Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

উন্নয়নের রূপকার জামিলুর রেজা চৌধুরী

বাংলাদেশ প্রকৌশল জগতে যে নামটি সবার কাছে সুপরিচিত তিনি হচ্ছেন অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। একাধারে তিনি একজন স্বনামধন্য প্রথিতযশা ও আত্মনিবেদিত প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, নানা পরিচয়ে পরিচিত সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। দীর্ঘ দিন অধ্যাপনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এ। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টার ইউনিভার্সিটি থেকে একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে সম্মান সূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। পিএইচডি করেন বহুতল ভবন নিয়ে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খ্যাতে অবদানের জন্য ২০১৭ সালে সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০১৮ সালে তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক ঘোষনা করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে পদ্মা সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্নফুলী টানেল সহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। শিক্ষকতা, প্রকৌশল পেশা, নীতি নির্ধারণী সব কিছুতেই দেশকে বহু কিছু দিয়েছেন। গত ২৮ এপ্রিল ছিল অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রথম প্রয়াণ দিবস। এই গুণী মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবার শাহ্ সিমেন্ট ‘নির্মাণে আমি’তে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

জামিলুর রেজা চৌধুরী শুধু একটি নাম নয়, দেশের লাখো মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা। দেশের অসংখ্য উন্নয়নের রূপকার অগ্রগন্য প্রকৌশলী জাতীয় এই অধ্যাপক। সবার কাছে আলোর ফেরিওয়ালা হিসেবেই পরিচিত সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই গুণী মানুষটি। যিনি স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন, বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতেন। তার রেখে যাওয়া স্বপ্ন আর উন্নয়ন অবকাঠামোর জন্যই দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে তাঁকে। জাতীয় জীবনে তাঁর অবদান অবিস্মরনীয়। তবে প্রথমেই বলতে হয় তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। সাদা মনের মানুষ ছিলেন। সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপকে ভূষিত করেন। সত্যিকার অর্থেই এই গুণী মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন জাতির শিক্ষক। জামিলুর রেজা চৌধুরীর পরিচয় এবং বহুমাত্রিক প্রতিভা এত বেশি ছিল যে তাকে কোন পরিচয় দেওয়া জুতসই হবে তা নিয়ে কনিষ্ট সহকর্মীরা বিভ্রান্তিতে পড়তেন। এক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়। শিক্ষা নিয়ে তাঁর মন্তব্য নিলে শিক্ষাবিদ, জাতীয় অধ্যাপক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কোথাও প্রকৌশলী বা তথ্য প্রযুক্তিবিদ, কোথাও বুয়েটের অধ্যাপক, আবার কোথাও সড়ক ও সেতু বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি পরিচয় ব্যবহার করা হতো। নানা পরিচয়ে পরিচিত সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। সত্যিকার অর্থে একজন গুণী মানুষ। নিরহংকার ও সদালাপী মানুষের মূর্ত প্রতীক। তিনি ছিলেন বট গাছের মতো। সবাইকে ছায়া দিয়ে রাখতেন। খুব সহজেই সবার সাথে মিশতেন। যে কেউ তাঁর সাথে মিশলে শুভাকাক্সিক্ষ হয়ে যেতেন। অর্থ বিত্তের প্রতি তাঁর কোনো লোভ ছিল না।
কাজ পাগল মানুষ ছিলেন। সারাদিনই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এতো কাজ এতো দায়িত্ব কীভাবে করতেন? এ প্রসঙ্গে তিনি সব সময়ই বলতেন, কাজের মধ্যে নিজেকে চিনতে হবে। তাই আমি নিজের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করে থাকি। বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে অবিরত কাজ করে তিনি এই জাতিকে করে গেছেন ঋণী। শিক্ষার পথে তিনি হেটেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন নতুন প্রজন্মের পথেরদিশা। তাদের কাছে তিনি আলোর ফেরিওয়ালা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই গুণী মানুষটি যেখানে হাত দিয়েছেন সফলতা পেয়েছেন। শিক্ষকতা, প্রকৌশল পেশা, নীতি নির্ধারনী সব কিছুতেই তিনি দেশকে বহু কিছু দিয়েছেন।
