Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বিদায় নাট্যমঞ্চের অধিপতি!

কোন পরিচয়ে তিনি বড়? একজন নাট্য ব্যক্তিত্ব? নাকি সংগঠক? নাকি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠ যোদ্ধা? অথবা নাট্য পরিচালক, তুখোর অভিনেতা, নাকি ঈর্ষনীয় কর্পোরেট তারকা? অথবা সবার প্রিয় ছটলু ভাই? দীর্ঘ দেহী, অসম্ভব হাসি-খুশী থাকা একজন মানুষ। সাধারনের ভীড়ে অনন্য সাধারন ব্যক্তিত্ব তিনি। নাম তার আলী যাকের। এক নামেই যার ব্যাপক পরিচিতি। দেশের প্রগতির্শীল সাংস্কৃতি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব আরী যাকের। মঞ্চ ও গণ্য মাধ্যমের উজ্জ্বল নক্ষত্র দেশ বরেণ্য নাট্যজন। ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের রতনপুরে তাঁর জন্ম। পৈত্রিক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীননগরে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় আলী যাকের ঢাকার সেন্ট গ্রেগরী স্কুল থেকে ম্যাট্টিক ও নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স সহ স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি।
১৯৭২ সালে আরন্যক নাট্যদলের কবর নাটকে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে নাটকের সাথে তাঁর পথচলা শুরু হয়। ১৯৭৩ সাল থেকে জড়িয়ে যান দেশের শীর্ষস্থানীয় নাট্য সংগঠন নাগরিকে। বাকী ইতিহাস, সৎ মানুষের খোঁজে, দেওয়ান গাজির কিসসা, নূরুলদিনের সারাজীবন, কোপেনিগের ক্যাপটেন, গ্রালিলিও, ম্যাকবেথ সহ অনেক আলোচিত মঞ্চ নাটকের অভিনেতা ও নির্দেশক তিনি। শেষ বয়সে এসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তখন অভিনয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেও ২০১৯ সালে আবার তার অনেক পছন্দের নাটক গ্যালিলিওতে অভিনয় করেন। এই নাটকে বিশিষ্ট নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূরের সাথে তার অভিনয় জুটি মঞ্চের দর্শকদের অনেক আগ্রহ ও আনন্দের বিষয়।
মঞ্চের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রেও একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিরেন আলী যাকের। শারিরীক অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে নয় মুখে বলা সংলাপ আর অভিব্যক্তির যাদুকরী প্রতিভা ছড়িয়ে দর্শকদের মোহাচ্ছন্ন করতে পারতেন তিনি। আজ রবিবার, বহুব্রিহী, পাথর, দেয়াল সহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক টেলিভিশন নাটকে তার অভিনয়ের দ্যূতি দর্শকদের হৃদয় ছুয়েছে পরম মমতায়। বেতারেও ৫০টিরও বেশী নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। নদীর নাম মধুমতি ও লাল সালু চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় র্দশকদের মন ছুয়ে যায়।
সৌখিন আরোকচিত্রী হিসেবেও আলী যাকেরের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি এবং নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি ছিরেন। যুক্তরাজ্যের রয়াল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পুর্ন সদস্য নাট্যজন আলী যাকের পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মনীর চৌধুরী পদক, মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, নয়েন বিশ্বাস পদক সহ একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
দেশীয় বিজ্ঞাপন শিল্পের পুরোধা ব্যক্তিত্ব আলী যাকের এশোয়টিক থ্রি সিক্সটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বনামধন্য অভিনয় শিল্প সারা যাকের তার প্রিয়তমা স্ত্রী। ছেলে বিশিষ্ট অভিনেতা ইরেশ যাকের ও একজন কর্পোরেট তারকা।
বেশ কয়েক বছর ধরে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছিলেন আলী যাকের। শেষ দিকে কিছুটা সুস্থও হয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে বাসায়ও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাকে আর ধরে রাখা যায়নি। না ফেরার দেশের বাসিন্দাই হলেন তিনি। আলী যাকেরের বাবার ছিল বদলির চাকরি। পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে হলেও বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের কাজে এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরতে থাকে তাঁদের পরিবার। আলী যাকেরের প্রথম স্মৃতি ফেনীতে। সেন্ট গ্রেগরি থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ভর্তি হন নটর ডেমে, সেখান থেকে পাস করলেন ১৯৬২ সালে। পরে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নেন। তখনই যুক্ত হন ছাত্ররাজনীতিতে, করতেন ছাত্র ইউনিয়ন। স্নাতক শেষ হওয়ার পর ১৯৬৭ সালে চলে যান করাচি। সেখানেই করেছিলেন প্রথম অভিনয়। সেখানকার জাহাঙ্গীর কোর্টে থাকতেন ছোট-বড় সরকারি আমলারা। বাঙালিদের সংখ্যাও কম ছিল না। সেখানেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আলী যাকের গেলেন ভারতে, নিলেন প্রশিক্ষণ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তখন একটি ইংরেজি সার্ভিস চালু করে। সেখানেই কাজ শুরু করেন তিনি, প্রচারণা চালিয়েছেন, হয়েছেন শব্দসংগ্রামী।
মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে আলী যাকের যোগ দেন আরণ্যক নাট্যদলে। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ওই বছরেরই জুন মাসে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেন তিনি। তখন থেকে নাগরিকই তাঁর ঠিকানা। ‘বাকি ইতিহাস’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা’, ‘কোপেনিকের ক্যাপটেন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘ম্যাকবেথ’সহ অনেক মঞ্চসফল নাটকের নির্দেশক, নয়তো অভিনেতা ছিলেন তিনি। বিশ্বখ্যাত সব মঞ্চনাটক রূপান্তর করেছেন। মঞ্চের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেও পেয়েছিলেন বিপুল জনপ্রিয়তা। টেলিভিশনে ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি’, ‘পাথর দেয়াল’সহ বহু নাটকে অভিনয় করেন তিনি। এ ছাড়া ৫০টির বেশি বেতার নাটক করেছেন তিনি। বেশ কিছু চলচ্চিত্রেও করেছেন অভিনয়। টেলিভিশনের জন্য মৌলিক নাটক লিখেছেন। সমসাময়িক বিষয়ে পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন, বেরিয়েছিল বই, যার মধ্যে আছে ‘সেই অরুণোদয় থেকে’, ‘নির্মল জ্যোতির জয়’। আলী যাকের শখ করে ছবিও তুলতেন।
আলী যাকের ছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি, যুক্তরাজ্যের রয়াল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পূর্ণ সদস্য। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। তাঁর স্ত্রী স্বনামধন্য অভিনয়শিল্পী সারা যাকের, পুত্র ইরেশ যাকের ও কন্যা শ্রেয়া সর্বজয়া, পুত্রবধূ মিম রশিদ, নাতনি নেহাকে নিয়ে তাঁর সংসার। বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি গ্রুপের চেয়ারম্যান তিনি।