সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
নাটকের মানুষ আফজাল হোসেন। মঞ্চ নাটক দিয়েই তাঁর অভিনয় জীবন শুরু। তারপর টিভি নাটকে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন তিনি অভিনয় থেকে সরে যান। এক পর্যায়ে দেশের আলোচিত টেলিভিশন সিরিজ ছোটকাকুর মাধ্যমে তাঁকে আমরা টেলিভিশন নাটকে ফিরতে দেখি। কিন্তু মঞ্চে ছিলেন অনুপস্থিত। আনন্দের খবর, গুণী এই অভিনেতা এবার মঞ্চেও ফিরেছেন। কানাডার টরেন্টোতে একটি মঞ্চ নাটকে ইতিমধ্যে অভিনয়ও করেছেন। সার্বিক বিষয়ে কথা বলেছেন আনন্দ আলোর সাথে।
আনন্দ আলো: ২৫ বছর পর মঞ্চে ফিরলেন। তাও আবার দেশের বাইরে। এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
আফজাল হোসেন: সময়টা ২৫ বছর কিনা হিসাব করে দেখা হয়নি। তবে হ্যাঁ, একটা লম্বা সময় পার করে মঞ্চে ফিরলাম। মূলত মঞ্চেই আমার অভিনয় জীবন শুরু। পরে টেলিভিশনে অভিনয়ের সুযোগ হয়। যাই হোক মঞ্চ বিষয়টা এতই গুরুত্বপুর্ণ যে জোড়াতালি দিয়ে করা যায় না। অনেক সময় দিতে হয়। একটা সময়ে যখন জীবন ধারনের জন্য পেশা বেছে নিয়ে তার দিকে ঝুঁকতে হলো তখন বুঝলাম বাস্তবতটা। তা কঠিন, কষ্টদায়ক হলেও স্বীকার করে নিতে হলো। মানে কমাতে হলো অভিনয় আর থিয়েটারের সাথে ঘনিষ্টতা।
আনন্দ আলো: শুধুই কি সময়ের অভাবে এই বদল?
আফজাল হোসেন: আমরা যারা অভিনয় করি তাদের সমস্যা, সংকট অনেক। দূরের মানুষেরা ভাবেন, অভিনয় করি বলে জনপ্রিয়তা আমাদের কাজে লাগে। নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে জীবনটা অনেক সহজ আর আরামের হয়। ধারনা পুরো ঠিক নয়। উল্টো দিকও রয়েছে। যখন পেশা বেছে নিষ্ঠার সাথে কাজ করার চেষ্টা করেছি তখন প্রবল ভাবে একটা বিষয় খেয়াল করেছি, আমি কতটা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করি তা অনেক মানুষ শিল্পী পরিচয়ের কারণে দ্বিধায় থাকে। সংশয়ে ভোগে নাটক করা মানুষ কতটা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে। সমাজটা এমন, পরিচয় দেবার সময় বলে‘নাটক টাটক’ করে। যেন অভিনয় করা গুরুত্বপুর্ণ কাজের মধ্যেই পড়ে না। কত বলতে শুনেছি, নাটক করেন আর কি করেন? জনে জনে এমন দৃষ্টিভঙ্গী থাকলে দায়িত্বশীলতা প্রমান করা সত্যিই কঠিন। আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছি নাটক করতে করতে শখের বশে আমি বিজ্ঞাপন বানিজ্যে যুক্ত হইনি। বিজ্ঞাপন ব্যবসায় আমি অর্থ রোজগারের জন্যই আসিনি। এ মাধ্যমে নতুন কিছু করার বাসনা মনে রয়েছে। সেটা সংশয়ে থাকা মানুষদের বোঝানোর জন্য সবচেয়ে আবেগের সম্পর্ক যার সাথে, সেই নাটকের সাথে দূরত্ব তৈরির ইচ্ছাকে স্বীকার করে নিতে হলো।
আনন্দ আলো: মঞ্চ থেকে দূরে গিয়ে কেমন ছিলেন?