দেশে গত কয়েক দশকে যে সব বড় বড় ভৌত অবকাঠামো হয়েছে, তার প্রায় সব গুলোতেই কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে যাদের হাত দিয়ে বাংলাদেশের ইমারত বিধি তৈরি হয়েছিল জামিলুর রেজা চৌধুরী তাদের একজন। দেশের প্রথম মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে ৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। আর এখন পদ্মার ওপরে দেশের সবচেয়ে বড় যে সেতু তৈরি হচ্ছে সেই প্রকল্পের আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্যানেলেরও নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তিনি। এছাড়াও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, কর্নফুলী টানেল সহ চলমান নানা উন্নয়ন প্রকল্পেও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অধ্যাপক। তিনি সব সময় জাতীয় স্বার্থে কথা বলেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিখ্যাতে অবদানের জন্য ২০১৭ সালে সরকার তাকে একুশে পদক দেয়। ২০১৮ সালের জুনে আরও দুজন শিক্ষকের সঙ্গে তাকেও জাতীয় অধ্যাপক ঘোষনা করা হয়। ওই বছরই জাপান সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সম্মানজনক অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান, গোল্ড রেইস উইথ নেক রিবন খেতাবে ভূষিত করে। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান সূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশী তিনি।
জামিুল রেজা চৌধুরী মৃত্যু পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ছিলেন। তিনি ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। বুয়েট সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে চাননি। এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলে রাজনৈতিক চাপ আসবে। ছাত্ররা আন্দোলন করবে। রাতের বেলায়ও সতর্ক থাকতে হবে, ক্যাম্পাসে কোথায়, কী হচ্ছে। আমি শান্তি প্রিয় মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে চাই। আর সেই শান্তির চির ঘুমের দেশে ঘুমিয়ে আছেন সবার প্রিয় শ্রদ্ধা ভাজন মানুষটি।
দেশের প্রকৌশল শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিকাশে সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে অগ্রগণ্য ব্যক্তি ছিলেন। নিজস্ব নগরায়নের সুপরিকল্পনা ও প্রযুক্তি বিকাশে তিনি অসামান্য কাজ করেছেন। নানা জায়গায় তার কর্ম তৎপরতা ছিল। শিক্ষকতা করেছেন, গবেষণা করেছেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী, বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ছিলেন। তার অসম্ভব স্মরণ শক্তি ছিল। তিনি গণিত অলিম্পিয়াডে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন। দেশের তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও তাঁর অনেক অবদান রয়েছে।

জামিলুর রেজা চৌধুরী পালন করেছেন রাষ্ট্রীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ব্যস্ততাও কম ছিল না। কিন্তু তারপরও স্বপ্নের সেই সমাজ গড়তে, তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞানে আগ্রহী করতে নিরন্তর কাজ করে গেছেন তিনি। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিজ্ঞান বির্তক, গনিত অলিম্পিয়াড সহ নানা রকমের বিজ্ঞান ভিত্তিক অলিম্পিয়াড ও উৎসবের। কাজ করেছেন পাঠ্যবইয়ের মান উন্নয়নেও। এত কাজ করেও তৃপ্ত ছিলেন না তিনি। স্বপ্নিল চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতেন দূর গন্তব্যের দিকে। তিনি বলেছিলেন, সারাদেশে যে শিক্ষার্থী আছে, তার একটি ক্ষুদ্র অংশকেই আমরা এই সবে যুক্ত করতে পেরেছি। প্রায়ই অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আমাদের সমাজে কুসংস্কার ছিল, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এখনও দেখি না। লাখ মানুষ ওই সব সংস্কারে বিশ্বাস করে অনেক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কাজ করছে। এর সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপব্যবহারও যুক্ত রয়েছে। তখন তৃপ্ত হতে পারি না।
