সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
মামুনুর রহমান
আমি তখন থিয়েটারে একটু একটু করে পরিচিত হতে শুরু করেছি। মঞ্চের দর্শকদের কাছে খানিক জনপ্রিয় হয়ে উঠছি। আমার অভিনয় নিয়ে সামনে পেছনে ভালো মন্দ সমালোচনা করতে অনেককেই দেখছি। ভেতর থেকে সাহস পাচ্ছি আমাকে দিয়ে অভিনয় হবে। এমনি সময় জনপ্রিয় একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতার ফোন কল আসে। পরিচালকের নামটি বলতে চাইছি না। আমাকে জানানো হলো টেলিভিশনের জন্য একটি বিজ্ঞাপন চিত্রে মডেল হতে চাই কি না? স্বাভাবিক ভাবেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি রকম বিজ্ঞাপন? মানে কিসের? আমাকে বলা হলো বিজ্ঞাপনের আইডিয়া আপাতত জানানো হবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম কষ্টিউম কেমন? জানালো স্যুটেড বুটেড। আর শেরাটন হোটেলে বিকেলের পরে আসলেই হবে। তিনি এও জানালেন খুব বড় বাজেটের কাজ।
মঞ্চে অভিনয় করছি। মডেল হবার সুযোগ পেলাম ভালো লাগছিল ভীষন। আমার খুব কাছের এক বন্ধুকেও জানালাম বিষয়টি। সেও আমার সাথে যেতে রাজি হয়ে গেল। শেরাটনের পাশে পিজি কোয়ার্টারে আমাদের বাসা ছিল। অনেক আগ্রহ এবং স্বপ্ন নিয়ে আমরা দুই বন্ধু যাই হোটেল শেরাটনে। মনে আছে, বিকেল ৫টা নাগাদ আমরা পৌছাই শেরাটনে। আমাদেরকে বসতে দেয়া হলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। কেউ নেই আশে পাশে। মানে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের কথা বলছি। ভীষন আগ্রহে ঠিক মতো দুপুরে খাওয়া হয়নি। তাই দুই বন্ধু হোটেলের খাবার কিনে খেলাম।। ভালোই লাগছে। শুনতে পেলাম খানিকবাদেই বিখ্যাত সেই বিজ্ঞাপন নির্মাতা আসছেন। তারপরই আলাপচারিতা শেষ হবে। অপেক্ষা করেই যাচ্ছি আমরা। রাত দশটা পেরিয়েছে তখনও নির্মাতার দেখা নেই। এবারে অবশ্য আমরা দুই বন্ধু খানিক বিরক্ত। শেরাটন ঘুরে দেখেছি অনেকবার। সেদিন কেন জানি আবারও দেখতে মন চাইলো। রাত তখন বারোটা পেরিয়েছে। ক্ষুধা পেয়েছে দুজনেরই। কি আর করা। আবারও কিছু একটা খেয়ে ক্ষুধা নিবারনের চেষ্টা। রাত তখন ১টার কাছাকাছি। বিখ্যাত সেই নির্মাতা এলেন। আর ততক্ষণে মডেলদের সংখ্যা প্রায় দুই শত পেরিয়েছে। উপরে বসার জায়গা নাই তাই আমরা নিচে চলে আসি। দ্টুার দিকে আমরা প্রায় দুইশত মানুষেরও বেশি। বিজ্ঞাপন নির্মাতা সবাইকে দাঁড় করিয়ে পরখ করলেন। খুব সুন্দর চেহারার তিনজনকে বেছে নিলেন। তারপর তার সহকারি সবাইকে চলে যেতে বললেন। আমরা দুই বন্ধু সেই সুন্দর তিনজনের মধ্যে ছিলাম না। বিকেল ৫টা থেকে রাত তখন আড়াইটা! নিজের উপর ভীষন রাগ হলো। আর ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগছিল আমার সাথে আনা প্রিয় বন্ধুটির জন্য। আমাকে ডাকা হয়েছিল কিন্তু তাকে তো আমি ডেকে রীতিমত কষ্ট দিলাম। ফিরে আসার সময় যেখানে আমি দুঃখ প্রকাশ করার কথা। সেখানে আমার বন্ধুটিই বলা শুরু করল, বাদ দে এর থেকে আরও কতো বড় বড় কাজ আসবে!