আফজাল হোসেন: নিশ্চয়ই বলবো না, খুবই মন্দ ছিলাম। আনন্দ নিয়েই কাজে মেতে থেকেছি। বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মান অনেক উপভোগের বিষয় নিঃসন্দেহে। তবে হ্যাঁ, একথা সত্য- অভিনয়ের প্রেম ভুলে খুব ভালো থাকা যায় না। অভিনয় থেকে দূরে সরে আসতে হয়েছে বলে কখনো কখনো মানসিক পীড়ন অনুভব করতাম। মনে বেদনা থাকলেও একটা লম্বা সময় পর্যন্ত আমি যা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি, সব মনোযোগ সেখানে কেন্দ্রীভ‚ত রাখার চেষ্টা করেছি। অনেককাল পরে মনে হলো টেলিভিশনে অভিনয় প্রায় ছেড়ে দিয়েছি, মাঝে মাঝে ছোটদের জন্য কিছু করতে পারি। ফরিদুর রেজা সাগরের ছোটকাকু পড়তাম। মনে হলো এমন একটা চরিত্র টেলিভিশনের পর্দায় তো নতুনত্ব আনতে পারে। ব্যাস ছোটকাকু পর্দায় এলো। অভিনয়ের জন্য ভেতর থেকে আবার একটা তাড়না অনুভব করতে শুরু করলাম। বছরে দু’বার ছোটকাকু সিরিজটি নির্মাণ ও অভিনয় করতে গিয়ে আবার নাটকের সাথে একটু একটু করে একটা যোগসূত্র তৈরি হল। বলা যায় ছোটকাকু আমাকে অভিনয়ে ফেরালো।
আনন্দ আলো: টেলিভিশনের কথা জানা হলো, মঞ্চে ফেরা নিয়ে কথা শুনি…
আফজাল হোসেন: প্রিয় নাট্যকার মাসুম রেজা মঞ্চ নাটকের একটি পান্ডুলিপি নিয়ে একদিন আমার অফিসে হাজির। নাটকটা আমাকে পড়তে দেয়। পড়ে ফেলি সেখানে বসেই। পড়ে মুখে হাসি ফুটলো। পান্ডুলিপিটা আমার অসম্ভব রকমের ভালো লেগে গেল। মাসুম জানায়, এইযে নাটকটি লিখেছি তার একটা বিশেষ কারণ আছে। এই নাটকের মাধ্যমে আপনাকে মঞ্চে ফিরতে হবে। সত্যি বলতে কী, মুহূর্তের মধ্যে মাসুমের এই কথাটি মনের ভেতরে একটা আলোড়ন তুললো। উসকে দেওয়া যাকে বলে। চায়ের ফাঁকে জানাই, আমাকে একটু সময় দাও। মুখে বললাম সময়ের কথা কিন্তু ঐ অল্প সময়ের মধ্যে মনের ভিতর উত্তর কি হবে তৈরি হয়ে গেছে।
আনন্দ আলো: আনুষ্ঠানিক হ্যাঁ কিভাবে হলো?
আফজাল হোসেন: আমার নাট্যগুরু নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। মনের ভিতর যে উৎসাহ জেগেছিল তা দ্বিগুন হয়ে গেল দুদিন পর। তাঁর সাথে কথা হয় নাটকটা নিয়ে। তিনি জানালেন তুই যদি সময় দিতে পারিস আমি নাটকটা নিয়ে ভাবতে পারি। ভাবতে পারি মানে কি বোঝাতে চাইলেন বুঝতে বাকি থাকে না। তিনি যদি নির্দেশনা দেন, আমার ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। জানালাম, করবো আমি।
আনন্দ আলো: তারপর? কবে মঞ্চে আসবে সে নাটক?
আফজাল হোসেন: আমি, মাসুম রেজা, নাসির উদ্দিন ইউসুফ এবং সে নাটকটায় আর যারা যুক্ত থাকবেন একত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকবার বসেছি। পাঠ করা হয়েছে কিন্তু সমস্যা হলো আমাকে নিয়ে। ২০১৯ সালটা আমার জন্য প্রচন্ড ব্যস্ততার বছর। দেশে, বিদেশে নানা কাজে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়েছে। তাই মহড়ার সময় মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। বছরের শেষ দিকে আশা করছি আমাদের নিয়মিত বসা শুরু হবে।
আনন্দ আলো: আচমকা নতুন একটা মঞ্চনাটক নিয়ে মেতে তো উঠতে পারলেন?