১৯৬৩ সালে তিনি বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে চলে যান তিনি। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করেন। ১৯৬৮ সালে সেখানেই পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করেন। তাঁর গবেষনার বিষয় ছিল শিয়ার ওয়াল অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল এ্যানালাইসিস অব হাইরাইজ বিল্ডিং। পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে এসে আবার বুয়েটে শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০০১ সালে বুয়েট থেকে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ফ্যাকাল্টি ডিন, বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব ছাড়াও বুয়েটের তৎকালিন কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রায় এক দশক। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। পরে তিনি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে যোগ দেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করার পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তি বিষয়েও সরকারের বিভিন্ন পরামর্শক প্যানেলে জামিলুর রেজা চৌধুরীর ডাক পড়ে। তিনি বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে সফটওয়ার রপ্তানি এবং আইটি অবকাঠামো টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৭ সাল থেকে ৫ বছর।
যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউশন অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের ফেলো জামিলুর রেজা চৌধুরী নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ এর সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি, পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড সহ নানা আয়োজনে জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। বহুতল ভবন নির্মাণ, স্বল্প খরচে আবাসন, ভূমিকল্পসহনীয় ভবন নকশা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে ইমারত রক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি এবং প্রকৌশল নীতি সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৭৫টি গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে তাঁর। দীর্ঘ এই পথযাত্রায় জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গী ছিলেন তার স্ত্রী সেলিনা চৌধুরী। তাদের মেয়ে কারিশমা ফারহিন চৌধুরীও একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আর ছেলে কাশিফ রেজা চৌধুরী কম্পিউটার প্রকৌশলী।
ছোটবেলা বা কৈশোরে অনেক বন্ধু বান্ধব ছিল তার। খেলাধুলা পছন্দ করতেন। সেই গ্রেগরিজ স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় ফুটবলে ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়ন হন তারা। পুরস্কার হিসেবে পান ৬০ টাকা। দলের সবাই মিলে কালাচাঁদ গন্ধ মানিকের মিষ্টির দোকানে মিষ্টি খেতে যান। আর বাকি টাকা শেষ করতে ছুটে যান সিনেমা হলে। সেই কৈশোর থেকেই খেলাধুলার পাশাপাশি সিনেমা দেখার ঝোঁকটা ছিল ভীষন। বিশেষ করে উত্তম-সুচিত্রার কোনো ছবি না দেখে থাকতেন না জামিলুর রেজা চৌধুরী। হল থেকে বের হয়ে আসার সময় হলের সামনে থেকে তিনি কিনে আনতেন সিনেমার গানের বই। পথে হলো দেরি, শাপমোচন, সাগরিকা তার প্রিয় সিনেমা। রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব প্রিয় জামিলুর রেজা চৌধুরীর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান ভালো লাগত তাঁর। বেড়াতে খুব পছন্দ করতেন। নিজের দেশের বাইরে সুইজারল্যান্ড প্রিয় জায়গা। কোথাও বেড়াতে গেলে পৃথিবীর সুউচ্চ ভবন গুলোর ছোট ছোট স্মারক কিনতেন। আইপ্যাড, কিন্ডেল থাকলেও সব সময় সঙ্গী ছিল ল্যাপটপ ও মুঠোফোন। পোশাক নিয়ে বিশেষ কোনো ব্রান্ডের প্রতি দুর্বলতা ছিল না অধ্যাপক ড, জামিলুর রেজা চৌধুরীর। ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানিয়ে যায় এমন পোশাকই পড়তেন। কোনো কিছুতেই বাহুল্য পছন্দ করতেন না তিনি। ঈদ বা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সাদা কাপড়ে সাদা সুতার এমব্রয়ডারি করা পাঞ্জাবি পড়তেন। গরমের সময় নীলের বিভিন্ন সেডের সিল্কের হাওয়াই শার্ট পড়তেন। সামনে আসছে রোজার ঈদ। শৈশবে ঈদকে ঘিরে রয়েছে তার নানা স্মৃতি।

