Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ভেবেছিলেন সিনেমা হলের গেইট কিপার হবেন, হুমায়ূন ফরীদি

মামুনুর রহমান

অভিনয় দিয়ে দেশ বরেন্য হয়েছেন। কখনও হাসিয়েছেন কখনও কাঁদিয়েছেন দর্শক শ্রোতাদের। তাঁর অভিনয়ের যাদুকরি ক্ষমতায় বিস্মিত হয়েছে দেশবাসী। সকলের কাছেই প্রিয় নাম হুমায়ূন ফরীদি। প্রিয় এই অভিনেতার নামের শুরুতে প্রয়াত শব্দটি যোগ করতে এখনো অনেকের মন খারাপ হয়। হুমায়ূন ফরীদি বেঁচে নেই এটা এখনও তার ভক্তদের অনেকেই মানতে নারাজ। বয়স যখন তেরো হাত খরচ যোগাতে বাবার বেতনের দশ টাকা চুরি করেছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। পারিবারিক ভাবে তাকে চুরি যাওয়া টাকার কথা জিজ্ঞেস করা হলে এমন ভাব করেছিলেন যাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ করা যায়নি তাকে। সেদিনই প্রথম ফরিদী বুঝতে পেরেছিলেন তিনি অভিনেতা হিসেবে খারাপ নন। সেখান থেকেই তার পথ চলা শুরু।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন ফরীদি। বাবা এটিএম নুরুল ইসলাম ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। বাবার চাকরীর সুবাদে মৌলভীবাজার, বাহ্ম¥নবাড়ীয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর সহ অসংখ্য জেলায় ঘোরার সৌভাগ্য হয় তার। মা বেগম ফরিদা ইসলাম ছিলেন একজন গৃহিনী। ফরীদির ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন ছন্নছাড়া স্বভাবের। এজন্য নিজের নামের সাথে অসংখ্য নেতিবাচক নামে অলংকৃত হয়েছেন। কখনও ডাকা হয়েছে পাগলা, গৌতম বা সম্রাট নামে। দূরন্ত ও অস্থির স্বভাবে অনর্গল কথা বলে যেতেন। বাবা নুরুল ইসলামকে মানুষ যখন সম্মান করে কথা বলতো ভিষন ভালো লাগতো তাঁর। তাই একবার ঠিক করেছিলেন বাবার মতো হবেন। ভিষন খাবার প্রিয় মানুষ ছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। তাই একবার এও ভেবেছিলেন, বাবুর্চী হবেন। তাহলে প্রতিদিনই মজার মজার খাবার পাওয়া যাবে। সিনেমা দেখা হুমায়ূন ফরীদির আরেক প্রিয় বিষয় ছিল। পকেটের টাকার থেকে সিনেমার টিকেটের দাম বেশি হওয়ায় একবার ভেবেছিলেন সিনেমা হলের টিকেট চেকার হবেন। তাহলে প্রতিদিন আর টিকেট কেটে সিনেমা দেখতে হবে না। সেই দশ এগারো বছরের হুমায়ূন ফরীদির মাথায় একেক দিন একেক রকম হবার চিন্তা ঘুরে বেড়াতো। প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে আসেন কালীগঞ্জ থেকে মাদারীপুরে। মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর ভর্তি হন চাঁদপুর সরকারি কলেজে। হাইস্কুল পাস করার মাঝামাঝি সময়ে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন তিনি। হাইস্কুলের এক শিক্ষিকার প্রেমে পড়েন তিনি! ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক রসায়নে ভর্তি হন। এলো ১৯৭১। চলে গেলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের পর লাল সবুজের পতাকা নিয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন হুমায়ূন ফরীদি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ফেরা হয়নি। টানা পাঁচ বছর বোহেমিয়ান জীবন কাটিয়ে শেষে অর্থনীতিতে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লেখাপড়া শেষ করে বেশ কিছুদিন ব্যবসা এবং চাকুরীর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু উৎকোচ দিয়ে কাজ বাগিয়ে আনতে হয় বলে দুটোর একটিও ভালো লাগে না তাঁর। হুট করেই মঞ্চে চলে আসেন হুমায়ূন ফরীদি। ছেলেবেলায় কিশোরগঞ্জে ফরীদির বয়স যখন বারো তখন মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন। ‘এক কন্যার জনক’ নাটকে অভিনয়ের পর হুমায়ূন ফরীদির মাঝে অজান্তেই অভিনয়ের বীজ রোপিত হয়েছিল বলে মনে করেন অভিজ্ঞজনেরা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যজন সেলিম আল দীনের সাথে বেড়ে ওঠার সময়টাতেই নাটকে মনোযোগী হন হুমায়ূন ফরীদি। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যেৎসবের আয়োজন করেন নাট্যজন সেলিম আল দীন। হুমায়ূন ফরীদি ছিলেন সেই উৎসবের অন্যতম সংগঠক। এই উৎসবে হুমায়ূন ফরীদির রচনা ও নির্দেশনায় আত্ত্বস্ত ও হিরন্মোয়ীদের বৃত্তান্ত সেরা নাটক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর ঢাকা থিয়েটারে শুকন্তলা, ফণীমনসা, কীত্তন খোলা, কেরামত, মঙ্গল, মুনতাসির ফ্যান্টাসী, ভূতের মতো নাটক গুলোতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি ঢাকাই মঞ্চ নাটকে একজন প্রাণ ভোমরা হয়ে ওঠেন। নাট্য পাড়ায় হুমায়ূন ফরীদি তখন শক্তিমান অভিনেতাদের একজন। নন্দিত অভিনেতা আফজাল হোসেন সহ অন্যান্যদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে বিটিভিতে অভিনয়ের সুযোগ পান। আতিকুল হক চৌধুরীর নিখোঁজ সংবাদ নাটকের মাধ্যমে টেলিভিশন জগতে অভিষেক হয় হুমায়ূন ফরীদির। তবে ১৯৮৩ সালে সেলিম আল দীনের রচনা ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিচালনায় জনপ্রিয় প্যাকেজ নাটক ভাঙনের শব্দ শুনিতে দাড়ি টুপিওয়ালা গ্রামের মিচকা শয়তান সেরাজ তালুকদারের যে চারিত্রিক রুপ তিনি দিয়েছিলেন তা হয়ে যায় ইতিহাস। এরপর একে একে করেছেন হঠাৎ একদিন, দূরবীন দিয়ে দেখুন, কোথাও কেউ নেই, বকুলপুর কতদূর, ভরের হাট সহ অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয়। তাঁর নাটক মানেই ছিল বিটিভির পর্দায় দর্শকের চোখ আটকে যাওয়া। তিনি কখনোই দর্শকদের হতাশ করেননি।


