর গতরাতের সব ঘটনা খুলে বলল। জয়নুল আবেদিন ভীতসন্ত্রস্ত ও ক্লান্ত ফরাজির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন:  সত্যি করে বলতো তুমি চুরি করেছ কিনা? ফরাজি জয়নুল আবেদিনের জেরাতে আশ্বাসের সুর খুঁজে পেল। হাত জোড় করে ধরা ধরা গলায় বলল,  হুজুর আমাকে বাঁচান  দুদিন কিছু খাইনি  আমি চুরি করিনি, হুজুর । জয়নুল আবেদিন হানিফ মিয়াকে নির্দেশ দিলেন  একে তোমার কাছে রেখে দাও, আর এখনি কিছু খেতে দাও  এই নাও টাকা। থানায় দিয়ে কাজ নেই। সেদিন জয়নুল আবেদিনের বিচার দেখে সবাই অবাক। তার চেয়েও অবাক হওয়ার বিষয়  পরদিন। জয়নুল আবেদিন ফরাজিকে নিয়ে ঢুকলেন ড্রইং ক্লাসে। তাকে একটি ভঙ্গি দেখিয়ে বললেন  এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাক। ইজেল, বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ছাত্ররা ফরাজিকে ঘিরে। ড্রইং মকস শুরু হলো। আর সেই থেকে শুরু হয়ে গেল ফরাজি আলীর মডেল জীবন। ফরাজি তার মডেল জীবনে অনেক বড় বড় শিল্পীর ক্যানভাসে উঠে এসেছে। শিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টিতে কল্পনার রূপ দিয়েছেন  ফরাজিকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নির্বাচন করে। শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক, খাজা শফিক আহমেদ, শফিউদ্দিন আহমদ, কিবরীয়া  এঁরা অনেক ছবিতে অনেক চিত্র-রূপ দিয়েছেন ফরাজিকে মডেল করে। শিল্পী আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ শফিকুল হোসেন, আবদুল বাসেত, ইমদাদ হোসেন, নিতুন কু ু এবং পরবর্তীকালে অনেক শিল্পীই ফিগার আঁকার প্রথম পাঠ থেকে শুরু করে  মানুষকে বিষয় করে চিত্র রচনায় ফরাজিকে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন। কখনো রিয়ালিস্টিক ফর্মে কখনো ডিজাইনে কিংবা নানান কোণ ও ইমেজ ফেলে, ফিগার ভেঙে রং রেখায় টেকসারে তাদের ছবিতে উপস্থাপিত করেছেন। এভাবে চিত্রকলা নাটকের ক্যানভাস নামের মঞ্চে বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে হাজির হয়েছে ফরিদপুরের এক গন্ডগ্রামের যুবক ফরাজি আলী। কখনো ফেরিওয়ালা মুরগির বেপারী বৈঠা হাতে খেয়ানায়ের মাঝি, একতারা হাতে বাউল, দরবেশ, কুলি, ধোপদুরস্ত পোশাক পরে ফুল বাবু স্কুল মাস্টার এমনি অসংখ্য চরিত্র ও জীবন। প্রদর্শনীর পর প্রদর্শনীতে বার বার সে ফিরে এসেছে। শিল্পীরা অনেকেই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন  তাঁদের শিল্পকর্মে সুনাম কুড়িয়েছেন  শিল্পকলার ক্ষেত্রে নিজের অবদান রেখে ধন্য হয়েছেন। আর ফরাজি আলী  শিল্পীদের সৃষ্টির বিষয়ে নেপথ্য নায়কের ভ‚মিকা পালন করে গেছে। তাদের কল্পনাকে রূপ দিতে