Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আর নয় আরমান ভাই!

আরফান আহমেদ

মামুনুর রহমান

সেই ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন অভিনেতা হবেন। মাঝে স্বপ্ন গুলো ডানে বামে ডালপালা মেলেছিলো। তবে শেষ পর্যন্ত অভিনেতা হলেন আরফান আহমেদ। অভিনয়ে আসার আগে একবার ভেবেছিলেন সিকিউরিটি গার্ড হবেন। সবাই তার সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। প্রশ্ন করে সঠিক উত্তর না পেলে তাকে থামিয়ে দিবেন। একবার ভেবেছিলেন ট্রাফিক পুলিশ হবেন। সবাই ট্রাফিক পুলিশকে ভয় পায়। এক হাতের ইশারায় শত শত গাড়ি থেমে যায়। ছেলেবেলায় যা হয় আর কি। মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়ায় জন্ম নেয়া আরফান আহমেদ লেখাপড়া করেছেন নারায়নঞ্জের মিশনারী স্কুলে। সেখানে এসেই স্বপ্ন স্থির হয়। অভিনেতা হবেন। নায়ক হবেন। অভিনয় তাকে শিখতেই হবে। এসএসসি পরীক্ষা শেষ। ১৯৯২ সাল। সোহরাওয়ার্দী কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ছিলেন। তার মামা একটি ফিল্ম অফিসের সাথে জড়িত ছিলেন। তার কাছেই অভিনয় নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি তাকে প্রয়াত অসীম সেন গুপ্তের কাছে নিয়ে যান। শান্তিনগরে ছোট্ট একটি অফিস। সেখান থেকেই মূলত অভিনয়ের যাত্রা শুরু হয় আরফান আহমেদের। তবে পর্দায় আসতে সময় লেগেছিল আরও দুই বছর। এবারের ঈদে যখন তাকে জানানো হলো ভাই আপনি আর জাহিদ ভাই যে ধরনের কাজ করেন তেমন নাটক ধরেন সিড়ির নিচে বিড়ির দোকান টাইপের নাটক। তিনি জানান একই চরিত্রে আর নয়। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবারের ঈদে অভিনয় করবেন না। তিনি আরও জানালেন, আমি ভেতর থেকে এই অনশন টুকু চালিয়ে নিতে চাই। আমাকে এই ধারার নাটক থেকে বেরিয়ে আসাতেই হবে। হলে হবে না হলে নাই। ফিরে আসবো নাটকের জগৎ থেকে।
আনন্দ আলো: অভিনয় জীবনে আইডল হিসেবে কাদের নাম বলবেন।
আরফান আহমেদ: অনেকেই আছেন, হুমায়ূন ফরীদি, নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকী। আমি ভীষন কষ্ট করে এখানে এসেছি। স্যুটিংয়ে পানির বোতল নিয়ে আমাকে কটাক্ষ শুনতে হয়েছে। দেখা গেল একই জায়গায় খেতে বসেছি বিশেষ খাবার রান্না করা হয়েছে চিংড়ি। অথচও আমি নতুন বলে আমাকে চিংড়ি দেয়া হয়নি। চাইলেও বলেছে চিংড়ি নাই। জিলাপী আর শিঙারা প্লেটে দেয়া হয়েছে আমার মনে হয়েছিল জিলাপী বাদ দিয়ে আরেকটা শিঙারা নেই। চাইলাম আমাকে না করে দেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এমন হয়েছে আমি মুখ ফুটে চাইলেও আমাকে শুনতে হয়েছে ধুরও মিয়া খান তো জ্বালাইয়েন না। বলতে পারেন সেসব কটাক্ষ পার করে আজকের আমি।

আনন্দ আলো: আপনার অভিনয় জীবনে অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানত চাই।