আফজাল হোসেন: আচমকা ঠিক নয়। প্রায় আটমাস ধরে কানাডার টরেন্টো শহরে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে যাওয়া নিয়ে কথা চলছিল। মাসুম সে নাটকটা লিখতে রাজী হলো বলেই টরোন্টোতে যেয়ে অভিনয়ের ইচ্ছাটা জোর পেলো। ভাবলাম মন তো মঞ্চে ফিরবার জন্য প্রস্তুত তাহলে একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। নিজের সাথে একটা বোঝাপড়া হোক। টরোন্টোর জন্য মাসুম যে নাটকটা লিখলো, সেটা হালকা মেজাজের। অভিনয়ের জন্য বেশ আরামদায়কও মনে হলো। অনেকদিন পর অভিনয়ে ফিরবো ওজন যথেষ্ট ভারী নয়, তা সুখকর!
আনন্দ আলো: বেশ কৌতুহল জাগছে। দেশ থেকে শিল্পী নিয়ে গিয়ে দেশের বাইরে নাটকে অভিনয়ের আমন্ত্রণ…
আফজাল হোসেন: আমারও মনে হয়েছে এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানানো উচিত। উৎসাহ দেয়া কর্তব্য। এটা ভেবেই আমি রাজি হয়ে গেলাম। টরেন্টো ঢাকা কালচারাল নেটওয়ার্ক নামে কানাডার একটি সংগঠন নাটকটি মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নিয়েছে। সংগঠনটি গত বছর আমাদের প্রিয় অভিনেত্রী সুবর্না মুস্তাফা, চিত্রলেখা গুহ এদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ফলে টরেন্টোর এই অনুষ্ঠানটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে সহজ হয়। বিদেশের একটি সংগঠন বাংলা নাটকের ব্যাপারে এতো আন্তরিক। সংগঠনটির এ ভূমিকা যথার্থ মর্যাদা দেওয়া কর্তব্য বলে মনে হয়। সংগঠনটির কর্মকর্তাদের সাথে মাসুম রেজার আগে থেকে যোগাযোগ আছে। আয়োজক সবিতা সোমানি ও নয়ন হাফিজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। দু’জনেরই নাটকের সাথে যুক্ততা ছিল। মানে হঠাৎ করে নয়, মঞ্চ নাটকের সঙ্গে তাদের আত্মিক যোগাযোগ বহুকাল ধরে।

আনন্দ আলো: অপি করিম আর আপনি একসঙ্গে এই প্রথম মঞ্চে অভিনয় করলেন। সে অভিজ্ঞতা শুনি…আফজাল হোসেন: অপি করিম আমার অত্যন্ত প্রিয় অভিনেত্রী। প্রতিদিনের সীমাহীন ব্যস্ততার মধ্যেও সে মঞ্চকে সময় দিয়ে যাচ্ছে। কানাডায় তারও যাওয়ার কথা, সেটা বিশেষ আনন্দেরই মনে হয়েছিল।নাটকের প্রধান চরিত্র দুটি। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। যেকোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া করা তাদের বৈশিষ্ট। মজার অভিনয়ের সুযোগ ছিল। কিন্তু মুশকিল হলো কানাডায় যাওয়ার আগে ঢাকায় আমরা সেভাবে রিহার্সেল করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আমি, মাসুম রেজা, অপি করিম তিনজনেরই তো সীমাহীন ব্যস্ততায় দিন কাটে। তবুও কানাডায় যাওয়ার আগে টানা সপ্তাহখানেক রিহার্সেল করার সুযোগ পেয়েছি। টরেন্টোর উদ্যোক্তাদের বলেছিলাম, নাটক মঞ্চায়নের ৫/৬দিন আগে আমরা যেতে চাই। কারণ ঢাকা থেকে ঐ রকম প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ওখানে গিয়ে একশতভাগ মনোযোগ দিয়ে মহড়া সম্ভব হবে ভেবে আমরা বেশ আগেই চলে যাওয়ার কথা ভেবেছি। সে প্রস্তুতির সময় পেয়ে নাটক মঞ্চায়ন সহজ হয়েছে।
আনন্দ আলো: টরোন্টোতে শুধু কি নাটকেরই অভিনয় হলো?
