সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
আনন্দ আলো প্রতিবেদন
বঙ্গবন্ধু। একটি নাম। একটি দেশের স্থপতি। দেশটির নাম বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। বঙ্গবন্ধু, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। যাঁর জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বছরের হিসেবে তিনি প্রায় ১৩ বছর কারাগারে ছিলেন। শুধুমাত্র দেশের মানুষের পক্ষে কথা বলার অপরাধে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী তাঁকে বার বার জেলে পাঠিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আসলে আমাদের জ্ঞান হওয়ার পর যেটা হয়েছে, আমরা দেখতাম আব্বা জেলখানায়। ১৯৪৯ সালে আব্বা একবার গ্রেফতার হন। একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জেলখানায় ছিলেন। তাঁকে যখন জেলে নেওয়া হয় তখন আমার ছোট ভাই (শেখ কামাল) খুবই ছোট। আব্বাকে সেভাবে দেখার সুযোগ পায়নি। কাজেই আমি যখন আব্বা আব্বা বলে কাছে যেতাম, কামাল খুব অবাক হয়ে দেখত। তখন জিজ্ঞেস করতো, তোমার আব্বাকে কি আমি একটু আব্বা বলতে পারি?’ (সূত্র-২০১২ সালে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’)
জাতি হিসেবে আমরা খুবই ভাগ্যবান যে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে পেয়েছিলাম। যিনি নিজের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দের কথা মোটেও ভাবেননি। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য মঙ্গল ভাবনাই ছিল তাঁর আজীবনের সংগ্রাম। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখন শুধু একটি দেশের নেতা নন। আন্তর্জাতিক পরিসরেও এখন তিনি মহান নেতা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এখন বিশ্ব স্বীকৃত শ্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদায় অভিষিক্ত। জাতিসংঘের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবার ৬টি ভাষায় পুস্তক আকারে প্রকাশ হয়েছে। শততম জন্ম বর্ষে আমাদের বঙ্গবন্ধু দেশ বিদেশে আরও বেশী উজ্জ্বল, আলোকিত ও অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ বিশ্বে এখন সমীহ জাগানিয়া একটি দেশ। এজন্য অবশ্য বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। তাঁর দুরদর্শী নেতৃত্বে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।
১৯২৭ সালে সাত বছর বয়সে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিধ্যালয়ে ভর্তি হন। নয় বছর বয়সে গোপালগঞ্জ পাবলিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। বাবা শেখ লুৎফর রহমানের বদলি জনিত কারণে ১৯৩১ সালে মাদারিপুর ইসলামীয়া বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেনিতে ভর্তি হন। ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত সেখানেই লেখা পড়া করেন। ১৯৩৪ সালে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর হৃৎপিন্ড দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৩৬ সালে চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ে এবং চোখের অপারেশন করাতে হয়। এ থেকে সুস্থ হতে বেশ সময় লেগেছিল। যে কারণে ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ সাল প্রায় চার বছর বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে নিতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। ১৯৩৮ সালে সুস্থ হবার পর গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ বর্তমান নাম মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতায় ইসলামীয়া কলেজে লেখাপড়ার সময় তিনি বেকার হোষ্টেলের ২৪ নং কক্ষে থাকতেন। ১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর সম্মানার্থে ২৩ ও ২৪ নম্বর কক্ষকে একত্র করে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ’ তৈরি করে। ২০১১ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি কক্ষটির সামনে তাঁর আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। ভারত বিভাজনের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হন। তবে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবী-দাওয়ার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার বিরুদ্ধে কথা বলার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯৪৯ সালে বহিস্কার করে। ২০১০ সালের ১৪ই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই বহিস্কারদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।
বঙ্গবন্ধু ও মাতৃভাষা সংগ্রাম
