Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস


এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্থানী বাহিনীকেও এ দেশীয় কুলাঙ্গার রাজাকার ও তাদের দোসরদের পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল বীর বাঙ্গালীর সন্তানরা।
দেশ স্বাধীন হয় ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন যার আহবানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা ও আপমর জনতার সেই অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্থানের মিনওয়ালী কারাগারে। অগ্নি পরীক্ষায় অন্তরীনাফলে স্বাধীনতা এলেও মহান নেতার অনুশ্বস্থিতি অ—নতা ও শূন্যতায় থেকে ছিল বিজয়ের গৌরব অর্জনও উদযাপন। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে বাঙআলীর মুক্তির অগ্রদূত ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের মাটিতে পদার্পণ করেন। সেই থেকে এদিনটিকে বাঙালী জাতি পালন করে আসছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসাবে। প্রতি বছরের —– বদালের আর তো ফিরে এল সেই ঐতিহাসিক স্মৃতিময় দিন ১০ জানুয়ারী এ বারের স্বদেশ প্রত্যাবতন দিবস। অনন্য উচ্চতার সমাহার মনে করি মুজিব বর্স হিসাবে। সেই সাথে সারা পৃথিবীর ন্যায় অতিমারী মহামারীর ফলে বাংলাদেশও ক্ষত বিক্ষত দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছে। তারই মাছে ফিরে এসেছে ১০ই জানুয়ারী। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবসের প্রাক্কালটি এখন যত সহজ মনে হয় তখন তত সহজ ছিলনা। পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই পাকিস্থানী জালেম বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর আত্ম সমর্থন করেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রহসনের নাটক করেছে। বিচারের নামে সময় ক্ষেপন করে প্রচন্ড মানসিক অত্যাচার করে জর্জরিত করেছে মহান নেতাকে।
ঐতিহাসিক ১০ই জানুয়ারী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক ইতিহাসে অনন্য মাইলফলক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ১০ই জানুয়ারী। স্বদেশ প্রত্যবতন দিবস যেদিনে মহান নেতার আসার আগমনে মুখে মুখে আসার খবর শুনে লক্ষ লক্ষ জনতা সারা দেশ থেকে এসে জড়ো হয় তেজগাঁও বিমান বন্দরে ও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বয়স গত কারণে তখন বাবার মুখেও রেডিওতে শুনেছি মহান নেতার আগমন। স্থানীয় জনগন ও মুক্তিযোদ্ধারা একসাথে অস্ত্রহাতে করেছে আনন্দ মিছিল যা বালক হৃদয়ের মানস পটে ভেসে ওঠে বার বার। সেদিনটি কেমন ছিল কারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অংশগ্রহণ করেছিল এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারি হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা ও আনন্দশ্রুর কথা।
জাতির পিতা লন্ডন থেকে দীল্লী হয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। তৎকালিন তেজগাঁও বিমান বন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে লাখ রাখ মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতাও ভালোবাসা প্রদর্শন করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতার সময় লেগেছিল প্রায় তিন ঘণ্টা। কোটি কোটি জনতা গগনবিদারী শ্লোগানে ঢাকার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। লও লও লও সালাম জাতির পিতা শেখ মুজিব। মহান নেতা যেদিন সমবেত সকলের উদ্দেশ্যে সম্মোহনী বক্তব্যে আবেগ তাড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি ভালবাসি আমার মাটিকে। ভালবাসি দেশকে, ভালবাসি এ দেশের মানুষকে। তখন জনতার কান্না ও আহাজাড়িতে চোখের জল গড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দুর্বাঘাস শিশির ভেজা সকালের —– চিক্ চিক্ করে উঠে।
অতঃপর ক্লান্ত শ্রান্ত বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন,
আজকের এই শুভলগ্নে আমি সর্বপ্রথম আমার দেশের সংগ্রামী কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সেই বীর শহীদদের কথা স্মরণ করছি, যাঁরা গত নয় মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আমি তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার সোনার বাংলা আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ইয়াহিয়া খাঁর কারাগারে আমি প্রতি মুহূর্তে প্রতীক্ষা করেছি। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুতও ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে মুক্ত হবে, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তবে, এই মুক্তির জন্য যে মূল্য দিতে হল, তা কল্পনারও অতীত। আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর ইতিহাসে কোন দেশের মুক্তিÑ সংগ্রামে এত লোকের প্রাণহানির নজীর নাই। আমার দেশের নিরীহ মানুষদের হত্যা করে তারা কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছে, আমার মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করে তারা জঘন্য বর্বরতার পরিচয় দিয়েছৈ। সোনার বাংলার অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়ে তারা ছারখার করে দিয়েছে। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দীশালায় থেকে আমি জানতাম তারা আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু তাদের কাছে আমার অনুরোধ ছিল, আমার লাশটা তারা যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়, বাংলার পবিত্র মাটি যেন আমি পাই। আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলাম, তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে বাংলার মানুষদের মাথা নিচু করব না।
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী ক’রে মানুষ করনি।’ কিন্তু আজ আর কবিগুরুর সে কথা বাংলার মানুষের বেলায় খাটে না- তাঁর প্রত্যাশাকে আমরা বাস্তবায়িত করেছি। বাংলাদেশেল মানুষ বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে, তারা বীরের জাতি, তারা নিজেদের অধিকার অর্জন করে মানুষের মত বাঁচতে জানে। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক ভাইয়েরা আমার, আপনারা কত অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন, গেরিলা হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, রক্ত দিয়েছেন দেশমাতার মুক্তির জন্য। আপনাদের এ রক্তদান বৃথা যাবে না।
আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার জনসাধারণের প্রতি আমাদের এই মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন দানের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমার দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারত সরকার ও ভাতের জনসাধারণ নিজেদের অনেক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই ছিন্নমূল মানুষদের দীর্ঘ নয়মাস ধরে আশ্রয় দিয়েছেন, খাদ্য দিয়েছেন। এ জন্য আমি ভারত সরকার ও ভারতের জনসাধারণকে আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আমার অন্তরের অন্তস্থল হতে ধন্যবাদ জানাই।
গত ৭ই মার্চ এই ঘোড়দৌড় ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সগ্রামÑ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতার এনেছেন। আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই একতা বজায় রাখুন। ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালীর প্রাণ থাকতেও আমরা এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীণ রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে, এমন কোন শক্তি নেই।
আজ সোনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হারা। তারা নিঃসম্বল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি আমার এই দুঃখী মানুষদের সাহায্য দানের জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি।
নেতা হিসেবে নয়, ভাই হিসেবে আমি আমার দেশবাসীকে বলছি, আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, তাহলে আমাদের এ স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবেÑ পূর্ণ হবে না। আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে, সেগুলো মেরামত করতে হবে। আপনারা নিজেরাই সেসব রাস্তা মেরামত করতে শুরু করে দিন। যার যা কাজ, ঠিকমত করে যান। কর্মচারীদের বলছি, আপনারা ঘুষ খাবেন না। এদেশে আর কোন দুর্নীতি চলতে দেয়া হবে না। প্রায় চার লাখ বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানে আছে। আমাদের অবশ্যই তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। বাংলাভাষী নয় এমন যারা বাংলাদেশে আছেন, তাদের বাঙালীদের সাথে মিশে যেতে হবে। কারও প্রতি আমার হিংসা নেই। অবাঙালীদের প্রতি কেউ হাত তুলবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। অবশ্য যেসব লোক পাকিস্তানী সৈন্যদের সমর্থন করেছে, আমাদের হত্যা করতে সাহায্য করেছে, তাদের ক্ষমা করা হবে না। সঠিক বিচারের মাধ্যমে তাদের শাস্তি দেয়া হবে।
আপনারা জানেন, আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা দাঁড় করানো হয়েছিল এবং অনেকেই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছৈ, আমি তাদের জানি। আপনারা আরও জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার জেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, ‘আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলার আমার ভাষা। জয় বাংলা’।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার পূর্বে আমার সহকর্মীরা আমাকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। আমি তখন তাঁদের বলেছিলাম, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে আমি যাব না। মরতে হলে আমি এখানেই মরব। তাজউদ্দিন এবং আমার অন্যান্য সহকর্মীরা তখন কাঁদতে শুরু করেন।
