সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
অধ্যাপক ড. রাকিব আহসান। বাংলাদেশের খ্যাতিমান একজন শিক্ষাবিদ এবং কাঠামোগত প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ। একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী হিসেবে দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাঠদান ও গবেষনার পাশাপাশি ভৌত স্থাপনার নকশা, নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষানাবেক্ষণে পরামর্শক হিসেবে কাজ করে চলেছেন। ১৯৯৫ সালে বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পাস করার পর পরই তিনি লেকচারার হিসেবে যোগ দেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। ১৯৯৭ সালে তিনি বুয়েট থেকে সিভিল এন্ড স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ২০০০ সালে জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে ভূমিকম্প কৌশল এর ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১০ সাল থেকে তিনি বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন। তিনি সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ ও জাতীয় দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০২১-২০২৫ প্রণয়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ এর তিনি আজীবন ফেলো মেম্বার। এবার শাহ সিমেন্ট ‘নির্মাণে আমি’তে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
অধ্যাপক ড. রাকিব আহসানের গ্রামের বাড়ি নওগা জেলার মান্দা থানার কালি গ্রামে। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবার নাম খন্দকার মো: মজিবুর রহমান। তিনি একজন স্বনামধন্য প্রকৌশলী ছিলেন। মা মরহুম রওশন আরা বেগম একজন গৃহিণী ছিলেন। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে ড. রাকিব আহসান সবার ছোট। বড় ভাই রাজিব আহসান একজন স্বনামধন্য প্রকৌশলী। তার ভগ্নিপতিরাও প্রকৌশলী।
স্কুল জীবন থেকে রাকিব আহসান সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শিশু-কিশোর সংগঠন করতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। বই পড়া ছিল তার পছন্দের বিষয়। ছোট বেলা থেকেই ড. রাকিব আহসান প্রকৌশলী হবার স্বপ্ন দেখতেন। হয়েছেনও সফল। নিজের আগ্রহ থেকেই প্রকৌশলী হওয়া তার। ইঞ্জিনিয়ার্স ইউনিভার্সিটি স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৮৬ সালে। ১৯৮৮ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। ১৯৯৫ সালে তিনি বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পাস করেই লেকচারার হিসেবে যোগ দেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। ১৯৯৭ সালে বুয়েট থেকে সিভিল এন্ড স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে পাড়ি দেন জাপানে। ২০০০ সালে জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে ভূমিকম্প কৌশল (আর্থকুয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং) স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বিদেশের স্বপ্ন যাত্রাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে দেশে ফিরে এসে দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন।
দেশে ফিরে এসে তিনি আবার শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০১০ সাল থেকে তিনি অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি কর্মজীবনে অধ্যাপক ড. রাকিব আহসান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে পঞ্চাশটির বেশি বিভিন্ন গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। যার মধ্যে কয়েকটি কনফারেন্সে বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ডস লাভ করেন। তিনি বেশ কয়েকটি স্নাতকোত্তর থিসিস তদারকি করেছেন। যার মাধ্যমে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠ্যক্রমে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে তিনি অত্যন্ত সক্রিয়।
অধ্যাপক ড. রাকিব আহসান কাঠামো কৌশলের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিভিন্ন শাখায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। তবে ভূমিকম্প কৌশলে আর্থকুয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং এ তার বিশেষ আগ্রহ আছে। বিভিন্ন ধরনের স্থাপনার ভূমিকম্প ঝুঁকি নিরুপণ, ভূমিকম্প সহনীয় ডিজাইন, কাঠামো মজবুতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার প্রচুর কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। এছাড়া তার এলাকা ভিত্তিক আপদকালীন পরিকল্পনা প্রনয়নে অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তিনি সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ ও জাতীয় দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০২১-২০২৫ প্রণয়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি ভবন ছাড়াও ব্রীজ, টাওয়ারের ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার কাঠামোর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করে থাকেন। কংক্রিট ও ইস্পাত উভয় ধরনের ম্যাটেরিয়ালের তৈরি স্থাপনা তিনি ডিজাইন করে থাকেন। ইটের বাড়িকে ভূমিকম্প প্রতিরোধী করে মজবুতায়নের ক্ষেত্রে ড: রাকিব আহসান বিশেষ দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন।
অধ্যাপক ড. রাকিব আহসান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যান পরিদপ্তরের সহযোগী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। পাশাপাশি দূর্যোগ প্রতিরোধ ও নগর সুরক্ষণ ইনস্টিটিউট এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত।
বুয়েটের একজন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ও পরামর্শক হিসেবে ছোট-বড় বেশ কিছু প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে কাজ করেছেন। যেমনÑ বাংলাদেশ ডিজিটাল সিকোরিটি এঞ্জেসির ফিজিবিলিটি স্ট্রাডির টিম লিডার হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এর ৩০ তলা ভবনের মজবুতীকরণে টিম লিডার হিসেবে ছিলেন। তেজগাঁও এ ডিপার্টমেন্ট অব টেলি কমিউনিকেশনের ইটের ভবন মজবুতীকরণ, চট্টগ্রামে জিপি এইচ ইস্পাত ফ্যাক্টরী বিল্ডিংয়ের ডিজাইন ভেটিংয়ের টিম লিডার হিসেবে কাজ করেছেন। রংপুর, সুনামগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও রাঙামাটিতে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়ের অধীনে ইউএনডিপির সঙ্গে ওয়ার্ড ভিত্তিক আপদকালীন পরিকল্পনার কাজ করছেন। মেডলার ফ্যাক্টরী বিল্ডিংয়ের অগ্নিকান্ড পরবর্তী মজবুতায়ন ডিজাইন, ব্র্যাক সেন্টার প্রয়োগে অগ্নিকান্ড পরবর্তী মজবুতীকরণ, এছাড়াও আরবান রিজিলিয়েন্স প্রজেক্ট রাজউকের ওয়ার্কিং গ্রুপের আহবায়ক হিসেবে কাজ করেছেন। ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশ চালু করতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। ভবন মজবুতায়নে স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার সম্প্রসারণ ঘটানোও ড. রাকিব আহসানের লক্ষ্য।
কীভাবে ভূমিকম্প সহনীয় বাড়ি তৈরী করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে ড. রাকিব আহসান বলেন, একটি বাড়িকে ভূমিকম্প সহনীয় করে তৈরী করতে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী আপনার ভবনের প্রকার (বিল্ডিং ক্যাটাগরি) সম্পর্কে প্রথমে নিশ্চিত হউন। ভবনের প্রকারের উপর ভিত্তি করে বাড়ি তৈরির বিভিন্ন পর্যায়ে সঠিক যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কারিগরি ব্যক্তি বা ফার্মকে নিয়োগ দিন। নিয়োগকৃত কারিগরি ব্যক্তি বা ফার্মকে বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি ডিজাইন ও নির্মাণ করার নির্দেশ দিন। কখনই বিল্ডিং কোড মানার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করবেন না কারণ তা আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একমাত্র বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করার বাড়িই ভূমিকম্প সহনীয় বাড়ি। মনে রাখবেন বিল্ডিং কোড অনুযায়ী একজন ডিজাইনার যে পরিমান রড ডিজাইনে উল্লেখ করেন তার থেকে কম বা বেশি রড ব্যবহার উভয়ই ভবনকে ঝুকিগ্রস্থ করতে পারে। ভবন নির্মাণের আগে জমির মাটি পরীক্ষা করা জরুরি। মান সম্মত নির্মাণ সামগ্রী (যেমন, সিমেন্ট, পাথর, বালি, রড ইত্যাদি) ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কংক্রিট মিশানোর সময় পরিমানমত পানি দিতে হবে। অতিরিক্ত পানি কংক্রিটের শক্তি কমিয়ে দেয়। কংক্রিট ঢালাইয়ের সময় পরীক্ষার জন্য সিলিন্ডার বানাতে হবে। যা পরীক্ষাগারে পাঠিয়ে পরীক্ষা করে কংক্রিটের শক্তি সম্বদ্ধে নিশ্চিত হতে পারে। রডের টেনশন টেস্ট করতে হবে। বাড়ি তৈরির সময় ঠিকমত সুপার ভাইস করতে হবে।
অধ্যাপক ড. রাকিব আহসান ২০০০ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম তনজনা রশীদ। এই দম্পতি দুই পুত্র সন্তানের জনক-জননী। বড় ছেলে রাইফ আহসান দিল্লি পাবলিক স্কুলে ১০ম শ্রেণীতে ও ছোট ছেলে জাফির আহসান ৫ম শ্রেনীতে অধ্যয়নরত। এই শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী ও দেশের অন্যতম একজন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ। তার কাজ সততাও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে ভালোবাসেন। নিজের পেশায় দায়বদ্ধ থেকে সেটাকে সততার সঙ্গে শেষ করতে চান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অধ্যাপক ড. রাকিব আহসান বলেন, সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ প্রয়োগে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে চাই। একই সাথে বিল্ডিং কোডের নিয়মিত ভাবে হালনাগাদ করণে আমি সকলকে উৎসাহিত করতে চাই। ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে চালু করার জন্য আমি কাজ করে যাচ্ছি। ভবন মজবুতায়নে স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহারে সম্প্রসারণ ঘটানোও আমার একটি লক্ষ। সাশ্রয়ী ভবন নির্মাণে আমি অবদান রাখতে চাই। সামগ্রিক ভাবে ভূমিকম্পের জন্য বাংলাদেশে দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও সহনশীলতা বৃদ্ধিতে আমি কাজ করতে সংকল্পবদ্ধ।