Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার জিতলেন সাইফ উল হক

মোহাম্মদ তারেক : আর্কেডিয়া শিক্ষা প্রকল্পটি এবার নিয়ে এলো বাংলাদেশের জন্য অনন্য সম্মান। প্রকল্পটি পেল আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার। এ পুরস্কার অর্জন করলেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান একজন স্থপতি। আর্কেডিয়া শিক্ষা প্রকল্পের জন্য সাইফ উল হক এ পুরস্কার পেয়েছেন। আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার স্থাপত্যের দুনিয়ায় অত্যন্ত সম্মানজনক। এর আগে বাংলাদেশে এ পুরস্কার জিতেছিলেন খ্যাতিমান দুজন স্থপতি। ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদ স্থাপত্যের জন্য মেরিনা তাবাসসুম এবং গাইবান্ধায় ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার স্থাপত্যের জন্য কাশেফ মাহবুব এপুরস্কার পেয়েছিলেন। এবার আরেকজন বাংলাদেশি স্থপতি সাইফ উল হক আগাখান পুরস্কার পেলেন।
স্থাপত্যকলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, আগাখান পুরস্কারের মতো পুরস্কার জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থাপত্য সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির পথ আরো মসৃণ হলো। তরুণ স্থপতিদের উদ্ভাবনী ধারনাকে স্বীকৃতি দিতে আগাখান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (এ কে ডি এন) প্রতি তিন বছর পর পর এ পুরস্কার দেয়। এই পুরস্কারের জন্য স্থাপত্য ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব, পরিকল্পনা এবং ঐতিহাসিক স্থাপত্য সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেয়া হয়। উদ্ভাবনী ধারনার পাশাপাশি স্থাপনাটি কতটা পরিবেশ বান্ধব সেটিও দেখা হয়। এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় অত্যন্ত কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ২৯ আগস্ট রুশ ফেডারেশনের তাতারস্তানের রাজধানী কাজানে বিজয়ীর নাম ঘোষনা করা হয়। ছয়টি স্থাপনাকে এবার দেওয়া হয় বিশ্বের সেরা ছয় স্থাপনার পুরস্কার। বাংলাদেশের ১টি স্থাপনা ছাড়াও বিজয়ীদের মধ্যে রয়েছে বাহারাইনের মুহররাক এর পুরুজ্জীবন, ফিলিস্তিনের ফিলিস্তিন জাদুঘর, রাশিয়ান ফেডারেশনের পাবলিক স্পেস ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম, সেনেগালের অষরড়ঁহব উরড়ঢ় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান এবং গবেষনা ইউনিট এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মর্জাজলা ভ‚মি কেন্দ্র। আর্কেডিয়া শিক্ষা প্রকল্পের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন সাইফ উল হক খান।

পুরস্কার পাওয়ার অনুভ‚তি কেমন? এ প্রসঙ্গে সাইফ উল হক বলেন, খুবই আনন্দের একটা অনুভ‚তি। সৃষ্টিশীল কাজের জন্য এরকম বড় একটা সম্মান পাওয়ায় বাংলাদেশের একজন স্থপতি হিসেবে আমি খুবই গর্বিত এবং আনন্দিত। এই আনন্দের দাবিদার আমার একার নয়। এই প্রজেক্টের সঙ্গে অন্য স্থপতিরা আমার সাথে কাজ করেছেন এবং দেশের যারা স্থপতি আছেন তাদের সবার। বিশেষ করে সালমা পারভীন খানের কথা বলতেই হয়। তিনিও এর পেছনে অনেক শ্রম দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, এই প্রজেক্টে ওরা আমাদের তিনজনকে পুরস্কৃত করেছে। স্থপতি হিসেবে আমাকে। স্থাপনার ক্লায়েন্ট রাজিয়া আলম এবং প্রধান কাঠ মিস্ত্রি প্রাণ বল্লব বিশ্বাসকে।
আমি মনে করি এটি ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে দেশের জন্যও বড় অর্জন। বাংলাদেশের আর্কেডিয়া শিক্ষা প্রকল্পটি বিশ্বের নামকরা পুরস্কার পেয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে সবার ধারনার পরিবর্তন হবে। আমাদের স্থপতিরা সীমিত বাজেট ও অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সৃষ্টিশীল কাজ গুলো করে যাচ্ছেন সবার অজান্তেই। এ পুরস্কার পাওয়ার মাধ্যমে আমাদের কাজ গুলো সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আরো আলোচনা হবে, সেটাই আমাদের অর্জন। স্থপতি সাইফ উল হক আর্কেডিয়া শিক্ষা প্রকল্পটি সম্পর্কে বলেন,
আমাকে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য একটা স্কুল বানিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন আমার ছোট খালা রাজিয়া আলম। তিনি ইংল্যান্ডে ছিলেন এক সময়। সেখান থেকে ফিরে সাভারের নগর কুন্ডার বালিয়াপুর এলাকায় একটি স্কুল খুলেছিলেন। এর সঙ্গে ছিল নার্সারি। ওটার টাকায় চলত স্কুল। তো স্কুলটা করার জন্য প্রথম আমাকে কেরানীগঞ্জের কানারচরের ওই জায়গাটিতে নিয়ে যান ২০১১ সালে বর্ষার সময়। জায়গাটা দেখেই আমি রাজিয়া আলমকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কী করব ঠিক বুঝতে পারছিনা। এখানে তো পানি। তখন রাজিয়া আলম বললেন, বর্ষা চলে গেলেই এখানে ডাঙার দেখা মিলবে। বর্ষার সময়টায়ই শুধু পানি থাকে। এই সুযোগে একটা কথা বলে রাখি, একেবারে নিজের মতো করে একটা স্কুল গড়ার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের। আমার মনে হয় ছোট শিশুদের স্কুলের পরিবেশটা হওয়া চাই তাদের মনের মতো। সুযোগ যে একেবারে পাইনি তা নয়। এর আগে স্কলাস্টিকা স্কুলের নকশা করেছি। আবার রাজশাহীর প্যারামাউন্ড স্কুলেরও নকশা করেছিলাম। যদিও পরে তারা আমার নকশায় কিছু বদল করে নিজেদের মতো করে স্কুলটা বানায়। সব মিলিয়ে মনের মধ্যে একটা আক্ষেপ ছিল। তাই রাজি হয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম, কি ভাবে এখানে স্কুল বানানো যায়। জমিটা ভরাট করতে চাচ্ছিলাম না। আবার বাঁশের মাচার মতো বানিয়ে একটা কিছুর কথাও মনে হলো। কিন্তু বর্ষা চলে গেলে স্কুলটা অনেক উঁচুতে উঠে থাকবে। তখন শিশুদের অনেক সমস্যা হবে। নদীর ঘাটের পন্টুন গুলোর মতো কিছু বানানো যায় কিনা চিন্তা করলাম। কিন্তু মনটা খুঁত খুঁত করছিল। এ সময়ই নতুন একটা চিন্তা মাথায় এলো। এমন একটা কিছু করতে হবে, যেটা বর্ষায় ভেসে থাকবে। আবার পানি চলে গেলেও দাঁড়িয়ে থাকবে সুন্দর মতো। অর্থাৎ উভচর একটা কাঠামো বানাব। ঠিক করলাম, নিচের অংশটা তৈরি করব ড্রাম আর বাঁশ দিয়ে।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু করলাম আর্কেডিয়া শিক্ষা প্রকল্পের এই স্কুল তৈরির কাজ। পুরনো ড্রাম কিনে আনলাম। ও গুলোকে একটা বাঁশের ফ্রেমে জুড়ে দিয়ে তৈরি করলাম নিচের কাঠামো। অবশ্য মূল কাজ শুরুর আগে নিচের কাঠামোটা শেষ করতে পারলাম। এতে পানি বাড়ার পর এটা ভেসে থাকল। ওপরের কাঠামোর জন্য কাঠের খুঁটিও বসিয়ে দিতে পেরেছিলাম। এবার এই ভাসমান ভিত’এর ওপর দাঁড় করালাম বাকি কাঠামো। গোটাটাই বাঁশ দিয়ে। বাঁশ ব্যবহার করার কারণÑ এটা হালকা, তার চেয়ে বড় কথা, এতে খরচও পড়ে কম। ছাদের তিনটা স্তর। দুটি বাঁশের স্তুরের মাঝখানে বৃষ্টির পানি আটকানোর জন্য দিলাম ক্যানভাসের কাপড়। আবার প্রতিটি রুমের দুই পাশে শালÑ গজারি কাঠের খুঁটি দিয়ে আটকানোর ব্যবস্থা হলো। এভাবেই ২০১৬ সালের ফেব্রæয়ারিতে শেষ হলো কাজ। অবশ্য প্রথম বর্ষার সময় একটা ঝামেলা হলো। কাঠামো গুলো যে খুঁটি দিয়ে আটকানো হয়েছে, সে গুলো নড়বড়ে হয়ে গোটা কাঠামোই ভেসে গিয়েছিল। পরে কাঠামো গুলোর দুই পাশে কয়েকটি বাঁশ দিয়ে শক্ত খুঁটি বানিয়ে একেবারে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত আটকে দেই। এ ধরনের ভাসমান স্কুল দুনিয়ায় খুঁজলে আরো অনেকই হয়তো পাবেন। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ধারনা একটু নতুনই। বিদ্যালয়ের সর্বমোট পাঁচটি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে কনা, বিন্দু ও সিন্ধু নামের তিনটি কক্ষ শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য ব্যবহার করা হয়। অন্য দুটির মধ্যে একটি অফিস রুম আরেকটি ছাত্র-ছাত্রীদের টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অফিস কক্ষ ও শ্রেণিকক্ষের মাঝখানে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য বানানো হয়েছে সুন্দর একটি বাঁশের তৈরি জায়গা।
এই বিদ্যালয়ে বর্তমানে মোট ২০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের শিক্ষাদানের জন্য একজন শিক্ষিকা আছেন। এটা আসলে প্রাক-প্রাথমিক একটি বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে পাশের ইটভাটার শ্রমিকদের বাচ্চারা পড়ে। তাছাড়া গ্রামের শিশুরাও পড়তে আসে। এমনিতে সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ইট ভাটার শ্রমিকদের বাচ্চাদের পড়ানো হয়। ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত পড়ানো হয় গ্রামের অন্য শিশুদের।
বিদ্যালয়টির সার্বিক দেখাশুনা করেন মো: আব্দুল বারেক নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি। কয়েকজন মিস্ত্রিকে দায়িত্ব দেওয়া আছে, বিদ্যালয়টির বাঁশ-খুটির সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে তা মেরামত করে দেয়। বাঁশ দিয়ে বিশেষ ভাবে নির্মিত স্কুলটির কথা গোটা বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে মূলত স্থাপত্য নির্দশন হিসেবে আন্তর্জাতিক আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার পাওয়ার পর।
স্থপতি সাইফ উল হক ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পরই তিনি কাজী খালেদ আশরাফ, খালেদ নোমান ও জালাল আহমেদ এই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ডায়াগ্রাম আর্কিটেক্টস’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। দুই বন্ধু খালেদ আশরাফ ও খালেদ নোমান বিদেশে যাওয়ায় ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জালাল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের দেখাশুনা শুরু করেন সাইফ উল হক। এরপর ১৯৯৭ সালে স্ত্রী স্থপতি সালমা পারভীন খানকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সাইফ উল হক স্থপতি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে গোবিন্দ গুণালঙ্কার ছাত্রাবাস প্রকল্প, ফরিদপুরে ব্রাক ট্রেনিং সেন্টার, যশোরে বাঁচতে শিখা ট্রেনিং সেন্টার, বগুড়ায় পুরাতন তত্ত¡বিদদের আবাসন ভবন, ধানমন্ডিতে আঁলিয়ন্স ফ্রর্সেস এর লাইব্রেরী, চট্টগ্রামে কোরিয়ান এক্সপার্ট প্রসেসিং পোশাক কারখানা ও শ্রমিকদের আবাসান ভবন ইত্যাদি।