নিজকে বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে। মোহগ্রস্ত ফরাজি ছুটে বেড়িয়েছে ক্যানভাসের পর ‘ক্যানভাস মঞ্চ’ সাফল্যে। নিজের দিকে তাকাবার সময় সে পায়নি। মডেলের কাজ করে তার যা রোজগার হতো জীবন ধারনের ন্যূনতম প্রয়োজন  খাওয়া পরা তার ঠিকমতো চলত না। এই অদ্ভুত জীবিকাকে ফরাজি ভালোবেসে ফেলেছিল। তাই এতো কষ্টেও অন্য কোনো কাজ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। অনাহারে, অর্ধাহারে দিনের পর দিন যেতে যেতে সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। অসংখ্য রোগ তার শরীরে ভর করল। কাজ করার শক্তি গেল ফুরিয়ে। তারপর একদিন ফুরিয়ে গেল তার প্রয়োজন। ফরাজির সঙ্গে আমার পরিচয় আর্ট ইনষ্টিটিউটে ভর্তি হতে এসে প্রথম দিনেই ১৯৫৬ সালে। গেট দিয়ে ঢুকেই দেখি  ডান পাশে একটা লম্বা বেঞ্চিতে বসে একটা লোক  গায়ে গেঞ্জি ও পরনে লুঙ্গি। আমাকে দেখেও দেখেনি এমনি একটা ভাব নিয়ে বসে আছে। ভর্তি পরীক্ষা কখন হবে, কোথায় হবে  কি কি লাগবে  এসব খোঁজ নেয়া আমার প্রয়োজন। আশপাশে আর কাউকে দেখছি না। অফিসের দিকে এগোব কি না ভাবছি  ভয়ও লাগছে। ঢাকা শহরে এই প্রথম। জড়তা ও ভয়ে আমার পা দুটোকে আড়ষ্ট করে ফেলেছে। আমার অবস্থা খানিকটা আঁচ করতে পেরেই বোধহয় লোকটি মুখ তুলে তাকাল। বলল, কী চাই? তারপর কাছে এগিয়ে এল। বললাম  আজ তো এখানে ভর্তি পরীক্ষা, কখন শুরু হবে? সে তো এগারোটায়; এখন তো নটা বাজে। হ্যাঁ, নটা। আমি আগেই চলে এসেছি।  তা হলে একটু ঘুরে আসেন আর না হয় অপেক্ষা করেন। তারপর হঠাৎ আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল এবং জিজ্ঞেস করল বাড়ি কোথায়? আমি জবাব দিলাম। এককথা দুকথা থেকে বেশ আলাপ জুড়ে দিলাম লোকটির সাথে। আর্ট ইনষ্টিটিউটের অনেক খবর নেয়া হয়ে গেছ ইতোমধ্যে। কিন্তু একটা খবর নেয়ার জন্য অনেকক্ষণ ধরে কৌত‚হল চেপে রেখেছি। শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে আমি দেখিনি। কাগজে তার আঁকা ছবি দেখেছি কিন্তু তার চেহারা কখনো দেখনি। লোকটির সাথে কথা বলার সময় লক্ষ্য করেছি ইনষ্টিটিউটের বারান্দা দিয়ে এক ভদ্রলোক বেশ কয়েকবার এলেন ও গেলেন এবং একে নির্দেশ দিচ্ছেন ওকে আদেশ করছেন  খুব ব্যস্ত সমস্ত ভাব। তাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম  উনি কি জয়নুল আবেদিন  এখানকার প্রিন্সিপাল? আমার কথা শুনে লোকটি বারান্দার দিকে তাকিয়ে তাঁকে দেখল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল এবং বলল, হ্যাঁ, জয়নুল আবেদিন স্যার। কেন আপনি ওনার সাথে দেখা করবেন?  না এমনি। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে আরেকটু কাছে ঘেঁষে বলল  আমাকে চার আনা পয়সা দিন তো। কাল দিয়ে দেব। ভর্তি পরীক্ষা আপনার ভালো হবে। আপনি তো ভর্তি হচ্ছেনই। অনেক উপকার করেছে লোকটি আমার। তাই দ্বিরুক্তি না করে সঙ্গে সঙ্গে পয়সা দিয়ে দিলাম। এ লোকই ফরাজি আর এভাবেই ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। যথারীতি ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি এবং আর্ট ইনষ্টিটিউটে ভর্তি হয়ে ক্লাস করে যাচ্ছি। কিছুদিন পরই বুঝতে পারলাম ফরাজি আমাকে ফাঁকি দিয়েছে। জয়নুল আবেদিন পরিচয় দিয়ে যাকে দেখিয়েছে তিনি শিল্পী আনোয়ারুল হক। জয়নুল আবেদিন তখন দেশের বাইরে  ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফরাজির প্রতি খারাপ ধারণা জন্মাল। ওর সঙ্গে দেখাও হয় না যে জিজ্ঞেস করব। উপরের ক্লাসে মডেল দেয় সে। এর মধ্যে আর্ট ইনষ্টিটিউটে আমার ছয় মাস পার হয়ে গিয়েছে। ইনষ্টিটিট সেগুন বাগিচার ভাড়াবাড়ি থেকে শাহবাগে নিজস্ব ভবনে চলে এসেছে। ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক সবার মধ্যেই একটা নতুন উদ্যম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিন ইনষ্টিটিউটের গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখি প্রশস্ত বারান্দায় এক সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক  চেয়ারে বসে। তাকে ঘিরে শিক্ষকরা  কামরুল হাসান, শফিকুল আমিন, শফিউদ্দিন আহমদ। গল্প করছেন তাঁরা। চিনতে এবার আর কষ্ট হলো না  শিল্পী জয়নুল আবেদিন, তিনি দেশে ফিরেছেন। খবরের কাগজে ছবিসহ খবর আজই সকালবেলা দেখেছি। পাশ দিয়ে হেঁটে আমি ক্লাসের দিকে এগোলাম। ক্লাসে ঢুকতে যাব এমন সময় বারান্দার থামের আড়াল থেকে কে যেন ডাকল   এই যে ভাই শুনুন। তাকিয়ে দেখি ফরাজি।  কেন?  আমাকে মাফ করে দিয়েন। অনেক দেরি হয়ে গেছে  আপনার কাছ থেকে চার আনা পয়সা ধার করেছিলাম  নেন। আর জয়নুল আবেদিন স্যার ঐখানে বসে আছেন বারান্দায়  দেখছেন? তিনি বিদেশে ছিলেন, ফিরে এসেছেন। অনেকদিন আগে আপনারে আমি ভুল দেখাইছিলাম। কিছু মনে কইরেন না। পয়সা ধারের কথা ভুলেই গিয়েছি। কিন্তু আনোয়ারুল হককে জয়নুল আবেদিন বলে চালিয়ে দেয়ার কথা ভুলিনি। এতোদিন পর ফরাজির অপরাধ স্বীকার ও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি আমাকে অবাক করল। এরপর পাঁচ বছর আর্ট ইনষ্টিটিউটের ছাত্র জীবনে এবং পরবর্তীকালে শিক্ষকতা করতে যেয়ে ফরাজিকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তার অদ্ভুত আচরণ, চলাফেরা ও কথাবার্তায় অনেকবারই চমকে উঠেছি। আর বার বারই মনে হয়েছে  লেখাপড়া না জানা এই ফরাজি আর কয়টা সাধারণ মানুষের মতো নয়। একটা ভিন্নতর রূপ আছে