সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
মা দিবস আজ। সন্তানরা মাকে শুভকামনা জানান এই দিনে, জীবনে মায়ের অবদান স্মরণ করেন। মাকে নিয়ে লিখেছেন ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী ফারজানা ছবি…
কদিন থেকেই সন্ধ্যা পেরোলে ধূলি-ঝড় শুরু হয়… তার খানিক বাদেই মেঘ গর্জে বৃষ্টি। এক পশলা বৃষ্টির ঝাপটায় প্রায়ই জানালার পাশে রাখা আমার বই-খাতা সব ভিজে যায়। আজও তাই হলো, সন্ধ্যা নামার পরই ঝড়… দৌড়ে গিয়ে জানালার কপাট টেনে দরজার ছিটকিনিটা দিতেই টুকটুক শব্দ কানে এলো। হ্যাঁ, শব্দটা আমার চেনা… বহুদিনের চেনা। কয়েক পা এগিয়ে রান্নাঘরের কাছে গেলাম… আম্মা চা করছে আমার জন্য। এ সময়টা আমার ভীষণ প্রিয়। আসলে সময় নাকি সময়ের মধ্যে চা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা নীরব এই মানুষটি বেশি প্রিয়, থাক সে কথা এখন না-ই বলি।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে যে বাড়িটায়, তার অদূরেই রেললাইন ছিল। মাঝরাতে ট্রেনের হুইসেলে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যেত। চোখ খুলেই মাকে খুঁজতাম আর খুব কাঁদতাম। মনে হতো, মা বুঝি কোথাও হারিয়ে গেল। একই ভয় আবার পেয়েছিলাম, যেদিন আম্মার স্ট্রোক হলো। মনে হচ্ছিল মুহূর্তেই আমার সব শরীর অসাড়, অনড় হয়ে গেল, পৃথিবীর সবকিছু অচেনা। সত্যি ‘মা’ ছাড়া পৃথিবী এমনই অচেনা। বাঙালি মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। ‘মধ্যবিত্ত’ এবং ‘রক্ষণশীল’, এ শব্দ দুটির অদৃশ্য একটা দেয়াল আছে। এই দেয়াল ভাঙার সাহস এবং শক্তি এর মধ্যে বসবাস করা খুব কম মানুষেরই রয়েছে। আম্মা সেই গুটিকয়েক মানুষের একজন, যে কি না শতসহস্র সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার মেয়ে শিল্পী হবে। শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে যাননি, স্বপ্নের সেই অদেখা অজানা গন্তব্যহীন পথে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে চলতে শিখিয়েছেন। রোদের রং, সময়ের ঘ্রাণ, বাতাসের সুর, এদের সবার সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা আম্মাই করিয়ে দিলেন। আম্মা পাশে না থাকলে নিজেকে চেনার চেষ্টার এই সাহসই পেতাম না।
আমি তখন খুব ছোট, একবার আম্মাকে ভয় দেখাব ভেবে বাড়ির সদর দরজার রাস্তা পেরিয়ে একটা বাঁশঝাড়ে লুকিয়েছিলাম খানিকটা সময়। সেদিন আম্মাকে যেভাবে কাঁদতে দেখেছি, আজও তার সেই অসহায় মুখটা ভুলিনি। আম্মাকে দেখে আমি নিজেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এরপর আর কখনোই আম্মাকে অমন ভয় দেখাইনি। আম্মার হাত ধরে আরেকবার যেতে খুব ইচ্ছা করে উঠোনঘেরা ছেলেবেলার সেই বাড়িটায়, উঠোনের বাঁ-দিকটায় বিশাল একটা ডzমুরগাছের ঝোপ। আর সারাটা উঠোনে আম্মার বোনা সন্ধ্যামালতী আর শ্যামসোহাগীর ঘ্রাণ।
আমরা সাত ভাই-বোন। প্রত্যেককে নিজ নিজ ড়্গেত্রে নিজের মতো করে পরিপূর্ণভাবে গড়ে তোলার যুদ্ধটা আম্মাকেই একটু বেশি করতে হয়েছে। আর তা করতে গিয়ে তার নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়টুকু কখন হারিয়ে গেছে, আম্মা তা টেরই পায়নি। তবে এ নিয়ে আম্মার মধ্যে কখনো কোনো আফসোস দেখিনি। সন্তানের জীবনের মধ্যেই নিজের জীবনের সব সুখ খুঁজে নেওয়ার অসীম শক্তি সৃষ্টিকর্তা বোধ করি মায়েদেরই দেন।
