Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ভিউ-দৌড়ে টিভি নাটকের সর্বনাশ হচ্ছে!

রেজানুর রহমান

একটা কথা তো সবাই মানবেন স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কঠিন তার চেয়েও বেশী কঠিন স্বাধীনতা রক্ষা করা। সেলফ সেন্সরশীপ বলে একটা কথা আছে। দেশ আর সমাজের প্রতি যদি কারও দায়বদ্ধতা থাকে তাহলে তাকে বলে দিতে হয় না কোনটা শোভন কোনটা শোভন নয়। ঈদের একটি নাটকের ভাষা নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। একজন মা ফেসবুকে এই নাটকের একটি সংলাপ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করায় সংশ্লিষ্টদের অনেকেই নড়ে চড়ে বসেছেন। দর্শকদের মধ্যেও প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, ওই মা যদি প্রতিবাদ না করতেন তাহলে কী নাটকটি নিয়ে এতো প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। আমরা সংশ্লিষ্টরা মানি বা না মানি কথা তো সত্য যে, এখন টিভি নাটক বানানোই সব চেয়ে সহজ কাজ। কারণ কার্যত আমাদের এই অঙ্গনটিতে গেটওয়ে বলে কিছু নেই। অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছি। নাটকের ভিউ’ চাই তাই অনেকে যা খুশি তাই লিখছেন, নির্মাতাদের অনেকে ভিউ’ বাড়ানোর উদ্দেশে নাট্যকারের লেখার বাইরেও শব্দ অথবা দৃশ্য জুড়ে দিচ্ছেন। একটাই উদ্দেশ্য, যে কোনো মূল্যে নাটক, টেলিফিল্ম এর ভিউ বাড়ানো। যার পরিনতিতে আজকের এই অবস্থা! অভিনয় শিল্পী সংঘ একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ঘটনা সত্য’ নাটকের মূল স্ক্রীপ্টে আলোচিত সংলাপটি ছিল না। কোন পাত্র-পাত্রীর মুখ দিয়ে সংলাপটি প্রকাশ হয়নি। নাটকের শেষে ভয়েস ওভারের মাধ্যমে আপত্তিকর বক্তব্যটি জুড়ে দেয়া হয়েছে। কাজেই এক্ষেত্রে নাটকটিতে যারা অভিনয় করেছেন তাদের কোন দায় আছে বলে মনে হয় না। এর সম্পুর্ন দায়ভার পরিচালক ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক আবু সায়ীদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, অভিনয় শিল্পী সংঘের বিবৃতি দেখে মনে হল এরা সানগ্লাস পড়ে লেখাপড়া করেন। ঘটনা সত্য নাটকে মা চরিত্রে রুপদানকারী অভিনেত্রী বলেছে, এ আমার পাপের ফসল। ডাক্তারের কাছ থেকে তাদের প্রতিবন্ধী সন্তান হচ্ছে শোনার পরে যেভাবে কান্নাকাটি করেছে, যেন মৃত সন্তান হয়েছে। অথচ বিবৃতিতে অভিনেতা-অভিনেত্রীর পক্ষ নেয়া হয়েছে। হাস্যকর বিবৃতি রে বাবা… এর চেয়ে বিবৃতি না দিলেই ভালো করতেন।
অভিনয় শিল্পী সংঘের বিবৃতি নিয়ে কোনো মন্তব্য চাই না। শুধু একটি প্রশ্ন রাখতে চাই নাটকের সংলাপ অথবা নাটকের ভাষা নিয়ে যে অভিযোগ শুরু হয়েছে তা কি আজকের? বহুদিন ধরেই তো টিভি নাটকের ভাষা ও আপত্তিকর দৃশ্য নিয়ে কথা হচ্ছে। সম্মানীত অভিনেতা অভিনেত্রীরাই তো নাটকের ভাষা ফুটিয়ে তোলেন। কই এর আগে তো কাউকে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। বরং দেখেও না দেখার ভান করেছেন কেউ কেউ। আবার আপত্তিকর কুরুচিপুর্ণ সংলাপকেই অনেকে উৎসাহিত করেছেন। বলেছেন বাহ! বাহ! বেশ! বেশ! চালিয়ে যাও গুরু! একটি নাটকের সংলাপ তুলে ধরতে চাই আপনাদের সামনে। নায়ক-নায়িকা মুখোমুখি দাঁড়ানো। লুকিয়ে প্রেম করতে এসেছে। নায়কের পায়ের পাতায় ভর দিয়ে নায়িকা দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সে নায়ককে ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে এই ভাবে কেউ টিপে? তুমি তো দেখি টিপতেও জানো না?
নায়কের উত্তর আমার কি টেপাটেপির অভিজ্ঞতা আছে নাকি?
নায়িকার উত্তর এখনও টিপতেই শিখলা না। তোমারে দিয়া কিচ্ছু হবে না!