প্রথম ঈদের স্মৃতি নিয়ে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, “আমরা তখন সিলেটে থাকি। সদ্যই পাকিস্তান আলাদা হয়েছে। তখন আমার চার বছর বয়স। বাবা আমাকে এবং বড় ভাইকে শেরওয়ানি এনে দিলেন। আমার শেরওয়ানি সোনালী রঙের। বড় ভাইয়েরটার রঙ মনে নেই। জিন্নাহ টুপির সে সময় খুব প্রচলন ছিল। শেরওয়ানি পড়ে, জিন্নাহ টুপি মাথায় দিয়ে বাবার সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ে কান্নাকাটি করিনি। ১৯৪৯ সালে আমরা ময়মনসিংহে চলে গেলাম। তখন কোনো একটা ঈদে আমি কান্নাকাটি করেছিলাম। ঈদের নামাজে সবাই শেজদায় চলে গেল, আর ওই সময় আমি দাঁড়িয়ে আশে পাশে তাকিয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলাম। এর পরের বার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে আর ঈদগাহে নেবেন না। ময়মনসিংহে তখন বড় ঈদগাহ ছিল কাঁচিঝুলিতে। সেখানে ঈদগাহের পাশেই একজন অতিরিক্ত জেলা জজের বাড়ি ছিল, বাবা সেখানে আমাকে রেখে গেলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম সবাই ঈদের নামাজ পড়ছে। তখন ঈদের প্রস্তুতি দুই দিন আগে থেকে শুরু হতো। মা-খালারা বাড়িতেই সেমাই তৈরি করতেন। একটা হাতে চালানো যত্ন ছিল। তার মধ্যে ময়দা ঢেলে চিকন, মোটা আর মাঝারি তিন ধরনের সেমাই বানানো হতো। রোদে শুকানোর পর রান্নার উপযোগী হতো সেই সেমাই। এছাড়া আরও তৈরি হতো নানা রকমের মিষ্টান্ন খাবার। সে সব মিষ্টান্ন খাবারে নারকেল দেওয়া হতো। সেমাই বানানো শুরু হওয়ার আগে ঈদের আমেজ পাওয়া যেত বাড়িতে খলিফা এলে। খলিফা মানে দরজি। প্রতিটি বাড়িরই একজন চেনা খলিফা ছিলেন। তিনি বাড়ি এসে সবার জামার মাপ নিতেন। লম্বা থান কাপড়ে বাড়ির সব পুরুষ মানুষের একরকম শার্ট হয়ে যেত। সেই জামা আবার ঈদের আগে কোনো ভাবেই পড়া যাবে না। পরতে হবে ঈদের দিন সকালে। কয়লার ইস্তিরি দিয়ে জামাটা ইস্তিরি করা হতো। এখনকার মতো ঢোলা পায়জামা আমরা পড়তাম না। চোস পায়জামা পড়তাম। সেই পায়জামা নিচের অংশ এতটাই টাইট ছিল যে পড়ার সময় গোড়ালির কাছে আটকে যেত। ঈদের দিন সকালে নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে একটু বিশেষ নাশতা। অন্য দিন আমরা খেতাম পরোটা। এখন যেমন ছোট্ট বাচ্চাদের ঈদি দেওয়ার জন্য নতুন টাকা বাড়িতে রাখা হয়। আমার ছেলে বেলায় এমনটা খুব একটা দেখিনি। সে সময় বাচ্চাদের হাতে টাকা দেওয়া হতো না।”

স্মৃতি চারণ

দারুন একজন অমায়িক মানুষ ছিলেন
শফিউল বারী, অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
ছাত্র জীবন থেকেই আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। আমার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর সঙ্গে মাস্টার্স করার। তিনি আমার সুপারভাইজার ছিলেন। আমরা উঁচু বিল্ডিংয়ের ওপরে থিসিস করে ছিলাম। পিএইচডি করার সময় স্যারকে বলেছিলাম, আমি পিএইচডি করতে কোথায় যাবো? তখন তিনি বলেছিলেন, আমার পিএইচডি’র সুপার ভাইজেশন যিনি করেছেন তুমি তার কাছে যাও। আমি তাকে বলে দিচ্ছি। আমি পিএইচডি করেছি জামিলুর রেজা স্যারের যে সুপার ভাইজার ছিলেন তার তত্বাবধানে।