বন্ধুর সেই কথা সত্যি হয়েছে। সেদিনের তীব্র অবজ্ঞা পাওয়া শ্যামল আজ পরিণত একজন অভিনেতা। এখন তাকে কেউ শ্যামল বলে ডাকে না। ডাকে শ্যামল মাওলা নামে। সময়ের জনপ্রিয় একজন অভিনেতা হিসেবে তার প্রশংসার ডাল পালা এখন অনেক প্রশস্ত। আনন্দ আলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন সময়ের গুণি অভিনয় তারকা। রাতারাতি নয়, বেশ যুদ্ধ করে অর্জন করেছেন আজকের অবস্থান। সে বিষয়েই কথা হয় তাঁর সাথে। প্রিয় পাঠক চলুন জানার চেষ্টা করি শ্যামল মাওলার সেকাল একাল।
পিজি হাসপাতালের স্টাফ কোয়ার্টারে তাঁর বেড়ে ওঠা। সে সময়ের ঢাকা ছিল বেশ খোলামেলা। বাড়ির চারদিকে শুধু মাঠ। খেলতে ভীষণ ভালো লাগত। এখনো সুযোগ পেলেই শ্যামল খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ওদের একটা ক্লাবও ছিলো। ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট, দুই খেলায় ব্যাপক পারদর্শী শ্যামল। দিন তারিখ মনে করতে না পারলেও মানিকগঞ্জের মাঠের একটি খেলার কথা বেশ মনে পড়ে শ্যামল মাওলার। নিজে নিজে ভাবেন অনেক সময়। বন্ধুরা না জানিয়ে মানে ম্যামল মাওলাকে বাদেই চলে যায় মানিকগঞ্জে। কারণ শ্যামল তখন থেকেই হায়ারে খেলতো। তাকে নিতে হলে আলাদা খরচ গুনতে হবে। টিএনটি ফোনে একটা কল আসে। চাওয়া হয় শ্যামল মাওলাকে। তখনই শ্যামল জানতে পারেন বন্ধুরা তাকে না জানিয়ে মানিকগঞ্জে অবস্থান করছে এবং সেদিনের একটি ম্যাচ হেরেও গেছে তারা। বন্ধুর অনুরোধ প্রথমে রাখতে রাজি না হলেও সে রাতেই মানিকগঞ্জ চলে যান তিনি। পরদিন ম্যাচ। শুধু ম্যাচ জয় করা নয়, মানিকগঞ্জের সেদিনের সেই খেলঅ দেখা দর্শকদের মনে মাঝে স্থান করে নেন তিনি। প্রতিদ্বন্দী মানিকগঞ্জ ক্লাব হেরে যায়। তবে ফলে শ্যামল মাওলাকে নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যায়। এরপর থেকে যে কোন টুর্নামেন্ট হলেই ডাক আসতো তার। জীবনে চরম ভাবে সেদিন গুলো হাতড়ে বেড়ান শ্যামল। আমরা জানতে চেয়েছিলাম, এখনো খুব মনে পড়ে নিজের জীবনের কোন সময়টি। উত্তরে এভাবেই বেশ নষ্টালজিক হয়ে যান তিনি।
আনন্দ আলো: ছোটপর্দা, বড়পর্দা, ওয়েব সব মাধ্যমেই তুমুল প্রশংসা আপনার, কেমন লাগছে?