ভীষণ ভালো গান করতেন আম্মা। কিন্তু সংসার, সন্তান এবং বাস্তবতায় সেই সুর হারিয়ে ফেলেছেন আম্মা। হয়তো সেজন্যই প্রতি মুহূর্তে আমার মধ্যে সেই হারিয়ে যাওয়া সুর খুঁজে বেড়ান। এমন রোদ-বৃষ্টি, আলোছায়া আর ঝড়ের ঝাপটা সামলে দিয়ে ছেঁড়া তারে সুর বেঁধে আমাদের জীবনের গল্প সাজিয়ে দিয়েছেন আম্মা। তারপর এলো আমার জীবনের আরেক নতুন গল্প।
মা হলাম আমি। বড় খোকার মুখটা দেখেই মনে হলো আমার সামনে খুলে গেছে জীবনের অজস্র অজানা দুয়ার। বেঁচে থাকার আর অন্যসব কারণ গৌণ হয়ে এক ও অদ্বিতীয় হয়ে উঠল কেবল একটি কারণ, আমার সন্তান। অদ্ভুত এক সুতীব্র মোহে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম আমি। এ মোহ অসীম, অনাদি। আম্মাই শেখালেন, ‘সন্তানকে নিয়ে শুরু হবে নতুন এক জীবন, নতুন এক স্বপ্নের পথ’। বড় খোকার যখন আঠারো মাস বয়স, ঠিক তখনই কোলে এলো ছোট খোকা। খোকারা দুজনই ছোট, তখন ওদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আমি। কেমন করে বাঁচিয়ে রাখব অভিনয় শিল্পী ছবিকে? তখন আবার টের পেলাম সেই হাতের স্পর্শ। আমার চিরচেনা সেই হাত, তবে এবার হাতজোড়া একটু রুগ্ণ, ধবল হাতে নীল শিরার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি, বয়স হয়েছে যে। কিন্তু শক্তি ও মনোবল ঠিক সেই আগের মতো, কমেনি এক ফোঁটাও। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় জীবনের গল্প, আর গল্পের ধারাবাহিকতা পরিপূর্ণতা দেয় এর প্রতিটি চরিত্রকে, যার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে বিস্ময়কর সব সুন্দর। মাঝেমধ্যে আমার খোকাদের দুরন্তপনায় যখন একটু রেগে যাই, তখন আম্মাকে দেখি, কি অসীম ধৈর্যে মানুষটা সামলে নিচ্ছেন সবকিছু, আহা মায়া! পাওয়া না পাওয়ার হিসাব যেখানে বড়ই স্থূল। নাড়ির সুতোর বন্ধন, যে সুতো অসীম প্রেমের এক স্বর্গীয় ছবি অঁাকে।
অজানা এক ঘোরে আমরা ছুটছিলাম সবাই। কিন্তু জীবন তার নিজের নিয়মেই আমাদের থামতে শেখায়। এখন এমনই একসময়। করোনাকালের এ সময় গেল এক মাসেরও বেশি সময় ঘর থেকে বের হইনি একবারও। সম্ভবত এটাই আমার সবচেয়ে বেশি সময় মায়ের খুব কাছে থাকার। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে আম্মার ঘরের কাছে যাই, দেখি আলো-অঁাধারিতে আম্মা নামাজ পড়ছেন। আমি দরজা থেকে এক পা সরে আসতেই আম্মার আওয়াজ পাই, কে ছবি? আমার নিঃশব্দ নিঃশ্বাস আম্মাকে জানান দেয় দরজায় আমার উপস্থিতি। ‘মা’ অস্তিত্বের সহযাত্রী, নিঃশ্বাসে হয় যার সঙ্গে ভাবের আদান। সৌভাগ্য আমার নানুও এ সময়টায় আমার কাছে আছেন। তার বয়স হবে প্রায় একশ। প্রতি মুহূর্তে আম্মা কি নিবিড় যত্নে নানুকে ওঠান, বসান, খাওয়ান, গোসল করান, ঘুম পাড়ান, আমি দেখি আর ভাবি, আজ যে মানুষটি আমার মা, ভবিষ্যতে আমি-ই হব সে মানুষটির মা, আর তিনি হবেন আমার মেয়ে, এই হয়তো জীবনের উপহার। যার কাছে রয় আজন্ম ঋণ। জীবন আসলে জায়গা বদলের এক অদ্ভুত খেলা।