ফরীদি ১৯৯০ এ পা রাখেন বাংলা চলচ্চিত্রের রুপালী পর্দায়। বানিজ্যিক ও বিকল্পধারা মিলিয়ে ২৫০টি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। নায়ক বা খলনায়ক দুই চরিত্রকেই ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তিনি। এক সময় বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক বাদ দিয়ে খলনায়ক চরিত্রে তাকে দেখতেই হলে যেতেন দর্শক। আর তা সম্ভব হয়েছিল ফরীদির অভিনয় দক্ষতার কারনে। ২০০৩ সালে চলচ্চিত্র থেকে সরে যান হুমায়ূন ফরীদি। ধীরে ধীরে সিনেমা হলের দর্শক কমতে শুরু করে। তাঁর অভিনীত শেষ সিনেমা এককাপ চা মুক্তি পায় ২০১৪ সালে।
বাংলা নাটকে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা ও ২০০৪ সালে মাতৃত্ব সিনেমায় সেরা অভিনেতা হিসেবে অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অতিথি শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে।
ভোজন রসিক এই গুণী মানুষটি সব সময় বলতেন, পৃথিবীর সকল সৃষ্টিশীল মানুষেরা খেতে ভীষন পছন্দ করেন। খেলাধুলায় ক্রিকেটের প্রতি ছিল তার অনেক দুর্বলতা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট টিমে সর্বদাই ছিলেন এগিয়ে। শচীন টেন্ডুলকার ছিলেন তার প্রিয় ব্যাটসম্যান আর বাংলাদেশের বাইরে প্রিয় দল শ্রীলঙ্কা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি পাখি শিকার বন্ধ হয়েছিল হুমায়ূন ফরীদির হাত ধরে। বাঁচো এবং বাঁচতে দাও এমন ধারনায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কাউকে টাকা ধার দিলে বেমালুম ভুলে যেতেন তিনি। তাই আর টাকা চাওয়াও হতো না তাঁর। একবার নাটকের সেটে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীকে ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে দেখেন হুমায়ূন ফরীদি। একদিন চঞ্চলকে বাসায় দাওয়াত করেন। চঞ্চল তখন পাবনায়। ঢাকায় ফিরতে সেদিন রাত ২টা বেজেছিল। হুমায়ূন ফরিদীর দাওয়াত রক্ষায় তার বাসায় ছুটে যান চঞ্চল। সেখানে চঞ্চলের জন্য অপেক্ষা করছিল পঞ্চাশ রকমের ভর্তা। হোতা পাড়া থেকে স্যুটিং শেষ করে বাসায় ফেরার সময় রাত দুইটায় মাঝ পথে হঠাৎ একদিন মনে হল, প্রোডাকশনের ইসমাইলকে টিপস দেয়া হয়নি। যেই ভাবা সেই কাজ আবারও গাড়ি ঘুরিয়ে ইসমাইলকে টিপস দিয়ে ঢাকায় ফেরেন ফরীদি । এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে তাঁর নামের পাশে। যেগুলো তাঁর বিশাল হৃদয়ের পরিচয় দেয়।ফরিদী বিশ্বাস করতেন সবাই ছেড়ে গেলেও বন্ধুরা ছেড়ে যায় না। তাই তাঁর কাছে বন্ধুত্বটাই বড় ছিল।