আরফান আহমেদ: আমার মেজ বোন শিউলি আফসার। তিনি আমাকে সাহস দিতেন, উৎসাহ দিতেন। স্বপ্ন দেখাতেন। বাড়ির অন্য সদস্যরা আমাকে নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকলেও মেজ আপা আমাকে নিয়ে আশাবাদি থাকতেন। আব্বা কোন ভাবেই চাইতেন না আমি নাটক করি। নাটকের ভবিষ্যৎ কি? নাটক না টাকা দেবে না ভবিষ্যৎ দেবে! এমন অসংখ্য কথা শুনেছি। আমার মতো করে অনেকেই হয়তো এমন শব্দ গুলো নাও শুনতে পারে। মাতুয়াইল কোনাবাড়ি থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের গেইটে এসে দাঁড়িয়ে থাকা আর পরিচয় তৈরি করা ছিলো সে সময়ে প্রধান কাজ। আমি দীর্ঘ দিন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। একসময় এক চাওয়ালার সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার। ওনার নাম মতিন মিয়া। তিনি আমাকে বলেন জনসংখ্যা বিষয়ক ৫ মিনিটের নাটিকা হয় আপনি অভিনয় করবেন! আমি যেন আকাশ হাতে পাই। রাজী হয়ে গেলাম। বিটিভির ভিতরে প্রবেশ করলাম। সে সময় শামসুদ্দোহা তালুকদার, আলাউদ্দিন আহমেদ, আমার জন্য অসম্ভব সহায়তা করেছেন। প্রথম নাটকের অভিনয় ভিষন নার্ভাস আমি। অভিনয় ভালো হয়নি। পরিচালক আমার সামনে এসে বলেনÑ কি করলেন, কিছুই হয়নি। আপনি তো ডুবায়া দিলেন। আমাকে জনসংখ্যা সাইউ থেকে বলা হলো আপনি নাকি ভালো অভিনয় পারেন! সম্পাদক সালেহ্ বলেছিল আপনি ভালো অভিনয় করেন। ধূর…
নাটকটি অনএয়ারে যেদিন এলো আমিও দেখেছিলাম। জানতাম কেউ ভালো বলবে না। আসলেই ভালো হয়নি। তারপও আশা ছাড়িনি। আবার গেছি বিটিভিতে। নাটকটির নাম ছিলো পুরুস্কার। বাজে অভিনয় করেছি এরই মধ্যে বিটিভির সবাই জেনে ফেলেছে বিষয়টি। প্রতিদিন যাই, পরিচালকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। তিনি পান চিবান আর আমাকে দেখেন। কিছুই বলেন না। আমি ফিরে যাই। এভাবে সপ্তাহ খানেক পেরিয়ে যায়। আমি তাঁর কাছে শেষবারের মতো একটি সুযোগ চাই। পরিচালক সাহেব বললেনÑ আপনাকে তো একবার সুযোগ দেয়া হলো। কিছুই করতে পারেন নাই। আমি উত্তরে বলেছিলাম এবার দেন আমি পারবোই। উত্তরে শুনেছিলামÑ দ্যাখেন ভাই এইসব আধ্যাত্বিক কথাবার্তা বলবেন না। আমি সালেহ ভাই এর কাছে যাই। সালেহ ভাই বলেন, আপনার আগের কাজটি ভালো করেন নাই। দেখি কি করা যায়। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার জার্নি বোধ হয় শেষের দিকে। সেদিন বিটিভির গেইটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। পরিচালক সাহেব বাড়ি ফিরছিলেন। রাত তখন বারোটা পেরিয়েছে। তিনি আমাকে দেখে দাঁড়ালেন। আপনি এখনো এখানে? বাড়ি ফিরবেন কি করে। আর কেন দাঁড়িয়ে আছেন? উত্তরে বললামÑ আপনার সাথে দেখা করার জন্য। কাষ্টিং নিশ্চয়ই আজকালের মধ্যে চূড়ান্ত করবেন তাই ভাবলাম একবার শেষ সুযোগ চাই। আমার কথার উত্তরে তিনি বললেন ফাইজলামির আর জায়গা পান না। যান তো ভাই বাড়ি যান।
ভীষন কষ্ট নিয়ে রামপুরা থেকে একটি টেম্পু করে মালিবাগ, সেখান থেকে সায়দাবাদ। সায়দাবাদে একটি স্কুটার পেলাম তখন রাত ২টা পেরিয়েছে। রাত তিনটার পর মাতুয়াইল। পুরো রাস্তায় ভীষন মন খারাপ ছিলো আমার। মাতুয়াইল কোনাপাড়ার আগেই নেমে বাসার বাইরে রাত পার করলাম। সকালে বাসায় ঢুকলাম। যতটুকু বকা শোনার শুনলাম। সেদিন সারাদিন ঘুমিয়েই কাটালাম। সন্ধ্যার আগে একটা টেলিফোন আসে আমাদের বাসায়। রিসিভ করি ওপারে টেলিভিশনের আতিয়ার ভাই। আমাকে জানানো হলো পরিচালক আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। আপনি আসেন। আমি গেলাম। পরিচালকের সামনে দাঁড়িয়েছি। তিনি আতিয়ার রহমান সাহেবকে বললেন, আমি জানি না উনি কেমন অভিনয় করবেন, দুই সপ্তাহেরও বেশি তিনি খুব ঘুরেছেন, এখানে চৌদ্দটি দৃশ্য আছে ওনার, বুঝিয়ে দেন। আমাকে বললেন বিটিভির নিবন্ধিত শিল্পী তালিকায় আপনার নাম নেই। আমি ভীষন সাহসী মানুষ। খারাপ করলে অন্তত আপনাকে বাদ দেয়ার সময় আমার ভালো লাগবে। স্ক্রীপ্ট হাতে পাওয়ার পর দেখি চৌদ্দটিরও বেশি দৃশ্য। মাথায় বেশি চাপ না নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে অভিনয় করলাম। বাদ তো হয়েই যাবো জানি, তাই হারাবার যেহেতু কিছুই নেই! ‘পাথর কুঁচি’ নামের সেই নাটকটিতে আমার অভিনয়ে তারা মুগ্ধ হলেন। পরিচালক আমাকে ডাকলেন। গম্ভীর মুখ নিয়েই বললেন তৈরি হন এবারের নাটকে আপনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করবেন। ভালো অভিনয় করেছি বলেই তার পরের নাটকে আমি নায়কের রোল করবো। এর পরের মাসে আলাউদ্দিন আহমেদ তাঁর একটি নাটকে আমাকে কাষ্ট করলেন। তাঁর একটি ধারাবাহিকের জন্য। তবে আমাকে অডিশন দিতে হয়েছিল তাঁর সেই ধারবাহিকের জন্য। ৯৬ সালের শেষের দিকের কথা। বিচারক প্যানেলে আতিকুল হক চৌধুরী, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ স্যার, কামালউদ্দিন নিলু। চার হাজার জন অডিশন দিয়েছিলো। ১৭৭ জনকে নেয়া হলো। সেখানে আমিও একজন। তার মধ্য থেকে।

আনন্দ আলো: ঈদুল আযহার নাটকে সেভাবে নেই আপনি। কারণ কি?
আরফান আহমেদ: কিছু দিন আগে আমি অনেক বেশি অসুস্থ ছিলাম। এজন্য অবশ্য আমিই দায়ী। বিগত বছর গুলোতে নিজের প্রতি যত্ন নেইনি। কাজ করতে করতে শরীর যে এক সময় জানান দেয় তা ভুলেই গেছিলাম। শরীর নিতে পারছিলো না। তাই একটু বিরতি নেয়া। যাতে শরীর আগের মতো স্বাভাবিক হয়। বিছানায় পড়ে যাওয়া এই বয়সে! ভীষন ভেঙে পড়েছিলো আমার পরিবার। সুস্থ হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এবারের ঈদে নাটক করবো না। বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশি টাকার তো দরকার নেই। আমার স্ত্রী আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল খুব বেশি অর্থ তুমি কিন্তু পাওনা। যদি নাটক না করো পরিবারের সামনের দিন গুলো কিভাবে চলবে! চারপাশের মানুষ গুলোকে কিভাবে দেখবে? গত ঈদে আমি ছয়টি সাত পর্বের কাজ করেছি তিনটি টেলিছবি করেছি, তিনটি সিঙ্গেলে নাটক করেছি। অথচও যখন দর্শক জরিপ করলাম তখন পেলামÑ কেউ একজন অনেকক্ষণ ভেবে বললো একটা কাজ দেখেছিলাম বোধ হয়। পনেরো দিন একমাস পরে শুনলাম চার পাঁচটি কাজ দেখলাম। ভালো। অর্থাৎ টেলিভিশন অনএয়ারে কেউ নাটক দেখছে না। দেখছে কোথায় ইউটিউব, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। আমাকে ভিউ বাড়াতে হবে। ভিউ না বাড়ালে নাটকের লাভ হচ্ছে না।
আনন্দ আলো: জাহিদ হাসান এবং আপনার রসায়ন নিয়ে বলুন?