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা ঘটে।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষনা দেন। পূর্ব পািকস্তানে শুরু হয় বিরুপ প্রতিক্রিয়া। প্রতিবাদী শেখ মুজিব অবিলম্বে মুসলীম লীগের এই পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্তে বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে একই বছর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহনে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করা হয়। শেখ মুজিব একটি প্রস্তাব করেছিলেন যা থেকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঐ পরিষদের আহবানে ১১ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালন কালে শেখ মুজিব সহ আরও কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। ছাত্র সমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিব ও অন্যান্য ছাত্র নেতাকে মুক্তি দেয়া হয়। তাদের মুক্তি উপলক্ষে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শোভা যাত্রা হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। ১৫ মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়। ১৭ মার্চ ১৯৫৪ দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের অধিকার আদায়ে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। একই সময় ফরিদপুরে কর্তন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় ১১ সেপ্টেম্বর তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়।
১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। জেল থেকে বেরিয়ে আবারও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এবার তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জরিমানা করা হয়। এই জরিমানা প্রদানে বিরত থাকেন তিনি। এ সময় তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়।
২৬ জুন, ১৯৪৯ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আবারও মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিব। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের পূর্ব পাকিস্তানে আগমনকে উপলক্ষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ ঢাকায় দূর্ভিক্ষ বিরোধী মিছিল বের করে। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে আবারও মুজিবকে আটক করা হয়। এবারে দুই বছর জেলে রাখা হয়। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারী মুজিবের জেল মুক্তির আদেশ পাঠ করার কথা থাকলেও খাজা নাজিমউদ্দিন ঘোষনা করেন উর্দুই ‘পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’। এ ঘোষণার পর জেলে থাকা সত্বেও প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পরোক্ষভাবে পরিচালনার মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আয়োজনে তিনি সাহসী ভূমিকা রাখেন। এরপরই ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে রাষ্ট্রভাষার দাবি আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তখনও মুজিবকে জেলে আটকে রাখা হয়। শেখ মুজিব জেলে থেকে অনশন করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৪ই ফেব্রুয়ারী অনশন শুরু হলে টানা ১৩ দিন পর ২৬ ফেব্রুয়ারী তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
৪৬৮২ দিনের জেল জীবন : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ৭ দিন কারাভোগ করা থেকে শুরু হয় জেল জীবন। বাকি ৪ শত হাজার ৩৭৫ দিন কারা ভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। বছর হিসেবে দিন গুলোকে সাজালে প্রায় ১৩ বছর কারাগারে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৩৮ সাল। গোপালগঞ্জ হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির সহপাঠী, বন্ধু আব্দুল মালেককে মারপিট করা হলে শেখ মুজিব সেই বাড়িতে গিয়ে ধাওয়া করেন। সেখানে হাতাহাতির ঘটনা ঘটলে হিন্দু মহাসভার নেতাদের কৃত মামলায় শেখ মুজিবকে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার করা হয়। মিমাংসার মাধ্যমে মামলা তুলে নেয়া হলে ৭ দিন পর মুক্তি পান শেখ মুজিব। ১৯৪১ সালে অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র লীগের ফরিদপুর জেলা শাখার সহ সভাপতি থাকা অবস্থায় বক্তব্য প্রদান এবং গোলযোগের সময় সভাস্থলে অবস্থান করায় দুইবার সাময়িকভাবে গ্রেফতার করা হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালে ১১ই মার্চ থেকে ১৫ই মার্চ পাঁচ দিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্ত পান ১৯৪৯ সালে ২১ জানুয়ারী। এবার ছিলেন ১৩২ দিন। ১৯৪৯ সালের ১৯ শে এপ্রিল আবারও তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ৮০ দিন কারা ভোগের পর ২৮ জুন তাকে মুক্তি দেয়া হয়। একই বছর ১৯৪৯ সালের ২৫ শে অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন এবং ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয় লাভ করার পরও শেখ মুজিবকে ২০৬ দিন কারাভোগ করতে হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামারিক আইন জারির পর ১১ অক্টোবর শেখ মুজিব আবার গ্রেফতার হন। এ সময় টানা ১ হাজার ১৫৩ দিন তাকে কারাগারে রাখা হয়। ১৯৬২ সালের ৬ই জানুয়ারি আবারও গ্রেফতার হয়ে মুক্তি পান একই বছরের ১৫ জুন। এ দফায় কারাগারে কাটে ১৫৮ দিন। ১৯৬৮ ও ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে ৬৬৫ দিন ছিলেন কারাগারে। ছয় দফা প্রস্তাব দেয়ার পর যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গ্রেফতার হয়েছেন। ঐ সময় তিনি ৩২টি জনসভা করে ৯০ দিন কারাভোগ করেছেন। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে আবার গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ এর ২২শে ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ দফায় কারাগারে কেটে যায় ১ হাজার ২১ দিন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষনা দেয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করে। এ দফায় কারাগারে ছিলেন ২৮৮ দিন।
বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজবন্দী হিসেবে কারাগারে থাকার সময় তিনটি বই রচনা করেন। তিনটি বই সুখপাঠ্য, তথ্য সমৃদ্ধ ও নিঃসন্দেহে সময়ের দলিল। সময়কে খুঁজে পাওয়া যায় বই গুলোতে। বইটিতে এক দিকে ব্যক্তি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা মগ্নতা গভীর ভাবে রুপায়িত হয়েছে, অন্য দিকে রাজনৈতিক জীবন তখনকার সময়ের পটভূমিতে চমৎকার ভাবে তিনি তুলে ধরেছেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রথম বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। এটি লেখা হয়েছিল ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে। যখন তিনি কারারুদ্ধ। আত্মজীবনীর শুরু হয়েছে তাঁর জন্মের সময় থেকে। বইটির শেষ টানা হয়েছে ১৯৫৪ সালের ঘটনাবলি দিয়ে। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীটি শেষ করতে পারেননি। কিন্তু সরল প্রাঞ্জল ভাষায় নির্মোহভাবে ঘটনাবলীর বর্ণনা থাকার কারণে, সময়ের ঐতিহাসিক বিবরণ থাকার কারণে পাঠক তরতর করে এগিয়ে যেতে পারেন।
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। বাঙালী ও বাংলাদেশের অধিকার ও স্বতন্ত্র মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এদেশের গণমানুষের মুক্তির জন্য পরিচালিত সকল আন্দোলনে ছিলেন প্রধান চালিকাশক্তি। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এদেশের মুক্তিকামী মানুষেরা। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা অর্জণ করেছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। তিনি আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, মুক্তির দিশারি। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কখনও বিচ্ছিন্ন করে ভাবার অবকাশ নেই। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক তিনি। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের এক আপোসহীন সংগ্রামী নেতা তিনি। আমাদের বিস্তৃত জাতিসত্তাকে তিনিই জাগ্রত করেছেন। আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন মুক্তির সংগ্রামে।
স্বাধীন মত প্রকাশের পক্ষে। শোষণ ও বঞ্চনার বিপক্ষে ছিলেন অতন্ত্র প্রহরী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্ন’র নির্বাচন, আটান্নর’র সামরিক শাসন বিরোধী আনোন্দাল, উনসত্তরের গণঅভ্যত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং প্রকাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান তাঁর গণতান্ত্রিক চেতনা, শৃঙ্খল ও শোষণমুক্তির উদগ্র বাসনাকেই আমাদের সামনে তুলে ধরে।
নিজের ব্যক্তি সত্তাকে রুপান্তর করেছিলেন বাঙালি জাতিসত্তায়। নিজের স্বার্থকে জাতির স্বার্থে বিলীন করেছেন। তাই তো পরিণত হয়েছিলেনÑ বাংলার সব বর্ণের, সব ধর্মের, সব মানুষের এক অবিসংশদিত নেতায়।
একটি মঞ্চ সাজানো হয়েছে। মঞ্চের সামনে অপেক্ষারত লাখো মানুষ। ধীর পায়ে স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এগিয়ে এলেন মাইকের সামনে। শুরু হলো এক অবিস্মরনীয় ভাষণ। সামনের জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলনরত মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যার কথা তুলে ধরেন। উল্লেখ করেন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনার কথা। ‘আমি পরিস্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে কোর্ট, কাছারি, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইলÑ প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’
যযেন আগুনের অক্ষরে লেখা এক দীর্ঘ কবিতা, আবৃত্তি করে যাচ্ছেন কবি নিজেই। অবশেষে তাঁর মুখ থেকেই ঘোষণা এলো এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে, বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ব্যর্থ হলে নেমে আসে ২৫ শে মার্চের ভয়াল সেই কাল রাত। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর শুরু হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরোচিত সশস্ত্র আক্রমন। চলতে থাকে গণহত্যা। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। তার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা করেন।
এক ওয়ারলেস বার্তায় তিনি বলেন, এটাই হয়তো আমার শেষবার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।
কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেনÑ রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। কখনও নীতির প্রতি আপোস করেননি আমাদের মহান নেতা। বারবার জেলে গেছেন আবার বীরের মতো বেরিয়েও এসেছে। সবশেষে স্বাধীন বাংলাদেশে খুনিদের বুলেটে মৃত্যুবরণ করেও হয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়ী। ঘাতকচক্র তাঁকে হত্যা করলেও তাঁর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি।
ছবি : বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, নাসির আলী মামুন, পাভেল রহমান ও সংগ্রহ