সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
মামুনুর রহমান
কোরিয়ান সিনেমায় বাংলাদেশী মাহবুব এখন নায়ক। ঢাকাই বা ভারতীয় চলচ্চিত্রে যেমন সাইড হিরো থাকে তেমন নয় কিন্তু। একেবারে মেইন কাষ্টিং হিরো। কোরিয়ায় মাহবুব গিয়েছিলেন একজন শ্রমিক হয়ে। দক্ষিণ কোরিয়ায় সিনেমায় অভিনয় করার পাশাপাশি পরিবেশক, প্রযোজকের কাজটিও করছেন। চলুন তার মুখ থেকেই জানার চেষ্টা করি একজন শ্রমিক থেকে কোরিয়ান সিনেমার নায়ক হয়ে ওঠার গল্প।
১৯৯৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় সাধারন শ্রমিক হিসেবে যান মাহবুব। পরিকল্পনা ছিল দুই থেকে তিন বছর থেকে বেশ কিছু টাকা উপার্জন করে বাংলাদেশে ফিরে নিজ শহরে গড়ে তুলবেন বড় কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কখনো ভাবেননি দক্ষিণ কোরিয়ায় থেকে যাবার কথা। স্বপ্নেও ভাবেননি কোন একদিন এমনও সময় আসবে যেদিন কোরিয়ান চলচ্চিত্রের নায়ক হবার সুযোগ পাবেন তিনি। “যেহেতু শ্রমিক হয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় আসি আমি। সেজন্য প্রবাসী শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের জন্য যে ট্রেড ইউনিয়ন তার সাথে যুক্ত হই। প্রবাসী শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে কাজ করতে শুরু করি। সেসব জায়গায় আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের বিভিন্ন বৈষম্য গুলো তুলে ধরি। স্থানীয় গণমাধ্যমের সাহায্য নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কাজ গুলো খুব সহজ ছিল না। কারণ আমরা যতই র্যালি করি, মানুষকে জানাই না কেন। এটা যত সহজ আমি ভেবেছিলাম তত সহজ ছিলো না। লোকাল মিডিয়া কখনোই কাভারেজ দিতো না। তখনই আমরা পরিকল্পনা করি আমাদের নিজস্ব একটা মাধ্যম দরকার। তাই নিজেই নেমে পড়ি। ২০০৪ সালের শুরু থেকে প্রবাসী শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানেÑ সমস্যা গুলো নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানাতে শুরু করি”।
প্রবাসীদের এসব সমস্যা সমাধানে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির পাশাপাশি বেশ কটিতে অভিনয় করতে শুরু করেন মাহবুব। বললেন সে কথা, একটা শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছিলাম দ্য রোড অব দ্য রিভেঞ্জ, শর্ট ফিল্মটির মূল বিষয় ছিল প্রবাসী শ্রমিকরা একদিকে কাজ করেই যাচ্ছেন অন্য দিকে তাদের সমস্যা গুলো সমাধানের বদলে আরও বেড়ে যাচ্ছে। এটা ছিল এক ধরনের ব্লাক কমেডি।

বড় পর্দায় অর্থাৎ রুপালী পর্দায় এলেন ২০০৮ সালে। কোরিয়ান ভাষায় নির্মিত সিনেমার মাধ্যমে। সিনেমার নাম বান্ধবী। দুইটি চরিত্রের মাধ্যমে সিনেমাটিতে ফুটে উঠেছে কোরিয়ান বাস্তবতা। কোরিয়ান একটি মেয়ে চরিত্র মিনজো ও বাংলাদেশী একটি ছেলে চরিত্রটির নাম করিম। মাহবুব বলেন, আমার বিভিন্ন রকম শর্ট ফিল্মে অভিনয় করা এবং নির্মাণের জন্য পরিচালক আমাকে চিনতেন। যেহেতু আমি একজন বাংলাদেশী তাই পরিচালক আমার ওপর কিছু দায়িত্ব দেন। ‘বান্ধবী’র জন্য স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী পারফেক্ট একজন বাংলাদেশী অভিনেতা দরকার। সিনেমার হিরোকে অবশ্যই হ্যান্ডসাম হতে হবে। অবশ্যই কোরিয়ান ভাষায় অনর্গল কথা বলতে জানতে হবে। পাশাপাশি ভিসার সমস্যা থাকা চলবে না। খুঁজতে শুরু করে দেখি মনের মতো কাউকে পাচ্ছিলাম না। তখন আমি নিজে থেকেই বলি- আমি অভিনয় করলে কেমন হয়? পরিচালক আমাকে জানালেন মাহবুব আমি জানি তুমি হ্যান্ডসাম, অনর্গল কোরিয়ান ভাষায় কথা বলতে পারো, ভিসা জটিলতাও তোমার নেই। তবে মাহবুব তোমার ওয়েট লুজ করতে হবে।
বান্ধবীর গল্পটি রচিত হয়েছে একজন অভিবাসী শ্রমিকের পাওনা আদায় এবং টিকে থাকার লড়াইয়ে কোরিয়ান বান্ধবী’র ভূমিকা নিয়ে। বান্ধবীতে সুযোগ পেতে দেড় মাসে তেরো কেজি ওজন কমিয়ে আনেন মাহবুব। বান্ধবী যখন জেনজু আন্তর্জাতিক উৎসবে যায়, সেখানে দুই ক্যাটাগরিতে বড় অ্যাওয়ার্ড পেয়ে যায়। একজন নবাগত অভিনয় শিল্পীর জন্য অসামান্য অর্জন। কোরিয়ান মিডিয়ায় বান্ধবী এবং আমাকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা। আমার ভীষন ভালো লেগে যায় বিষয়টি। কোরিয়ান মিডিয়া ফলাও করে সম্প্রচার করেছিল ‘বান্ধবীর’ খবর।
মর্যদাপূর্ণ পুরস্কার অর্জনের পর নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় মাহবুবকে। একবার দু’বার নয়। অসংখ্যবার। কালো চামড়ার অভিবাসী এখানে কেন? দেশে চলে যাও। আরও অনেক কিছু শুনতে হয় তাকে। একাধারে থ্রেট কল পেয়েছেন অসংখ্য। সত্যি বলতে কি এমন থ্রেট কল আসবে এমন কোন কিছুর জন্যই আমি প্রস্তুত ছিলাম না। পৃথিবীর সব দেশেই এমন হয় বুঝলাম যখন সেই কল গুলো আসতে শুরু করে। তখনই আবারও স্পষ্ট হলো আসলে পৃথিবীর সব দেশেই বর্ণ-বৈষম্য কাজ করে। এবং সেটা কোরিয়াতেও কাজ করে। আমি এটাকে আমার মতো করেই গ্রহণ করেছিলাম।
এপর্যন্ত পনেরোটির মতো কোরিয়ান সিনেমা, নাটক ও বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন মাহবুব। কালো চামড়ার মানুষ হওয়ার কারণে কাজের সুযোগ অনেক কম বলে স্বীকার করেন মাহবুব। সে কারনেই চলচ্চিত্রের পরিবেশনায় কাজ শুরু করেছিলেন বিগত কয়েক বছর থেকে। শুধুমাত্র সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করলেই যে সংগ্রামে টিকে থাকা যায় তা তিনি বিশ্বাস করেন না। তাই তো এখন সিনেমাকেই সব কিছু মনে করে সিনেমার সাথেই আছেন আমাদের মাহবুব। কোরিয়ান সিনেমার মাহবুব লি।