তার। আর এই ভিন্ন রূপ বা আলাদা সত্তা  জয়নুল আবেদিন প্রথম দিনেই হয়তো অনুমান করতে পেরেই ফরাজিকে শিল্পীদের কাছে রেখে দিয়েছেন। ফরাজি যখন কথা বলত, নির্বিকারভাবেই বলত। তবে কথা সে খুবই কম বলত। একবার আমাদের থার্ডইয়ারে পোট্রেট পেন্টিং এর ক্লাস। মডেল ফরাজি। চারদিন ধরে (প্রোট্রেট) মুখ ও চেহারা আঁকা চলছে  আজ শেষ দিন। সবারই প্রায় আঁকা শেষ। টিফিন পিরিয়ডের পর ক্লাসে ঢুকে দেখি, ফরাজি ঘুরে ঘুরে সবার ছবি দেখছে। আমরাও উৎসাহিত হয়ে বলি  ফরাজি বল দেখি কোন ছবিটা ভালো হয়েছে  চেহারা মিলেছে কোন ছবির ইত্যাদি। ফরাজি স্বভাব-সুলভ একটু হেসে  ঘুরেফিরে দেখছে আর বলছে  বিদেশে মডেলরা অনেক সময় ক্লাস নেয়, তাদের শিক্ষক প্রয়োজন হয় না। আমার তো আর্ট স্কুলে কম দিন হলো না। নয় দশ বছর হয়ে গেছে। কত আর্টিস্ট পাস করে গেল। আমার দেহটাকেই তো এঁকেছে বেশি। আমরাও তার কথায় সায় দিই  হ্যাঁ, ফরাজি তুমিও আমাদের ক্লাস নিতে পার। এখন বল, কোন ছবিটা ভালো। ফরাজি তাকিয়ে তাকিয়ে হাসে। তারপর তার মডেল দেয়ার ছোট্ট টুলে গিয়ে বসে। গলায় একটু জোর নিয়ে বলল   এক কাজ করেন, চারদিন ধইরা মেলা কষ্ট করলেন, রং আর তুলি নিয়া অনেক খোঁচাখুঁচি করলেন’ এবার আর একটু কষ্ট করেন  আমার নামডা ছবির নিচে লেইকা দিয়েন  তা নইলে কেউ বুজবো না কার ছবি আঁকলেন। ফরাজির মন্তব্য শুনে কারো মুখে রা নেই। মাত্র দু-চারটি কথার ফরাজি যে মন্তব্য করল  আমাদের পোট্রেট ক্লাসের জন্য তা ছিল সম্পূর্ণ যথাযথ। কারণ, আমাদের পোট্রেট ক্লাস এই প্রথম তেলরঙে এবং রঙ্গিন। কাঁচা হাত, রং আলোছায়া ও ব্রাশিং ঠিক রেখে প্রথম পোট্রেট ক্লাসেই চেহারা মেলানো কষ্টসাধ্যও বটে। মডেলের কাজ করে ফরাজি সারাদিনে পেত দুটাকা। দুটাকা দিয়ে একজনের দুবেলার খাবার কোনোরকমে হয়ে যেত। কিন্তু যেদিন মডেল দিত না সে দিন কোনো টাকাই পেত না। আর্ট ইনষ্টিটিউট যেদিন বন্ধ থাকে ফরাজি সেদিন বেকার। প্রত্যেক দিন ফিগার পেন্টিং বা ড্রইং এর ক্লাসও থাকে না। ফলে প্রতি মাসে বারো তেরো দিন কাজ পেত ফরাজি। ছুটির দিনে প্রথম প্রথম দিনমজুরি বা অন্য কোনো কাজ জুটিয়ে কিছু রোজগার করার চেষ্টা করেছে। রমজানের দীর্ঘ ছুটিতে একবার জয়নুল আবেদিন ও খাজা সাহেব শিল্পী ও শিক্ষক খাজা শফিক আহমদ ওকে কিছু টাকা দিলেন ব্যবসা করার জন্য। বাদামতলী থেকে পাইকারে আম কিনে খুচরো বিক্রি করা। দু-দুবার চেষ্টা করেছে। দুবারই প্রচুর লোকসান দিয়ে মূলধন খেয়ে শেষ। অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন ফরাজির জন্য আর্ট ইনষ্টিটিউটে একটি মডেলের পদ তৈরির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখেছেন। ফরাজিও আশায় আশায় দিন শুনছে  পদটি তৈরি