আফজাল হোসেন: বিদেশে নানা উপলক্ষে অনেক অনুষ্ঠান হয়, নাটক হয়না। দর্শক প্রবাসী বলে বহু কিছুতে তাদের আগ্রহ থাকে। অনুষ্ঠানটা সাজানো হয়েছিল খুব সুন্দর করে। প্রথমে স্থানীয় দু’জন তরুণ প্রতিশ্রæতিশীল শিল্পী গান গাইবে। তারপর নাটক মঞ্চস্থ হবে। নাটক শেষে আমার লেখা দুটো করে কবিতা পড়বে ৪জন। সব শেষে মিতালী মুখার্জির গান। মিতালীর গানের পরে তার কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তিরও একটি পর্ব উপস্থাপন করা হয়। মিতালী জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী,তার কবিতা প্রীতি সম্পর্কে মানুষ বিশেষ জানে না। ঐ অনুষ্ঠানে জেনেছে। সেটা ছিল বাড়তি আকর্ষণ।
আনন্দ আলো: বহুকাল পর আবার মঞ্চে অভিনয় করলেন। কেমন সে অনুভ‚তি…
আফজাল হোসেন: খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে আবার ফিরে পেলে যেমন অনুভ‚তি হয় তেমনই…
আনন্দ আলো: পুরো বিষয়টা কেমন উপভোগ করলেন?
আফজাল হোসেন: একটি মজার ঘটনা বলি। নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার বেশ আগে আমরা টরেন্টোতে যাই। সেখানে শুধুমাত্র আমরা ৪জন অর্থাৎ আমি, অপি, মাসুম রেজা ও মিতালীর জন্য একটা বাসা ঠিক করে রাখা হয়েছিল। আমরা সেখানে নিজের মত করে থাকব। নিজেদের বাসার মত। খুব চমৎকার বাসা ছিল।নীচতলায় ড্রয়িংরুম এবং ডাইনিং দুটো মিলিয়ে জায়গাটা অনেক বড়সড়। সেখানে আমরা রিহার্সেল করব। উপরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল যে কটা দিন আমরা এখানে থাকব এবং রিহার্সেল করব সে কয়দিন নাটক এবং সংগঠন সংশ্লিষ্ট মানুষজন ছাড়া আর কেউ আসবে না। সংগঠনের লোকজনই কেবলখাবার-দাবার নিয়ে আসতো,দিয়ে চলে যেত। বাড়িটা একটা নাটকের ‘ক্যাম্প’ হয়ে উঠলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজেরা পরস্পরের জন্য চা বানাচ্ছি। চায়ের পর রিহার্সেল শুরু। একবার রিহার্সেল শেষ হলে সবাই মিলে নাস্তা বানানো। খেতে খেতে গল্প, আড্ডা, হৈচৈ, তারপর আবার মহড়ায় নেমে পড়া। টরেন্টোর ওই পাঁচটা দিন যে কত আনন্দে কেটেছে তা কেবল আমরাই জানি। প্রতিদিন আমরা ৪ থেকে ৫ বার রিহার্সেল করেছি। এই কদিন আমরা মাত্র দুইবার বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। মিলনায়তন দেখতে আর নাটকের টুকটাক জিনিস লাগবে বলে একবার। আর ঠিক নাটকের আগের দিন বাসা ভর্তি লোকজন ছিল, মিতালীর গানের রিহার্সেল চলছিল বলে আমরা বাড়ি ছেড়ে রিহার্সেল করতে বেরিয়ে যাই। রিহার্সেল করেছিলাম বাড়ির কাছের একটা পার্কে।

আনন্দ আলো: পার্কে বসে নাটকের রিহার্সেল?
আফজাল হোসেন: হ্যাঁ ওখানে তো কোন সমস্যা নেই। যে যার মত চলে। আমরা কি করছি কেউ সামান্য কৌতুহল নিয়ে তাকায় না।
আনন্দ আলো: দর্শক কেমন ছিল?