আমার পাকিস্তানী ভাইয়েরা, আপনাদের প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ নেই। আমি চাই আপনার সুখে থাকুন। আপনাদের সেনাবাহিনী আমাদের অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে, আমাদের মা- বোনদের মর্যাদাহানি করেছে, আমাদের গ্রামগুলো বিধ্বস্ত করেছে। তবুও আপনাদের প্রতি আমার কোন আক্রোশ নেই। আপনারা স্বাধীন থাকুন, আমরাও স্বাধীন থাকি। বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের সাথে আমাদের যে ধরনের বন্ধুত্ব হতে পারে, আপনাদের সাথেও আমাদের শুধুমাত্র সেই ধরনের বন্ধুত্ব হতে পারে। কিন্তু যারা অন্যায়ভাবে আমাদের মানুষদের মেরেছে, তাদের অবশ্যই বিচার হবে। বাংলাদেশে এমন পরিবার খুব কমই আছে, যে পরিবারের কোন লোক মারা যায়নি।
বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেম। ইন্দোনেশিয়ার পরেই এর স্থান। মুসলিম জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারতের স্থান তৃতীয় ও পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ইসলামের নামে এদেশেল মুসলমানদের হত্যা করেছে, আমাদের নারীদের বেইজ্জত করেছে। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না, আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক। এদেশের কৃষক-শ্রমিক হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।
আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে শ্রদ্ধা করি। তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ রাজনীতি করছেন। তিনি শুধু ভারতের মহান পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর কন্যাই নন, পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর নাতনীও। তাঁর সাথে আমি দিল্লীতে পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করেছি। আমি যখনই চাইব, ভারত বাংলাদেশ থেকে সৈন্যবাহিনী তখনই ফিরিয়ে নেবে। ইতিমধ্যেই ভারতীয় সৈন্যের একটা বিরাট অংশ বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।
আমার দেশের জনসাধারণের জন্য শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যা করেছেন, তার জন্য আমি তাঁকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার মুক্তির জন্য বিশ্বের সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট আবেদন জানিয়েছিলেন, তাঁরা যেন আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ জানান। আমি তাঁর নিকট চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব।
প্রায় এক কোটি লোক যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং বাকী যারা দেশে রয়ে গিয়েছিল, তারা সবাই অশেষ দুঃখকষ্ট ভোগ করেছে। আমাদের এই মুক্তিসংগ্রামে যারা রক্ত দিয়েছে সেই বীর মুক্তিবাহিনী, ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক সমাজ, বাংলার হিন্দু-মুসলমান, ই.পি.আর, পুলিশ, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্য আর সবাইকে আমার সালাম জানাই। আমার সহকর্মীরা, আপনারা মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার ব্যাপারে যে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেণ, তার জন্য আমি আন্তরিকধন্যবাদ জানাই। আপনাদের মুজিব ভাই আহ্বান জানিয়েছিলেন আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছেন. তাঁর নির্দেশ মেনে চলেছেন এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।
পাকিস্তানী কারগার থেকে আমি যখন মুক্ত হই, তখন জনাব ভুট্টো আমাকে অনুরোধ করেছিলেনÑ সম্ভব হলে আমি যেন দুদেশের মধ্যে একটা শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। আমি তাঁকে বলেছিলাম, আমার জনসাধারণের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে এব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। এখন আমি বলতে চাই, জনাব ভুট্টো সাহেব, আপনারা শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতেচায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথশ প্রাণ দেবে। পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে যে নির্বিচার গণহত্যা করেছে, তার অনুসন্ধান ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটা আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠনের আবেদন জানাচ্ছি।
আমি বিশ্বের সকল মুক্ত দেশকে অনুরোধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন এবং সত্বর বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য করে নেয়ার জন্য সাহায্য করুন।
জয় বাংলা।