হলেই কাজ থাকুক বা না থাকুক মাসে মাসে সে বেতন পাবে। দেখতে দেখতে অনেক দিন কেটে গেল। আর্ট ইনষ্টিটিউট কলেজে রূপান্তরিত হলো  ইউনিভার্সিটির আর্ট ফ্যাকালটি হলো। অনেক বিভাগ তৈরি হলো, নতুন নতুন পদ তৈরি হলো অনেক। অনেক তরুণ অধ্যাপক যোগ দিল কলেজে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ফরাজির  মডেলের জন্য কোনো পদ তৈরি হলো না। দিনের পর দিন অনাহারে অর্ধাহারে থেকে ফরাজির শরীর ভেঙে পড়েছে  কাজে আর আগের উদ্যোম নেই। দুই আনা চার আনা চেয়েচিন্তে ফরাজির দিন কাটে।  ছাত্রজীবন শেষ করে আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি। ড্রইং ক্লাসে একদিন মডেল দরকার। ফরাজিকে মনে পড়ল। ডেকে পাঠালাম। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ফরাজি আমার সামনে দাঁড়াল। বিষন্ন চেহারা, চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গেছে। শরীরের সবগুলো হাড় চামড়ার আবরণ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। অনেকদিন পর ফরাজিকে এ অবস্থায় দেখে খুব খারাপ লাগল। ফরাজির শরীর একেবারেই ভেঙে পড়েছে, ছাত্রদের ড্রইং শেখার উপযুক্ত ফিগার মোটেই নয়। দেহের তুলনায় মাথা বিরাট, দেখতে একটা বোঝা মনে হয়। শরীর ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। অথচ একদিন, ফরাজির ফিগারের প্রশংসা করত সবাই।  ফরাজিকে দাঁড়িয়ে একটা ভঙ্গি নিতে বললাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো ফরাজি দাঁড়াতে পারবে তো  শরীরের যা অবস্থা! ফরাজি মডেল দিতে দাঁড়াল। ছাত্ররা ড্রইং শুরু করল। বারো মিনিট পর নিয়ম অনুযায়ী ফরাজিকে কয়েক মিনিটের বিশ্রাম দিল। কয়েকজন ছাত্র আমার দিকে এগিয়ে এল। বলল   স্যার, ওকে দিয়ে হবে না, ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না। একবার বাঁদিকে ঝুঁকে পড়ে আবার ডানদিকে   স্যার, অনেকদিন স্কেলিটন এনাটমি স্কাল এসব নিয়ে স্টাডি করেছি আজকে ভাবলাম একটা ভালো ফিগার স্টাডি করব, এতো দেখি আরেকটা স্কেলিটন, ওকে বদলিয়ে দিন স্যার।   আমাদের কঙ্কালটা স্যার ভালো নয়, অনেকগুলো অংশ ভেঙে গেছে। ওটাকে ফেলে দিয়ে বরং ফরাজিকে দিয়েই স্কেলিটনের কাজে লাগানো যাক। একজনের পর একজন অভিযোগ করে যেতে লাগল। ওকে দিয়ে ফিগার স্টাডির ক্লাস চালানো অসম্ভব। তবু ওর প্রতি এ বিদ্রƒপ ও অবহেলা পীড়াদায়ক।  ছাত্রদের বুঝিয়ে বললাম  ওর যা ফিগার  এই রোগা শরীরটাই বিষয় করে কিছু স্টাডি কর। ছাত্ররা তখনকার মতো বিদায় দিল। টিফিন পিরিয়ড শেষ হতেই ফরাজি আমার কাছে হামিদকে নিয়ে হাজির। সুঠাম দেহী হামিদ  নতুন মডেল। ফিগার স্টাডি করার জন্য উপযুক্ত শরীর।  