আফজাল হোসেন: এক কথায় চমৎকার। সিরিয়াস ধরনের দর্শক। যারা মিতালীর কণ্ঠে কবিতা শুনেও তুমুল হাততালি দিয়েছে। অনুষ্ঠানের দর্শক ভালো থাকলে যারা অনুষ্ঠান করে অর্থাৎ গান গায়, অভিনয় করে- সকল শিল্পীরা উৎসাহ পায়। মিতালী মুখার্জি তার গানের ফাঁকে ফাঁকে দর্শকের সাথে যখন কথা বলছিলেন তখন প্রায় প্রতিটি দর্শকের উৎসাহ, অংশগ্রহণ ছিল অনুপ্রেরণাদায়ক। নাটক, গান, কবিতা, দর্শকের প্রশ্নোত্তর পর্ব সহ পুরো অনুষ্ঠানটা যারা দেখতে এসেছিল সবার অসাধারণ ভ‚মিকায় মুগ্ধ হয়েছি।
আনন্দ আলো: সব ভালো লাগার কথা বলছেন, মন্দ লাগার মত কোন অভিজ্ঞতা?
আফজাল হোসেন: ভালোর সঙ্গে মন্দ অভিজ্ঞতা তো থাকবেই। আমাদের কিছু কিছু ক্রটি হয়েছে। একটি নাটকের প্রথম প্রদর্শনী, ক্রটি তো থাকারই কথা। মঞ্চের জন্য চাহিদা মাফিক অনেক কিছুই আমরা পাইনি। তবে আমরা যে মনপ্রাণ দিয়ে নাটকটি ভালো করার চেষ্টা করেছি দর্শক সেটা বুঝতে পেরেছেন। সেজন্য তাদের অকৃপণ অভিনন্দন আমরা পেয়েছি।
আনন্দ আলো: আপনার কো-আর্টিস্ট হিসেবে অপি করিম সম্পর্কে কিছু বলবেন?
আফজাল হোসেন: অপি করিম আমার খুবই পছন্দের একজন অভিনেত্রী। ওকে আমি একেবারে ছোটবেলা থেকে চিনি, জানি। তার বেড়ে ওঠাকে বহুকাল ধরে আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করেছি। বেড়ে ওঠা মানে তিলে তিলে সে নিজেকে কতটা সম্পন্ন করে তুলেছে দেখে বিষ্ময় জাগে। অভিনয়ে তার নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সৃজনশীলতা আমাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে। কয়েকটি টিভি নাটকেও আমরা এক সাথে অভিনয় করেছি। একটা নাটকের জন্য বেশ লম্বা সময় ধরে আমরা নেপালে ছিলাম। অচিরেই নাটকটি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার হবে। ওই সময়টাতে টানা কয়েকদিন কাজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি সময়ের শ্রেষ্ঠ অভিনয় শিল্পীদের পুরোভাগে সে। একজন অভিনয় শিল্পীর কতটা ক্ষমতা, সাধ্য থাকলে প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন করে প্রকাশ করতে পারে। দেখেছি আর আনন্দলাভ হয়েছে। অপির একটা বিশেষ গুণ, নাটকের অতি সাদামাটা মুহূর্তকেও অসম্ভব সুন্দর করে তুলতে পারে। হয়তো একটা সাধারন সংলাপ, টেলিফোনে বলতে হবে, কিন্তু সেটাও যে কত অবাক করা, মনে রাখার হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ দিয়েছে। টরেন্টোর নাটকটির ব্যাপারে অপির ডেডিকেশন ছিল বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো। ঢাকায় অপির প্রতিদিনই অনেক ব্যস্ততা থাকে। সে মঞ্চের জন্য সময় দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়, পারিবারিক দায়িত্বও রয়েছে। এত কিছুর পরও যেভাবে সময় বের করে ও ঢাকায় রিহার্সেল করেছে তা সত্যি প্রশংসা করার মতো। কোনো কোনো দিন এমনও হয়েছে সকাল ৯টায় আমার বাসায় নাটকের রিহার্সেল করেছি। তারপর যে যার কাজে চলে গেছি। টরেন্টো রওয়ানা হওয়ার আগে তিন দিন নিজের কাজ শেষ করার পর আমাকে কল দিয়েছেÑ আপনি কি বাসায় ফিরেছেন? আমি আসতে পারি।আমার বাসা সুবিধাজনক জায়গায় বলে সকালে, রাতে সেখানে জড়ো হয়ে রিহার্সেল করেছি। একটা কাজে যখন এতটাই আন্তরিকতা যুক্ত হয় তখন স্বাভাবিক নিয়মেই তা আলাদা হয়ে ওঠে।

আনন্দ আলো: এই যে এতদিন পর মঞ্চে ফিরছেন। খোঁজ রাখেন কী মঞ্চের? আপনাদের সাজানো সেই মঞ্চ এখন কেমন আছে জানেন?
