Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

শাকিব পরবর্তীকে হবেন কান্ডারী!

চলচ্চিত্র আমাদের সংস্কৃতির একটি বড় অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে। অতীতকালে চলচ্চিত্রই ছিল সাধারনের প্রধান বিনোদন মাধ্যম। সময়ের বিবর্তণে আমাদের চলচ্চিত্রের গতি প্রকৃতি বদলাতে থাকে। বলা যায়, এক নায়ক নির্ভর হয়ে ওঠে আমাদের চলচ্চিত্র। তার মানে এমন নয় আমাদের চলচ্চিত্রে আর কোনো নায়ক নাই। অনেক নায়কই আছেন। তবুও কেন এক নায়কের ওপর এতো নির্ভরতা? নতুন কেউ কি হাল ধরবেন না? আমাদের চলচ্চিত্রের অতীত, বর্তমান ও আগামীর স্বপ্ন নিয়ে পর্যালোচনামূলক এবারের শীর্ষ কাহিনী লিখেছেন আরিফ খান
প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকাই চলচ্চিত্রে একটি কথাই প্রচলিত। তাহলোÑ ঢাকাই চলচ্চিত্র এক নায়ক কেন্দ্রিক। ওই নায়ককে কেন্দ্র করেই ঢাকাই চলচ্চিত্রের ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত। একজনের উপরেই ঢাকা তথা একটি দেশের পুরো চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যার উপর ভর করেই প্রায় নিভু নিভু গোটা ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসা কোন রকমে টিকে আছে। ওই নায়ক না থাকলে ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অবস্থান এখন হয়তো শূন্যের কৌটাতেই থাকতো এমন ধারনা অনেকের। যার কথা বলা হচ্ছে তিনি হচ্ছেন শাকিব খান। তাকে নিয়ে যে কথা গুলো বলা হলো তা অনেকাংশেই সত্য। শাকিব খানের উপর পুরো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নির্ভর না করলেও সিনেমার ব্যবসা যে এক নায়ক কেন্দ্রিক-এ আটকে আছে তাতে কেউ দ্বিমত করবেন বলে মনে হয় না। আর এই চিত্রটি দুই, এক বছরের নয়। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় এই অবস্থা দৃশ্যমান। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি? কেন এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে না? এমন তো নয় যে, এই ইন্ডাস্ট্রিতে নায়ক একজনই। অনেকে ছিলেন, আছেন। তারপরেও এত বড় একটা ইন্ডাস্ট্রিতে কেন এক নায়কের কর্তৃত্ব চলছে? আর কতদিন এভাবে চলবে? আর কেউ কি আসবেন না এই ইন্ডাস্ট্রির হাল ধরতে? কেউ কি হবেন না শাকিব পরবর্তী কান্ডারী? এই প্রশ্নের সমাধান খুঁজতেই এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।

সূচনা লগ্নে: ১৯৫৬ সালে আব্দুল জব্বার খান-এর মুখ ও মুখোশ ছবি দিয়ে আমাদের সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু। এ ছবির নায়ক ছিলেন আব্দুল জব্বার খান নিজেই। এরও প্রায় ২৫ বছর আগে এ দেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তবে সেটি ছিল নির্বাক ছবি। ছবির নাম ‘দ্যা লাস্ট কিস’ বা শেষ চুম্বন। আর নায়ক ছিলেন খাজা আজমল। মুখ ও মুখোশ-এর পরে এক সময় নির্মিত হয় ‘আসিয়া’। যার নায়ক ছিলেন শহীদ। এর পরেই একটি দুটি করে নির্মিত হতে থাকে এ দেশের সিনেমা। বাড়তে থাকে সিনেমার সংখ্যা। প্রথম দিকে এসব ছবিতে অভিনয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী পেতে একটু সমস্যা হলেও পরে আর সমস্যা হয়নি। একে একে বাড়তে থাকে মেধা সম্পন্ন নায়ক-নায়িকা তথা অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যা। যেহেতু আমাদের এই প্রতিবেদন, নায়ক কেন্দ্রিক। তাই এখানে তুলে ধরা হবে আমাদের নায়কদেরই ইতিহাস।