স্যার আমার শরীরটা ভালো নয়  হামিদকে নিয়ে এসেছি। আমার বদলে ও মডেল দেবে। আমাকে এবেলা মাপ করেন। সকালবেলায় সব ঘটনা ফরাজি আড়াল থেকে লক্ষ্য করেছে। ছাত্রদের বিদ্রƒপ ও মন্তব্য নীরবে শুনেছে। কোনো প্রতিবাদ বা অভিযোগ তার নেই। হামিদকে ড্রইং ক্লাসে ঢুকে তৈরি হতে বললাম। ফরাজিকে জিজ্ঞেস করলাম।  তোমার শরীরটা যে খুব খারাপ হয়ে গেছে ফরাজি  ওষুধ পত্তর কিছু খাও? ¤øান হাসে ফরাজি। আমার চোখে চোখ রেখে বলল   আমার একটা আর্জি আছে, রাখবেন স্যার? চোখেমুখে একটা আকুতি লক্ষ্য করলাম ফরাজির। ভাবলাম চিকিৎসার জন্য হয়তো কিছু টাকা চাইবে। কিন্তু ফরাজি সেসব কিছু না চেয়ে বলল   একটা দলিল না উইল বলে, আমাকে লিখে দেন?  সে তো উকিলদের কাজ। তা তোমার কি সম্পত্তি যে উইল করার প্রয়োজন হলো?  হ্যাঁ, আছে স্যার, একটা সম্পত্তিই আমার আছে। এই শরীরটা  শরীরটারে আমি উইল করতে চাই। চমকে উঠলাম আমি। কী বলতে চায় ফরাজি! বুঝলাম খুব দুঃখ পেয়েছে সে আজ সকালবেলার ঘটনায়। সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করলাম।  তোমার শরীর, কাকে উইল করবে? কী আবোল তাবোল বলছ পাগলের মতো। তারচে তোমার শরীরের চিকিৎসা প্রয়োজন।  আমি সত্যি বলছি স্যার, আপনার সাথে ঠাটটা করছি না। আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। আমি মারা যাওয়ার আগে আমার হাড়গোড় এই কঙ্কালটা আর্ট কলেজকে লিখে দিতে চাই। ড্রইং ক্লাসের কঙ্কাল নষ্ট হয়ে গ্যাছে। ছাত্রদের শেখার জন্য একটা ভালো কঙ্কাল দরকার। আমার কঙ্কালটা খারাপ হবে না। আপনি একটা কাগজে উইলটা লিখে দেন, আমি টিপসই দিয়ে দিব। বারান্দার রেলিং ধরে ফরাজি দাঁড়িয়ে রইল  তাকিয়ে আছে মাটির দিকে।  আমার মুখেও কোনো কথা এলো না তখন। ফরাজিকে মনে হলো বিশাল  বিশাল বক্ষ এক সুপুরুষ। ভালোবাসার আধার এ বিশাল বক্ষে যে ধারণ করে আছে আর্ট কলেজ, শিল্পীদের আর তার বড় সাহেব জয়নুল আবেদিন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে ফরাজি যেমন ভালোবাসত তেমনি ভয়ও করত। পারতপক্ষে তাঁর সামনাসামনি হতো না। কথা প্রসঙ্গে সে প্রায়ই বলত বড় সাহেব আমাকে বাঁচিয়েছেন। তিনি আমারে আর্ট কলেজে না আনলে আমি যে কোথায় থাকতাম। ফরাজিকে তখন আমি বলি   ফরাজি, মডেল দিয়ে তো তোমার খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো চলে না। অন্য কোনো কাজের চেষ্টা করলেও তো পারো।  তা হয়তো পারি। বড় সাহেব ও খাজা স্যার আমাকে অনেক টাকাও দিয়েছিলেন ব্যবসা করার জন্য। আপনাকে চুপচাপ বলছি স্যার, আমি ইচ্ছা করেই ব্যবসায় ফেল মেরেছি। স্যারদের বলেছি লোকসান হয়ে গ্যাছে। স্যারেরাও বুঝলেন আমাকে দিয়ে ব্যবসা ট্যাবসা কিছুতেই হবে না। আর আমি আর্ট কলেজ কিছুতেই ছাড়তে পারব না। তাই ইচ্ছে করেই অন্য কোনো কাজে যাই না। যদি সেসব কাজে টাকা পয়সার আমদানি দেখে আমার লোভ বেড়ে যায়  তাহলে যে আর্ট কলেজ ছাড়তে হবে।  