শ্যামল মাওলা: খুব, খুব ভালো লাগছে। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছি। নিজেকে ভাঙছি, গড়ছি। একেক সময় একে চরিত্রে কাজ করেছি। কিন্তু কেন যেন মনের ক্ষুধা মিটছিলো না। মন চাইছিলো আরও কিছু, আরও কিছু। ছোটপর্দায়, বড়পর্দায় এখন ওয়েবে। ওয়েবের বাজেট, নির্মাণ, বিশ্ব বাজারে কাজের প্রকাশ। একসাথে বিশাল একটি মাধ্যমে আমার কাজ মানুষ দেখছেন মতামত দিচ্ছেন। ভীষন ভালো লাগছে। ওয়েব দর্শককে আটকে রাখতে পারছে। কারণ ওয়েবকে নিজের অবসর কাটানোর মাধ্যম করে নিয়েছে মানুষ। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর ইউটিউবের কল্যানে বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সুবাদে যাই বলি, আপনি তো আপনার সময় মতোই বিনোদন চাইবেন। ঠিক সে কারনেই ইদানিং এই ক্ষেত্রটি ব্যাপক সমাদৃত হচ্ছে। তবে অন্য মাধ্যম গুলোকে কোন ভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। টেলিভিশন বলুন চলচ্চিত্র বলুন আমাদের শেকড় কিন্তু সেখানেই। তবে পাশাপাশি ওটিটি যা করছে তা হলো আপনি এ মাধ্যমটিতে নিজের বিনোদন নিয়ন্ত্রণ করে আনন্দ উপভোগ করতে পারছেন।
আনন্দ আলো: ষ্ফুলিঙ্গ সিনেমায় দেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী পরীমনির সাথে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করলেন কেমন ছিল আপনাদের রসায়ন।
শ্যামল মাওলা: প্রথমে খানিকটা নার্ভাস ছিলাম। আমি মঞ্চের এবং টেলিভিশনের শিল্পী। পরীমনি সু পরিচিত একজন চলচ্চিত্র নায়িকা। পরে অবশ্য সেই নার্ভাসনেস বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। পরী সহযোগী অভিনয় শিল্পী হিসেবে বেশ সহজ সরল। বলা যায় আমি বোধহয় বেশ ভাগ্যবান এখন পর্যন্ত আমি যাদের সাথে অভিনয় করেছি সবাই বেশ সিরিয়াস থাকেন। যে কারনেই তাদের সাথে কাজ করা বেশ সহজ হয়ে যায়। তাছাড়া তৌকির ভাই সামনে থাকায় সব কিছু বেশ সুন্দর ভাবেই হয়েছে। পরীমনির বিষয়ে বলতে গেলেÑ বলবো ভালো অভিনয় করেন। অভিনয়ের জায়গাটিতে পরীমনি ভীষণ সাহায্যকারী একজন অভিনেত্রীর নাম।
আনন্দ আলো: বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেয়ার মতো সময় কি এসেছে?
শ্যামল মাওলা: আমি বিশ্বাস করি সময় এসেছে। তবে কিছুটা কষ্ট তো আপনাকে করতেই হবে। আপনি চাইলেন আর রাতারাতি সব ঠিকঠাক হয়ে গেল এমন হওয়াতো স্বাভাবিক নয়। বিশ্ব এখন অনেক ছোট। কাজের পরিধি ও মাধ্যম বাড়ছে। একটি চলচ্চিত্রে অসংখ্য অনুষঙ্গ থাকে। অভিনেতা, অভিনেত্রী সহ ক্যামেরা, লাইট, প্রোডাকশন, রচয়িতা, সম্পাদনা, সঙ্গীত, আরও অসংখ্য ক্ষেত্র আছে। কাজের সংখ্যা ও গুণগত মানের ফিচার ফিল্ম বা যাই নির্মাণ করতে যাবেন এসব অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে তো নির্মাণ করতে পারবেন না। গোটা বিশ্ব এখন একত্রিত হচ্ছে। আগের দিনে ভিএফএক্স এর কোন কাজ হতো না, কালার টোন ফিক্সড করা হতো না, স্কাই ভিউ ভাবাই যেতো না, ক্রোমা করে নির্মাণ করা সম্ভব তা ভাবা ছিল স্বপ্নের মতো। বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে গেলে এসব লাগবেই। কোন ভাবেই কম্প্রোমাইজ করার সুযোগ নেই। এর অর্থ দাঁড়ালো আপনাকে অত্যাধুনিক অনুষঙ্গ গুলো ব্যবহার করে কাজ নামাতে হবে। তা না হলে দর্শক হারাবেন। তাই ক্ষেত্র বা ফ্রেম যেহেতু বড় হচ্ছে, পেশাগত দিক বিবেচনা করলে আপনার যদি ফিল্ম ইন্ড্রাস্টি নিয়ে ভালোবাসা এবং অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে এখানে টিকে থাকা মুশকিল। আর যদি আপনি অত্যাধুনিক ক্ষেত্র গুলোর যে কোন একটিতেও দক্ষ হন তাহলে সময় তখন আপনার হাতে।
আনন্দ আলো: আর্থিক সফলতা নাকি সামাজিক সফলতা কোনটি চান?