আফজাল হোসেন: (ভেবে নিয়ে) হতাশ হতে চাইলে তো হওয়ার মতো প্রচুর ঘটনা আছে চারপাশে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে নানান বিষয়ের সাথে যুক্ত। লেখালেখি, আঁকাআঁকি, বিজ্ঞাপন নির্মাণ ছাড়া আরো নানান দিক আছে। হতাশা শুধু মঞ্চে উৎপাত করে, তা নয়। তার উপস্থিতি এখন কোথায় নেই? সবখানে।প্রায়ই মঞ্চে নাটক দেখতে যাওয়া হয়। নাটক দেখতে গিয়ে একটা বিষয় দেখে খুবই ভালো লাগে, এখনও নাটকের প্রতি ভালোবাসা যথেষ্ট জ্বলজ্বলে, নিভন্ত নয়। আগের মতো হলগুলো হয়তো দর্শক ভীড়ে গমগম করে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এইÑ এখনও যে ছেলে-মেয়ে গুলো মঞ্চে নাটক করে তারা একটা সিঙ্গারা আর এক কাপ বিস্বাদ চা খেয়েই নাটকের সংগ্রামটা চালিয়ে নিচ্ছে। এই ভালোবাসাকে তো শ্রদ্ধা করতেই হবে।
আনন্দ আলো: বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করে। সেখানে প্রতিদিন ১০০০ মানুষও যদি ঢাকার বিভিন্ন মঞ্চে নাটক দেখতে আসে তাহলেই তো নাটকের দল গুলো এগিয়ে যাবার প্রেরণা পায়… এখানে কি দর্শকের কোন দায় আছে? আপনার অভিমত জানতে চাই।
আফজাল হোসেন: (ভেবে নিয়ে) দর্শকের দায় মানে… দর্শক তো একা হঠাৎ এই জায়গাটায় পৌঁছায় নাই। গত ২০/৩০ বছর ধরে আমাদের সমাজটায় যে স্বার্থপর চিন্তা ও চর্চা শুরু হয়েছে, তার ফলাফল আমাদের ভোগাবে এখন। মানুষ পদে পদে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ধরুন, যদি বিষয়টাকে এই ভাবে বিবেচনা করি, স্বাধীনতার পর ছিন্নভিন্ন, বিধ্বস্থ একটা দেশে মানুষ ফিরল। কিন্তু মানুষের স্বপ্ন তো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়নি। মানুষ যুদ্ধ করেছে একত্রে এবং একত্রেই ফিরেছে। একত্রেই নানান ক্ষেত্রে স্বাধীনতার গৌরবটা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। এজন্য দেশের কবিতা, উপন্যাস, গল্প- পুরো সাহিত্য দাঁড়িয়েছে, মঞ্চ নাটক দাঁড়িয়েছে, পত্রিকা দাঁড়িয়েছে। সবই কিন্তু গৌরবময়। চিন্তা করে দেখা যায়, পাঠেও কি পরিমাণ পাঠকের উৎসাহ ছিল।ফুটবল খেলায় কত দর্শক ছিল মনে পড়ে? ফুটবল মাঠ দর্শক ভীড়ে কানায় কানায় ভরে থাকতো। মঞ্চ নাটকের একটি টিকিটের জন্য কি হুটোপুটিই না ছিল। যারা মঞ্চে কাজ শুরু করেছিল তারা তো ঘাড়ে করেই নাটকের সেট নিয়ে আসতো। মিলনায়তন ঝাড়– দিয়েছে মঞ্চের মানুষেরাই। এই যে প্রেম, সমস্ত প্রেমের সঙ্গে দায়িত্বহীন স্বার্থবাদী মানুষেরা একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
আনন্দ আলো: বিশ্বাসঘাতকতা! ব্যাপারটা কি আরেকটু বুঝিয়ে বলবেন?