ফিরে দেখা: ষাট দশকের শুরুতেই আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ (অর্থাৎ তৎকালিন পাকিস্তান) নিয়মিত শুরু হয়। পাকিস্তানের উর্দূ আর কলকাতার বাংলা ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নির্মিত হতে থাকে এদেশের বাংলা ছবি। সেই সময় অর্থাৎ শুরুর দিকে বাংলা ছবির নায়ক হিসেবে আমরা পেয়েছি আনিস (খান আতাউর রহমান), হাসান ইমাম, গোলাম মুস্তাফা, ফতেহ লোহানী, আনোয়ার হোসেন, আনসার, কাফি খান, শহীদ, আমিন সহ আরো কয়েকজনকে। রহমান, মোহম্মদ আলী ও নাদিমকে উর্দূ ছবির পাশাপাশি বাংলা ছবিতেও পেয়েছে দর্শক। এরপরেই আজিম ও রাজ্জাকের আগমন। চলচ্চিত্রে রাজ্জাক আসার পর রোমান্টিক নায়ক হিসেবে আধিপত্য ছড়িয়ে দিলেও একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্টিত হয়নি কখনো। স্বাধীনতার আগে রাজ্জাকের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হলেও তখন নাদিম, আজিম এবং রহমানের নামও শীর্ষ নায়কের আসনেই ছিল।
এরপর অর্থাৎ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজ্জাকের পর একে একে আসেন আলমগীর, বুলবুল আহমেদ, ফারুক, উজ্জল, ওয়াসিম, জাভেদ, সোহেল রানা, জাফর ইকবাল। তারা প্রত্যেকেই নিজস্ব একটা ইমেজ তৈরি করে দাপটের সঙ্গে কাজ করে গেছেন নায়ক রাজ রাজ্জাকের পাশাপাশি সমান তালে।
এসব নায়কদের পাশাপাশিই এক সময় চলচ্চিত্রে আসেন জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন। জসিম ভিলেন হিসেবে অভিনয় শুরু করলেও নায়ক হিসেবে উপরে উল্লেখিত নায়কদের পাশাপাশি নিজের একটা জায়গা করে নেন। জসিম আর ইলিয়াস কাঞ্চন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান এক সময়।
পরের প্রজন্মে আমরা পাই রুবেল, মান্না, সোহেল চৌধুরী, বাপ্পারাজ, হেলাল খান ও অমিত হাসানকে। এরা যখন আসেন এবং ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নেন তখনো কিন্তু রাজ্জাক, আলমগীর, জাফর ইকবাল, উজ্জল, ওয়াসিম. সোহেল রানা, ফারুক, জসীমদের অবস্থান একটুও নড়বড়ে হয়নি। কারো একক আসন বা একছত্র আধিপত্য বিস্তার হয়নি। যার যার জায়গায় যার যার ইমেজে দাপটের সঙ্গেই কাজ করে গেছেন।
এরপরে আসে সালমান শাহ্র যুগ। সালমান শাহ যখন ঢাকাই চলচ্চিত্রে আসেন তখনও উপরে উল্লেখিত সব নায়কই কম বেশি ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। শুধু স্কুল কলেজ পড়ুয়া রোমান্টিক নায়ক হিসেবে দর্শক তাদের নিচ্ছিলেন না। আর তাই সালমান শাহ’র আসা অন্তত রোমান্টিক সিনেমায় এক পশলা বৃষ্টির মতই ছিল। সালমান শাহ’র মত একজন তরুণ নায়কের এই ইন্ডাস্ট্রিতে আসা সেই সময় বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল। রোমান্টিক ছবিতে অপরিহার্য হয়ে উঠলেও সেই সালমান শাহরও কিন্তু একক আধিপত্য তখন ছিল না বা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সালমান শাহ’র আগেই এই ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছেন ওমর সানি, নাঈম ও আমিন খান এবং এই নায়কেরা সালমান এর পাশাপাশি বেশ দাপটের সঙ্গেই কাজ করে গেছেন দীর্ঘ একটা সময়। সালমান শাহ’র মৃত্যুর পর এলো আরেক প্রজন্ম। তারা হলেন রিয়াজ, ফেরদৌস আর শাকিল খান। এসময়ও উচ্চারিত হতো না কোন একক নাম। সালমান শাহ’র পরবর্তী সময় এবং শাকিব খান এর আগে এই তিনজন নায়কের উপর কিছুটা সময় বা প্রায় এক দশক নির্ভর করেছিল আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। এরপরেই শাকিব খান এর আগমন। তখনো রিয়াজ, ফেরদৌস ও শাকিল খান এর দাপট ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অশ্লীল ছবির যুগে খাপ খাওয়াতে না পেরে একে একে যেমন ভাল ছবির নির্মাণ সংখ্যা কমে যেতে লাগলো, পাশাপাশি কমে যেতে থাকলো নায়কদের ব্যস্ততা। কথিত আছে যে, কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানার অভিনয় থেকে সরে যাওয়া এবং সালমান শাহ’র অকাল মৃত্যু আমাদের এই চলমান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির থমকে যাওয়ার মূল কারন। এরপর ইন্ডাস্ট্রি নানা ভাবে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেও ভালো প্রযোজক, ভালো পরিচালকের অভাবে ক্রমান্বয়ে থেমে যেতে থাকে ইন্ডাস্ট্রির গতি। আর তখন এক শ্রেণীর প্রযোজক ও পরিচালকের পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ডুবে যেতে থাকে অশ্লীলতার সাগরে। একটা সময় তারও পতন হয়। অবশ্য এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও সেই সময় বেশ কিছু রোমান্টিক ছবি নির্মিত হয়েছে। কিছু কিছু পারিবারিক গল্প নিয়েও নির্মিত হয়েছে কয়েকটি সিনেমা।
এর মধ্যে শাকিব খান অভিনীত কিছু ছবি ব্যাবসা সফল হওয়ায় ক্রমশ কিছু পরিচালক ও প্রযোজক তার উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হতে থাকে। আর এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি ক্রমশ শাকিব খান নির্ভর ইন্ডাস্ট্রিতে পরিনত হয়। শাকিব খানের পরে বাপ্পী, সায়মন, জায়েদ খান, সম্রাট, মারুফ, কায়েস আরজু, শীপন মিত্র, অনন্ত জলিল এবং টেলিভিশন থেকে ইমন, আরেফিন শুভ, নীরবেরা এলেও এবং প্রচুর ছবিতে কাজ করলেও তাঁরা কেউই তেমন অর্থে শাকিব খানের একক আধিপত্যকে টলাতে পারেননি।
অথচ এমন পরিস্থিতি এই ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখতে পাইনি। শুধু আমাদের ইন্ডাস্ট্রি নয়। বেশি দূর না যেয়ে যদি আমাদের পাশের দেশকেও উদাহরণ হিসেবে আনি সেখানেও নেই এমন চিত্র।
বলিউডে অর্থাৎ মুম্বাই চলচ্চিত্রে দিলিপ কুমার যখন শীর্ষে তখনো তার পাশাপাশি উচ্চারিত হতো রাজেন্দ্র কুমার, রাজ কুমার, রাজ কাপুরদের নাম। অমিতাভ বচ্চনের যুগেও তার আধিপত্যের সময়েও খুব বেশি পিছিয়ে ছিলেন না জীতেন্দ্র, বিনোদ খান্না, রাজেশ খান্না, মিঠুন চক্রবর্তী, বাজবাব্বর, শশী কাপুর বা ঋষি কাপুররা। আর যদি এই সময়েও আসি শাহরুখ খান, আমীর খান, সালমান খান, অক্ষয় কুমার, ঋতিক রোশনদের সময় কারো নাম একক আধিপত্যে উচ্চারিত হয় না।
কলকাতার বাংলা ছবিতে যখন উত্তম কুমারের যুগ বা বাংলা ছবি বলতে উত্তম কুমারকেই বোঝাতো তখনো উত্তম কুমারের পাশাপাশি অনীল চ্যাটার্জী, বিশ্বজীৎ চ্যাটার্জী, সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, নির্মল কুমার দাপটেই ছিলেন। পরে প্রসেনজিৎ,. তাপস পাল, ভিক্টর ব্যানার্জী, চিরঞ্জিত, অভিষেক চ্যাটার্জি অনেকেই ছিলেন এক সঙ্গে । মাঝে কিছুটা সময় প্রসেনজিৎ নির্ভর ছিল কলকাতার ছবি। সেই সময় বাংলাদেশের ফেরদৌস ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ ছবির সুবাদে কলকাতায় একটা শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন।
বর্তমান সময়ে জীত, দেবের দূর্দান্ত দাপটেও ভালো ভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন অঙ্কুশ, হীরন, সোহাম, বনির মত তারকা শিল্পীরাও।