জামিলুর রেজা স্যারের সাথে আমার অনেক কাজ করা হয়েছে। আমার প্রতি খুব আস্থা ছিল তার। তাঁর এলিফেন্ট রোডের বাড়িটা যখন ডেভেলপারের কাছে দেওয়া হয় তখন তিনি আমাকে বললেন, শফিউল বারী আমার বাড়ির স্ট্রাকচারাল ডিজাইন অনেকেই করে দিতে চাচ্ছেন। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তুমি কাজটা করবে। তোমার উপরে আমার আস্থা আছে। তখন তার বাড়ির কাজটা নিয়ে মিটিং শুরু করি। আমার সঙ্গে ছিলেন আর্কিটেক্ট নাহাজ খলিল ভাই আর নাভানা ডেভেলপার। স্যারের এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে বেশ কয়েকবার মিটিং করে ডিজাইন ঠিক করা হয়। তিনি মাঝে মধ্যেই আমাকে বলতেন, শফিউল কন্সট্রাকশনে যাও তুমি। আমি বললাম আপনার প্রজেক্টে কয়েকবার যাওয়া হয়েছে আমার।
আমাদের ডিপার্টমেন্টে জামিলুর রেজা স্যারের একটা অন্যরকম ইমেজ ছিল। আমাদের সোহরাব স্যার জামিলুর রেজা স্যারের সম্বন্ধে বলতেন, একাডেমিক কাউন্সিলে যখন মিটিং হতো তখন উপাচার্য ছিলেন মতিন পাটোয়ারী স্যার। মিটিং-এ আমরা কাউন্সিলার মেম্বাররা অনেকেই অনেক কিছু বলতাম। উপাচার্য স্যার সব কিছু শুনে জামিলুর রেজা স্যারকে জিজ্ঞেস করতেন, জামিল তুমি কি বলো? তখন জামিল স্যার ফাইনালী যেটা বলতেন স্যার সেটাই গ্রহণ করতেন। জামিল স্যারের এরকম একটা প্রভাব ছিল পুরো ইউনিভার্সিটির ভেতরে।
জামিলুর রেজা স্যার আর আমি দুজনে মিলে এ্যানালাইসিস অব হাইরাইজ বিল্ডিং কোর্সটা শিক্ষার্থীদের পড়াতাম। এরপর তিনি বুয়েট থেকে অবসর গ্রহণ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলেন। তখন থেকেই আমি ওই সাবজেক্টে নিয়মিত পড়াচ্ছি। স্যারকে আমি কোনোদিন রাগ করতে দেখিনি। জোড়ে কথা বলতেন না। অমায়িক ছিলেন। তিনি আমাকে অন্য চোখ দেখতেন। শেষ দিকে তিনি আমাকে বলতেন, শফিউল বারী এবার আমি হজ্বে যাবো। আমি খুব খুশী হয়েছি স্যার হজ্বে যাবেন। যদিও ওই বছর তার হজ্বে যাওয়া হয়নি। তার পরে তিনি হজ্ব করে এসেছেন। শেষ দিকে ধর্ম-দ্বীন নিয়ে জামিলুর রেজা স্যার আমার সাথে প্রায়ই কথা বলতেন।

তাঁর অবদান কখনও ভোলার নয়
ড. আইনুন নিশাত, বিশেষজ্ঞ পানিসম্পদ ও জলবায়ু
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কী হবে, এ চিন্তা যখন শুরু হয় তখন থেকেই তিনি এর সাথে জড়িত ছিলেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে আমরা একসাথে কাজ করেছি। ১৯৯০ সালের দিকে প্রথম আলাদা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি হয় এবং তিনি এর উপদেষ্টা ছিলেন। তখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রূপরেখা কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষ করে উপকূলের জালোচ্ছ্বাসের বিষয়ে আমরা তার নেতৃত্বে রিপোর্ট দেই। তখন দাতারা দেশি বিশেষজ্ঞদের গুরুত্ব দিত না। কিন্তু কাজটি এত ভালো ছিল যে অবজ্ঞার সুযোগ ছিল না। পরিবেশ সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত কার্যকর চিন্তা করতেন। তার অদ্ভূত গুণ ছিল তিনি রাজনীতিতে জড়াতেন না। পলিটিক্যালি নিউট্রাল থেকে ভালো করলে পরিবেশের ভালো হবে, এটি তিনি ভাবতেন। সরকারের সাথে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পছন্দ করতেন। কারণ আমরা যে সব পরামর্শ দেই সেটি তো সরকারের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন হবে। বাংলাদেশে কম্পিউটারের বিস্তৃতির ক্ষেত্রে তিনি প্রচুর কাজ করেছেন। আজকে যে কম্পিউটার এত সহজলভ্য এব্যাপারে তাঁর অবদান অনেক। আইটি সেক্টরের নানা বিষয়ে সরকার তার পরামর্শ নিত। তাঁর অবদান ভোলার নয়।

শূন্য থেকে অসীমের পথে
আ ফ ম সাইফুল আমিন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
অ্যাপোলো মিশনের মাধ্যমে চন্দ্রাভিযানের সফলতায় যখন সারাবিশ্ব বিভোর, কম্পিউটার প্রযুক্তি নির্ভর তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের উন্মেষ যখন সমগ্র বিশ্বে কড়া নাড়ছে সেই ১৯৭০ এর দশকে বিদেশে নিশ্চিত মোহময় জীবনের মায়া ত্যাগ করে বিলেত থেকে এই ভূখন্ডে ফিরে এসে অধ্যাপনা এবং পুরকৌশল পেশাকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। ১৯৭০ এর প্রলয়ংকারী সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস এবং ১৯৭১ এর যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে পরাধীনতার শেকল থেকে সদ্য মুক্ত অতি দুর্বল অবকাঠামো যখন সুবিন্যস্ত পুর্নগঠনের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন বাংলাদেশের কয়েকজন ক্ষনজন্মা, দূরদর্শী, কর্মঠ প্রকৌশলীবৃন্দের মধ্যে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন অন্যতম, যাঁরা এই দেশকে নতুন করে সাজিয়ে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছিলেন।