আফজাল হোসেন: বিশ্বাসঘাতকতা মানে… সুবিধাবাদী শ্রেণী তাদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে একাট্টা হয়েছে। আবেগ নিয়ে যারা মেতে থেকেছে তারা ক্রমে টের পেয়েছে, পাশে কেউ নেই। নিঃস্বার্থ মানুষেরা প্রতিনিয়ত ঠকেছে। তবে আশার কথা হলো ঠকে যাওয়া মানুষগুলোর অনেকেই এখনও মঞ্চের সাথেই আছে। তারা এক কাপ চা এবং একটা সিঙ্গারা খেয়ে পরম ভালোবাসায় এখনও নাটক করে চলেছে। লক্ষ্য করার মত ব্যাপার হলো যা যা গৌরবের ঘটনা ঘটেছে কোনটাই অর্থের জন্য ঘটে নাই। ঘটেছে আবেগের কারণে। আমরা ভেবে দেখতে পারি, যিনি উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়েছেন তিনি উপন্যাস লিখে অনেক টাকা পেতেন না। কবি পারিশ্রমিকের আশায় কবিতা লেখেননি।পারিশ্রমিকের আশা করে কি কেউ টেলিভিশনে অভিনয় করতো? নাটক লিখে কেউই উপযুক্ত পারিশ্রমিক পায়নি। কোনো ক্ষেত্রেই কিন্তু বিষয়টা পারিশ্রমিক কেন্দ্রীক ছিল না। অর্থের তোয়াক্কা ছিল না বলে ওই সময়ে অর্থবহ কাজগুলো হয়েছে। পরে হয়েছে কী… অনেকের ভাবনায় টাকাটা খুব দরকার মনে হয়েছে। এ মনে হওয়া ক্রমে বেড়েছে, সংকট সৃষ্টি করেছে।টাকার দরকারের দিকে মানুষ যখন ঝুঁকতে শুরু করেছে, টাকাকে যখন বড় ভাবা শুরু হয়েছে তখন আর অর্থবহ কাজ হয়নি। অর্থের পিছনে দৌড়ে অর্থ মিলেছে, মিলছে। অর্থবহ কাজের হয়েছে করুন দশা।
আনন্দ আলো: তাহলে ভবিষ্যৎটা কেমন দেখছেন?
আফজাল হোসেন: আমি আশাবাদী মানুষ। সময় বদলাবেই। প্রাকৃতিক নিয়মটা কী, রোদ উঠবে, ছায়াটা তার দিক বদলাতে থাকবে এবং এক সময় আবার আগের জায়গায়ই এসে দাঁড়াবে।
আনন্দ আলো: আপনার আঁকাআঁকির খবর কী?
আফজাল হোসেন: চলছে নিয়মিত। অচিরেই একটা প্রদর্শনী করবো বলে আশা করছি। আঁকাআঁকি, লেখালেখি এই বিষয়গুলো কিন্তু সার্বক্ষনিক কাজ। এটা বিরতি দিয়ে হয় না। আমাকে বিরতি দিয়ে দিয়ে করতে হয়, সেজন্য প্রদর্শনীর ইচ্ছা থাকলেও হয়ে ওঠে না। ২০২০ সালে দুটো আশা। একটা হলো আমার নতুন চিত্রকর্মের প্রদর্শনী এবং ছোটকাকুকে নিয়ে আরও বড় পরিসরে এগিয়ে যাওয়া…
আনন্দ আলো: বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করবেন? ছোটকাকু নিয়ে বড় পর্দায় ছবির নির্মাণের কথা শুনেছিলাম। তার খবর কী?
আফজাল হোসেন: হ্যাঁ এব্যাপারে কাজ চলছে। পান্ডুলিপি প্রায় চ‚ড়ান্ত। বাংলাদেশ সহ কয়েকটি দেশে সিনেমার শুটিং হবে। টেলিভিশন নাটকের সাথে বড় পর্দার সিনেমার যেন একটা পার্থক্য থাকে আমরা ছোটকাকুকে নিয়ে তেমন ভাবনার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি…