Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

রাবেয়া খাতুন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ

আফজাল হোসেন
মানুষের জীবন একটাই। আসা যাওয়া করা দিনগুলো প্রায়ই সে জীবনে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। সে ধারাবাহিক নতুনের কারণে জীবন বর্ণিল রয়, জীবনজুড়ে ঝিকমিক করে নতুনের স্বাদ। নতুন কষ্ট, শোক তার পিঠে নতুন উপলব্ধি- এ নিয়ম, প্রাত্যহিকতায় আমাদের বেঁচে থাকা আকর্ষণ হারায় না।
অনেক সৌন্দর্য, তার বিস্ময়ের ঘোর, বহু আনন্দ এবং হতাশার স্বাদও বেঁচে থাকাকে অর্থবহ, বিশেষ করে তোলে। জীবন, বেঁচে থাকা বিশেষ হয়ে ওঠে নানা রহস্যময়তার কারণেও। আপন মানুষ হারানোর বেদনাকে সে রহস্যময়তার অংশ মনে হয়।
আপন মানুষ হারানোর বেদনায় রহস্যময়তা কি, কেনো? আপন মানুষ চলে গেলে টের পাওয়া হয়, লাভার মত আগ্রাসী ভঙ্গীতে অনেক ঘন দুঃখ বুকের জমিন গ্রাস করে নিচ্ছে। এই অনুভব চিরকালীন। যাকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হতে হয়, জগতজমিনে থাকাকাকালীন নিজের সাধ্য সামর্থ দিয়ে নিজের কাছে কি পরিমানে বিশেষ ছিল সে মানুষটা, তা আগ্রহ ও আনন্দের সাথে জানান দেয়া হয় না। যা অবশ্য কর্তব্যের অংশ, জগতের বহুকিছুর গুরুত্ব দিতে গিয়ে সম্পর্কের জন্য যা করণীয়, তা করা হয়ে ওঠেনা। সম্পর্কের সুবাস অসচেতনতায় ফিকে হয়ে যায়।

কাছের মানুষ সহসা তারার দেশে উড়ে চলে গেলে আর কোনদিন দেখা হবেনা, এই বেদনার সাথে শোক বিহ্বল মনে কতরকমের প্রতিক্রিয়া জাগে। আরও বেশী সময় কেনো দিতে পারিনি তাঁকে, প্রশ্ন জাগে। জল ভেদ করে তিমির পিঠ যেমন ভুস করে জেগে ওঠে, তেমন করেই উত্তর মেলে- অবহেলা ছিল। সে বোধ গ্লানির সঞ্চার করে, মর্মের গভীরে ঢুকে পীড়া দেয়। তবু আমাদের বদল ঘটেনা, জীবন যেমন ছিল, থাকে তেমনই- এ এক অমোঘ রহস্য!
রাবেয়া খাতুন দেশের সন্মানিত কথাসাহিত্যিক। বন্ধুর মা এই পরিচয়ের কারণে নিকটের হওয়া সহজ হয়েছিল। তিনি লিখে যখন বিখ্যাত তখন শিল্পী হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে আমি গ্রাম থেকে এসেছি শহরে। অজ পাড়াগাঁ থেকে সোজা রাজধানীতে। টলমল পা, আত্মবিশ্বাসের অভাব।
ছবি আঁকা, লেখালেখির বাতিকের কারণে রাবেয়া খাতুনের পুত্র ফরিদুর রেজা সাগরের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পুরো পরিবারকে ভিতর ও বাইরে থেকে দেখার সুযোগ মেলে। তা ছিল বিশেষ। কারণ ভাই বোন বাবা মা, সবাই ছিল, ছিলেন বিশেষ। গ্রাম থেকে উজিয়ে আসা সেই আমার কাছে তা ছিল এক অপার বিস্ময়। টলমল কালে মানুষগুলোর উজ্জলতা আমার মলিনতায় পরিয়ে দিয়েছিল আলোর মালা।
দেশের সংস্কৃতি ভূবনে রাবেয়া খাতুন, ফজলুল হক ছিলেন বিশেষ। একজন লেখক অন্যজন সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা। অতএব স্বাভাবিক ভাবেই ঢাকা শহরের সকল কৃতির সঙ্গে তাঁদের ওঠাবসা। মা রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস ফেরারী সূর্য প্রকাশিত হবে। সে গ্রন্থের প্রচ্ছদ দেশখ্যাত শিল্পীদের কেউ আঁকবেন, এমনই হওয়ার কথা।
সাগর তার বাবার অফিসে নিয়ে গেলো আমাকে। তখন আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। পাশে দাঁড়ানো হ্যাংলা বন্ধুটাকে দেখিয়ে সাগরের আব্দার, ফেরারী সূর্যের প্রচ্ছদ ওকে দিয়ে আঁকাতে হবে। ভারী চশমার ওপার থেকে আমাকে নতুনভাবে দেখে নিয়ে বন্ধুর বাবা হাসলেন। এই হাসিটাকে বলা যায়, জীবনযাত্রায় দীপ্ত পায়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম অনুপ্রেরণা।