পাশ্চাত্যে থেকে গেলে হয়তো এই জামিলুর রেজা চৌধুরী হয়ে উঠতে পারতেন সুউচ্চ ভবনের নকশাকার প্রকৌশলী, কিংবা মহাকাশ অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দানকারী কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের পুরোধা। কিন্তু এই মহাপুরুষ একই সময় কালে প্রবাহমান স্রোতের বিপরীতে দেখিয়েছেন কীভাবে প্রকৌশলীরা সহজলভ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাইক্লোন শেল্টার তৈরি করে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ঝড়ঝঞ্চা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে পারেন। এটা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণা। দেশে কম্পিউটার শিক্ষার ব্যুৎপত্তি স্থাপন, এর বিস্তার ও প্রয়োগের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে ইন্টারনেটের সাথে সংযোগের মাধ্যমে কম্পিউটার ব্যবহারে অনগ্রসর একটি জাতিকে কিভাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে ধাবিত করা যায় তার পথ দেখিয়েছেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি আরো দেখিয়েছেন কিভাবে একটি যুদ্ধ পরবর্তী নাজুক প্রকৌশল শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করে সারা দেশে সংহততর ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে নিয়ে আসার পথ সুগম করা যায়। নিজ শেকড়কে ভুলে না গিয়ে নতুনত্বের পথে অবিরাম যাত্রা ছিল তাঁর অন্যতম জীবন দর্শন। বঙ্গবন্ধু সেতু মেরামত কালে আমি তাঁকে দেখেছি কোনো দৃশ্যমান চ্যালেঞ্জকে না এড়িয়ে বরং দক্ষতার সাথে দক্ষজনবল ও লাগসই প্রযুক্তি দিয়ে তা সরাসরি মোকাবেলা করার সক্ষমতা প্রদর্শন করতে। পদ্মা সেতু নির্মাণের কারিগরি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে যেয়ে অধ্যাপক চৌধুরীকে আমি একই দর্শনে ব্রত হতে ঘনিষ্ঠভাবে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এই সেতু এখন আমাদের দেশ ও দশের কল্যাণে নিয়োজিত হবার অপেক্ষায় আছে। স্বাধীনতার পরে দেশকে ভালোবেসে দেশ গড়ার ব্রত গ্রহনকারী এই মহান প্রকৌশলী মেধা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শূন্য থেকে অসীমের সম্ভাবনা সৃষ্টিতে নিজেকে সমর্পন করেছিলেন। দেশের দক্ষ প্রকৌশল সমাজকে দক্ষতর করে তাঁর অমসৃন দীর্ঘ পথ যাত্রার ঘনিষ্ঠ সাথী করেছিলেন। দেশের উন্নয়ন কে সুসংগঠিত করার লক্ষে প্রতিটি ভালো কাজের মধ্যে তার যথা সম্ভব সাবলীল পদচারণা, দৃশ্যমান অবস্থান, সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা এদেশের নবীন এবং তরুণ প্রজন্মকে করেছে সৃজনশীলতায় আত্মবিশ্বাসী।
জাতির বিকাশ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির সাথে নিজ প্রতিভার বিকাশকে সংশ্লিষ্ট করে একজন দেশ প্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে তরুণ সমাজকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন। দেশের সকলের জন্য তিনি ছিলেন সমুন্নত শিরধারী বিস্তীর্ণ পরিধিতে ছায়া দানকারী এক বিশ্বস্ত আচ্ছাদনস্বরূপ। দেশে ফিরে আসা এবং দেশের কাজে এভাবে আত্ম নিয়োগ করে তাঁর তৈরি করা উজ্জ্বল জীবন দৃষ্টান্ত পরবর্তী তরুণ প্রজন্মের জন্য এক গভীর অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। জীবন ভর কঠোর পরিশ্রমের শেষে বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ এই মহাপ্রাণের জীবনের শেষ অবসন্নভাগে তার অক্লান্ত হৃদয়ের বাহ্যিক ক্লান্তরূপ আমি অতি নিকট থেকে নিবিড় ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। দেশের জন্য অসীম সম্ভাবনার দ্বার উম্মুক্ত করে নিরবে নিভৃতে অসীমের পথে দেশের এই সূর্য সন্তানের অন্তিম যাত্রা যেন আমাদের সকলের হৃদয়কে এক গভীর শূন্যতায় নিপতিত করেছে। আমরা হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে এই পরমাত্মার চিরশান্তি প্রার্থনা করছি।