নাটকের এই যে সংলাপ তা চরম অশ্লীলতাকেও হার মানায়। অথচ এনিয়ে কোনো দিন কেউ কথা বলেনি। বরং উৎসাহ দিয়েছে। ইউটিউবে নাটকের এই দৃশ্যটুকুর ভিউ অনেক বেশি। আপত্তিকর, কুরুচিপুর্ন সংলাপ থাকলেই নাকি নাটকের ভিউ বাড়ে। আর তাই ভিউ বাড়ানোর সংগ্রামে অশ্লীল শব্দ ও ভাড়ামো অভিনয়ের প্রতি জোর দিচ্ছেন দেশের অনেক নাট্য পরিচালক। অন্যদিকে বদনাম হচ্ছে নিবেদিত প্রাণ সৃজনশীল ধারার নাট্য কর্মী, নাট্যকার, পরিচালকদের। কিন্তু তারা মোটেই সোচ্চার নয় বলেই দেশের টিভি নাটক দিনে দিনে অশ্লীল সিনেমার কাতারে দাঁড়াচ্ছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, অনুকরণ ও অশ্লীলতার দায়ে দেশের সিনেমা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। একই অভিযোগে দেশের টেলিভিশন নাটকের প্রতিও দেশের দর্শকদের অবস্থা চলে যাবে। এটা শুধু সময়ে ব্যাপার।
অথচ টেলিভিশন নাটকই আমাদের সংস্কৃতির সবচেয়ে মর্যাদাবান ও বেগবান ধারা। টেলিভিশন নাটক নিয়ে আমাদের অনেক অহংকার। অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশের কারণে দেশের টেলিভিশন নাটক নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে অন্যান্য সব ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার দরকার হলেও টিভি নাটকে যোগ্যতার কোনো দরকার হয় না। বিশেষ করে নির্মাতা হতে গেলে কোনো যোগ্যতারই প্রযোজন নাই। কারণ এটা দেখার কেউ নাই। ফলে আজ যার ইচ্ছে হল কালই সে পরিচালক হয়ে গেল। যে কোনো মূল্যে জনপ্রিয় ধারার কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ম্যানেজ করতে পারাটাই এখন নাকি পরিচালকের যোগ্যতা। এমনও শোনা যায়, অনেক সেটে কোনো পরিচালককে নাকি অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরই কেউ কেউ ডিকটেট করেন। কেউ কেউ তো ক্যামেরা পারসনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে নাটক বানান। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।
আশার কথা ‘ঘটনা সত্য’ নাটক নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় টিভি নাটক সংশ্লিষ্ট সংগঠন গুলোর কর্তা ব্যক্তিরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম ক্ষোভের সঙ্গেই বলেছেন, একটা সময় টেলিভিশনে প্রচারের আগে প্রিভিউ কমিটি নাটক দেখতো। বিটিভি ছাড়া অধিকাংশ টিভি চ্যানেলে সেই অর্থে কোনো প্রিভিউ কমিটি নাই। নাটক গুলো এখন নামকাওয়াস্তে টেলিভিশনে প্রচার হয়। তারপর ইউটিউব বা অন্যান্য প্লাটফর্মে চলে যায়। তাই এই সব নাটকের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট টেলিভিশন চ্যানেলের কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না। ইউটিউব বা অন্যান্য প্লাটফর্মে তো দেখার কেউ নেই। বর্তমান সময়ে অনেক পরিচালকই ভাবেন না নাটকে কতটুকু বলা যাবে কতটুকু বলা যাবে না। সমস্যাটা কিন্তু এভাবেই তৈরি হচ্ছে।
ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি বিশিষ্ট অভিনেতা সালাহউদ্দিন লাভলু বললেন, এখন মূলত যে প্রক্রিয়ায় নাটক নির্মাণ হচ্ছে সেটা সঠিক প্রক্রিয়া না। অনেক টিভি চ্যানেল বিভিন্ন এজেন্সির কাছে ‘চাঙ্ক’ বিক্রি করেছে। তাই নাটকের প্রিভিউ করার সুযোগ থাকে না। লাভলু বলেন, একজন নির্মাতার উচিৎ নাটক বানানোর সময় সেলফ সেন্সরশীপ, সমাজের প্রতি দায় এবং দেশের কথা ভাবা। যারা নাটকে অভিনয় করেন তাদেরও উচিৎ নাটকের অসঙ্গতি নিয়ে পরিচালকের সাথে কথা বলা।
সবই ভালো কথা। কিন্তু মানছে কে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্ভবত মিজোরামের রাস্তার একটি ছবি দেখলাম। একটি রাস্তায় বাম দিকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে চালক সহ মটর সাইকেলের সারী। অন্য পাশে পুরোটাই ফাঁকা। ছবির নীচে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, এটাকেই বলে ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা। ইচ্ছে করলেই মটর সাইকেল গুলো ডান পাশের লেনে ঢুকতে পারত। কিন্তু ঢুকবে না। কারণ এটাই তাদের কাছে আইন।
আমাদের দেশে কি এই মানসিকতা হবে কারও? বরং চলছে আইন ভাঙ্গার প্রবনতা! যে যত আইন ভাঙ্গে সে তত জনপ্রিয়। সেখানে নাটকের মানুষ তো আইন ভাঙ্গবেই। নাটক তো নাটকই…

লেখক-সম্পাদক, আনন্দ আলো