কিন্তু টাকা পয়সা তো দরকার। তুমি যে এর কাছে ওর কাছে টাকা পয়সা চেয়ে নাও, সেটা কি খুব ভালো? আর তোমার মেয়েটা বড় হয়েছে  তার বিয়ে দিতে হবে না? এসব প্রসঙ্গ উঠলে ফরাজির মুখটা বিষন্নতায় ভরে যায়। পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বলে  বড় সাহেব আমার জন্য খুব চেষ্টা করছেন। মডেলের পদ তৈরি হলেই আমার আর চিন্তা থাকবে না। আপনাদের সব টাকা আমি শোধ করে দেব। ফরাজিকে আর ড্রইং ক্লাসে কেউ ডাকে না। কলেজে তখন অনেক মডেল। তাকে কলেজে খুব একটা দেখাও যায় না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি  খুবই অসুস্থ। কখনো শুনি স্টোরে, কখনো গ্যালারি রুমের পেছনে অন্ধকার খালি ঘরটায় শুয়ে আছে। কিছুদিন পর সেই অন্ধকার খালি ঘর থেকে তিনদিনের পচা ফরাজির লাশ বের করা হলো। কবে মরে পড়েছিল। কেউ জানে না। দুর্গন্ধ পেয়ে দরজা ভেঙে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। লাশ পরে মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দুপুরে শোকসভা ডাকা হলো কলেজ প্রাঙ্গণে লিচুতলায়। শোকসভায় যাইনি। অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। শিক্ষক গ্যালারির দরজা খোলা পেয়ে সেখানে ঢুকে পড়ি। দেয়ালে ঝুলানো অনেক ছবি  আর্ট কলেজের শিক্ষকদের  নামকরা শিল্পীদের। অনেকগুলো ক্যানভাসে  ফরাজি। হাসছে, কথা বলছে, ফল বিক্রি করছে, একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। ইচ্ছে হলো চিৎকার করে বলি কে বলে ফরাজি মারা গেছে  ফরাজি তো আমার সঙ্গেই রয়েছে এ গ্যালারিতে। অনেকদিন হয়েছে ফরাজি মারা গিয়েছে। আর্ট কলেজের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করে পেশোয়ারে আছেন। ইতোমধ্যে একটি নয়, তিন তিনটি পদ হয়েছে মডেলের। এছাড়াও চুক্তিভিত্তিতে আছে কয়েকজন মডেল। তাদের মজুরিও আগের তুলনায় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকদিন পর ড্রইং ক্লাস নিচ্ছি। ঘুরে ঘুরে ছাত্রদের ড্রইং দেখছি। এনাটমি স্টাডির জন্য এক কোনায় ঝুলছে কঙ্কাল। আমার গায়ে ধাক্কা লেগে নড়ে উঠল কঙ্কালটা। হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে খড়খড়ে আওয়াজ হলো। তাকালাম কঙ্কালের দিকে  সম্পূর্ণ নতুন কঙ্কাল  পুরনোটা নয়। হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। খড়খড়ে আওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসছে একটি অতি চেনা গলার স্বর   কেমন আছেন স্যার! আমি চারুকলাতেই আছি। রচনাকাল: এপ্রিল ১৯৭৭