শ্যামল মাওলা: আমি সামাজিক সফলতা চাইবো। সামাজিক সফলতা কিন্তু কোটি কোটি টাকার বিনিময়েও পাওয়া অনেক সময় জটিল সমীকরণের মতো মনে হয়। আর সামাজিক সফলতা তো একেবারে অর্থশূন্য নয়। জীবন স্বাচ্ছন্দে চালিয়ে নেয়া যায় সামাজিক সফলতার সীমারেখায়। আমি যে কাজটি করছি তাতে কিন্তু বলাই যায় আমি সামাজিক ভাবে কিছুটা হলেও সফল। অনেকেই চেনেন আমাকে। ভীষন ভালোবাসা পাই। সম্মান পাই। আর কাজের জন্য তো পারিশ্রমিক আছেই। সব মিলিয়ে আমার কাজের ক্ষুধা তো মিটছেই। আমার কাছে সামাজিক ভাবেই সফলতা মূল সফলতা।
আনন্দ আলো: সম্প্রতি মহানগর নামে একটি ওয়েব সিরিজে দূর্দান্ত এক চরিত্রে আপনাকে দেখা গেল। মহানগর নিয়ে কিছু বলুন।
শ্যামল মাওলা: আমি একেবারে অন্ধভাবে বিশ্বাস করি নিপুন ভাইকে। পুরো মহানগর নিয়ে সে যেভাবে খেলতে চেয়েছে আমরা সেভাবেই তাকে খেলতে সাহায্য করেছি। নিপুন ভাই যেভাবে পালে বাতাস দিতে বলেছে আমরা সেভাবেই বাতাস দিয়েছি। স্যুটিংয়ের সব থেকে ভালো দিক যেখানে আমরা রাত যাপন করতাম সেখানেই স্যুটিং। দিনে খাই দাই গল্প করি। হালকা কাজ থাকলে কাজ করি। আর রাতে প্রয়োজন মাফিক কাজ করে যার যার মতো ঘুমিয়ে যাওয়া। রাতের স্যুটিং তাই দিনের বেলা ঘুম। খুব কষ্ট হয়েছে বলে মনে হয় না। সারারাত জেগে আমাদের কাজ করতে হতো। পুরো ইউনিট জাগতো। কিন্তু কারোরই কষ্ট হতে দেখি নাই। মহানগর একটি রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে নিয়ে এগিয়ে চলা একটি গল্প। আমরা কাজ করে আনন্দ পেয়েছি। নিপুন ভাই একজন অতিমাত্রায় ভালো নির্মাতা। তাঁর মতো আর বেশি না পাঁচজন নির্মাতা যদি দেশে থাকতেন তাহলে ওয়েব দুনিয়ায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতাম।
আনন্দ আলো: ওয়েব কি টেলিভিশনের প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠছে?
শ্যামল মাওলা: একদমই না। টেলিভিশন আমাদের শেকড়। মঞ্চ আমাদের অভিনেতা অভিনেত্রী হয়ে ওঠার জায়গা। বিজ্ঞাপন যেমন নাটক নয়, তেমনি নাটক ও সিনেমা নয়। সবারই নিজস্বতা রয়েছে। যেহেতু সবই বিনোদনের একেকটি মাধ্যম, সেজন্য মানুষের পরিবর্তনশীল রুচির বহিঃপ্রকাশ এসব মাধ্যম। আর কিছুই না।