আরফান আহমেদ: জাহিদ হাসান আমার জীবনে একটি অর্জন। একজন জাহিদ হাসান কয়েক যুগ পরে একবারই আসে। আমাদের নাটকের জগতের মানুষদের দূর্ভাগ্য আমরা জাহিদ হাসানকে ব্যবহার করতে পারি নাই। সময়ের প্রয়োজনে আমাদের এই গুণি শিল্পীকে দিয়ে অনেকেই দূর্বল কাজ করিয়েছেন। এতে জাহিদ হাসান দায়ী নন। দায়ী সে সকল পরিচালক ও প্রযোজকেরা। ইন্ডাস্ট্রির মানুষেরা জাহিদ হাসানকে একটা জায়গায় এনে থামিয়ে রেখেছেন। জাহিদ হাসান যে চাচ্ছেন না একই চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসতে তা কিন্তু নয়। একই চরিত্রে কতদিন ভালো লাগবে আপনার? দেখতে দেখতে তো বোঝা হয়ে যায় চরিত্রটি কি বলতে চায়। জাহিদ হাসানের সাথে আমার জার্নি শুরু হয় আরমান ভাই নাটক থেকে। সেখানে খুব ভারী চরিত্রে আমি ছিলাম তাও না। তবে জাহিদ হাসান আমাকে চমৎকার ভাবে গ্রহণ করেছিলেন। শিশু মন বিরাজ করে তার ভেতরে। হুট করে রাগেন, আবার খানিক বাদেই স্বাভাবিক। এই জাহিদ হাসান আমাকে ভীষন স্নেহ করেন। পথ দেখিয়ে দেন। তিনি আমার বড় ভাইয়ের মতোই। এখন একটি সময় এসেছে যখন মানুষ বলে জাহিদ হাসান ও আরফান একটি পার্ট। কিন্তু আমি বলি জাহিদ হাসানের পার্ট হওয়া উচিৎ আরেকজন জাহিদ হাসান। তবে জাহিদ হাসানের মতো আমিও চাই আমাদের চরিত্রে পরিবর্তন আসুক।
আনন্দ আলো: আপনার স্বপ্নের চরিত্র সম্পর্কে বলুন।
আরফান আহমেদ: অসংখ্য চরিত্র আছে যেগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই। বিটিভিতে নাটক করার সময় আমি খেয়াল করেছি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যবহার। শুদ্ধ উচ্চারণ অথচও এখনকার নাটকে শুদ্ধ উচ্চারণ কম। আমাকে যে চরিত্র গুলো দেয়া হয় এখন তা কিন্তু কিছুটা সময় ভালো লাগে। আমি চরিত্র গুলো করেছি জীবন ও জীবিকার স্বার্থে। সময়ের চাহিদায় টিকে থাকার জন্য করেছি। তবে এখন সময় এসেছে কথা বলার। আমি রীতিমতো বিরক্ত এই একই রকম চরিত্রে অভিনয় করতে করতে। একদিনের কাজ হাফ বেলায়, দুই দিনের কাজ একদিনে, চার দিনের কাজ দুই দিনে করতে হবে এভাবে আমি অভিনয় করতে চাই না। আমাকে বলা হয় আপনি আগের মতো করে বলেন না হলে ভিউ আসবে না। মানুষ দেখবে না, আমি এভাবে কাজ করতে চাই না। ইউটিউব গরম করা অভিনয় তো আমি শিখিনি। আমার একাডেমিক ক্যারিয়ার ছিলো না তবে আমি অনেক পুড়ে পুড়ে আজকের পর্যায়ে পর্যন্ত এসেছি। আর আরমান ভাই নয়। নিজেকে একটু বদলাতে চাই।