লেখক রাবেয়া খাতুন তা নাও মানতে পারতেন। ভাবতে পারতেন নামী দামী প্রচ্ছদশিল্পীর হাতেই তাঁর গ্রন্থের প্রচ্ছদ হওয়া উচিৎ। তা ভাবেননি। অখ্যাত আমি, খ্যাতিমানের গ্রন্থের প্রচ্ছদ আঁকতে পেরেছিলাম। এই গল্পে মানুষদের উদারতা চেনা হয়। স্বার্থের অংক কষে জীবনযাপন করা মানুষ ছিলেননা তাঁরা। তাঁদের জানা ছিলনা, বইয়ের প্রচ্ছদ আমাকে করতে দিলে কতটা সুন্দর করার সামর্থ আমার আছে কিন্তু নিজ সন্তানের কথায় আস্থা মিলেছিল। কতটা দৃঢ় বিশ্বাসের মানুষ তাঁরা ছিলেন, আজও ভেবে অবাক হতে হয়।
আমাদের স্বভাবের দৃঢ়তা ও দূর্বলতা কি তা আমরা ভেবে দেখা খুব জরুরী মনে করি না। স্বার্থপরের মতো জীবন, বেঁচে থাকাকে আমরা মন ডুবিয়ে উপভোগ করতেই চাই শুধু। ভোগ উপভোগের জন্য দাম দিতে হয়, কিছু কর্তব্যও থাকে, জানা থাকলেও ভুলে থাকি। মূহর্ত হুড়মুড়িয়ে আসে, তখন উপলব্ধি করতে পারি নিজের ত্রুটি। নিজে সন্তুষ্ট থাকার স্বার্থপর ইচ্ছা কতখানি ক্ষতিকর, তা বেদনাকে কতটা ভারী করে তা টের পাওয়া হয়। টের পেয়ে, উপলব্ধি করতে পেরে তখন অসহায় উপায়হীন লাগে।
এটা চেনা অচেনা রাবেয়া খাতুনকে সামান্য চেনার গল্প। সকলে তাঁকে খ্যাতিমান লেখক হিসাবে জানতেন। কারো কারো কাছে সাগর, প্রবাল, কেকা ও কাকলীর মা। মানুষের থাকে নানা পরিচয়। সব পরিচয়ের শেষে নানা মুখরতার মধ্যে থেকেও নিভৃতের, অজ্ঞাত মানুষ ছিলেন রাবেয়া খাতুন। ধীরস্থির, মিতভাষী আর সর্বদা মুখে লেগে থাকতো সামান্য একটুখানি হাসি। সে হাসি যেনো অপার এক রহস্যময়তা, তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রধান আকর্ষণ।
সময় জানতো, সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা মানুষ তিনি। মধ্যবিত্ত, সাধারণ হয়েও চিন্তা চেতনায় ছিলেন অসাধারণ।
ছবি আঁকার ছাত্র, পুত্র সাগরের সাথে লেখালেখি করি, টেলিভিশনে অভিনয়, উপস্থাপনা করি- এসব তিনি জানতেন। যখন অভিনয়শিল্পী পরিচয়টা তৈরি হলো, ছেলের বন্ধুর প্রতি যে স্নেহ ভালোবাসা, তা বিশেষ হয়ে রইলো না। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, পুত্রের বন্ধু, এ পরিচয়ের চেয়ে নতুন অর্জন করা পরিচয়কেই বিশেষভাবে গন্য করে নিলেন।
অনুভব করেছি, হাত পা নাক চোখ অলা মানুষ পরিচয়ের মানুষের চাইতে, তিনি মানুষের বিশেষ অস্তিত্বকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া জরুরী মনে করতেন। বিস্মিত হয়েছি, চারপাশের মধ্যবিত্ত ধুলো কাদা থেকে বিস্তর দূরত্বে নিজেকে নিয়ে নিজ জগত কিভাবে গড়েছেন, কিভাবে প্রচলিতকে উপেক্ষা করে নিজের মতো করেই জীবনযাপন করেছেন!

যে মানুষ ছবি আঁকে, অভিনয় করে এমন পরিচয় বিশেষ সন্মানীয়, সমীহযোগ্য- মনে করতেন বলে ছেলের বন্ধু পরিচয়টা ক্রমে ফিকে হয়ে গিয়েছিল। তিনিও বন্ধুর মা- এ সম্পর্ক আঁকড়ে ধরে থাকেননি। বয়সের ভেদভাবনাও তাঁর মগজে ঠাঁই পাওয়ার কথা নয়। সৃজনশীল মন যেমন যতটা উন্মুক্ত হওয়ার কথা, ততটাই খাপখোলা ছিলেন। কতখানি আধুনিকমনষ্কতা, তাঁর লেখকসত্বা কতটা প্রবল ছিল, এই উদাহরণে স্পষ্ট হয়।
সম্পর্কের বিশেষ মূল্য দেবার প্রতি বিশেষ মনোযোগী নই আমরা। এই নির্মম সত্য অনুধাবন করা হয়, প্রিয় মানুষের তিরোধানে। তাঁকে হারানোর বেদনা দ্বিগুন হচ্ছে দুটো অসাধারণ স্মৃতির কথা ভেবে। একবার ইন্দোনেশিয়ায় ও আর একবার বগুড়া থেকে ঢাকার দীর্ঘ পথে গাড়িতে অনন্য রাবেয়া খাতুনকে আবিষ্কার করার সুযোগ ঘটেছিল। এমন অজস্র সুযোগে প্রতিবার নতুন করে তাঁকে জানতে পারতাম। চলে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে সে চেষ্টা করিনি কেনো!
সৃষ্টিকর্তা রহস্য, তামাশাপ্রিয়। তিনি হারানোর বেদনা বিষাদে প্রিয় মানুষকে হাজার গুন বেশী অনুভব করার সাধ্য দেন।